সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ – Sultan Shamsuddin Iltutmish

সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ

দিল্লীর কুতুব কমপ্লেক্সে দিল্লী সালতানাতের মামলুক বংশের ৩য় সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশের সমাধি। 

 
  ইলতুৎমিশ প্রথম জীবনে ছিলেন কুতুব উদ্দিন আইবেকের ইলবারী তুর্কি বংশোদ্ভুত ক্রীতদাস। কুতুব উদ্দিন আইবেক ছিলেন ঘুর সালতানাতের মহান সুলতান ময়েজউদ্দিন মুহাম্মাদ বিন সাম ওরফে মুহাম্মাদ ঘুরীর ক্রীতদাস ও সেনাপতি। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়ের পর কুতুব উদ্দিন আইবেককে হিন্দুস্তানের রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করেন সুলতান মুহাম্মাদ ঘুরী। ১২০৬ সালে মুহাম্মাদ ঘুরীর ইনতিকালের পর তাঁর সালতানাত কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কুতুব উদ্দিন আইবেক হন হিন্দুস্তানের সুলতান, সূচনা হয় দিল্লী সালতানাতের। 
১২১০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের মৃত্যু হলে গৌড়ের গভর্নর আলী মর্দান খিলজী স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ও আলাউদ্দিন আলী শাহ্ নাম ধারণ করে নিজের নামে স্বর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করেন। 
কুতুব উদ্দিন আইবেকের ইনতিকালের পর আমাত্যবর্গ তাঁর পুত্র আরাম শাহ কে সিংহাসনে বসালেও আরাম শাহর অযোগ্য শাসনের বিরুদ্ধে দিন দিন অসন্তোষ বাড়তে থাকে । ১২১১ সালে আরাম শাহ কে ক্ষমতাচ্যুত করে দিল্লীর মসনদে আরোহণ করেন ইলতুৎমিশ। তিনি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহ দমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তাঁর দক্ষতা ও প্রজাপালনে মুগ্ধ হয়ে খলিফা আল-মুসতানসি র বিল্লাহ তাঁকে ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধি প্রদানপূর্বক নিজের ব্যবহৃত খিল’আত উপহারস্বরূপ প্রেরণ করেন। ইলতুৎমিশ তাঁর মুদ্রায় নিজেকে ‘খলিফার সেনাপতি’ হিসেবে চিত্রিত করেন। তিনি সালতানাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ৪০ জন নিজের অনুগত তুর্কি ক্রীতদাসের সমন্বয়ে একটি অভিজাত পরিষদ গঠন করেন, যার নাম ‘বন্দেগন-ই-চেহেলগান’। অন্যান্য আমিরদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বীয় অনুগত দাসদের নিয়ে পরামর্শ পরিষদ গঠন করে প্রশাসনিক কর্তৃত্বভার তাদের হাতে ন্যাস্ত করেন সুলতান ইলতুৎমিশ। তিনি তাঁর শ্বশুর কুতুব উদ্দিন আইবেকের অসমাপ্ত কুতুব কমপ্লেক্স ও কুতুব মিনার এর নির্মাণ কাজ সমাধান করেন। বিখ্যাত দরবেশ শাইখ কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র.)-এর স্মরণে নির্মিত হয় এই সুউচ্চ চমৎকার স্থাপনাটি। 
১২১৩ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান আলী মর্দান ওরফে আলী শাহ কে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করে গৌড়ের সুলতান হন হুসামউদ্দীন ইয়াজ খিলজী। তিনি ‘গিয়াসউদ্দীন’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। গিয়াসউদ্দীন ইয়াজ শাহ্ খলিফার ইজাজতনামা লাভ করেন। তিনি বেশ কিছু খানকাহ, মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণ করেন।
 ১২২৭ সালে গৌড়ের সুলতান ইয়াজ শাহর বিরুদ্ধে নিজের সবচেয়ে বিচক্ষণ পুত্র শাহজাদা নাসিরউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করেন ইলতুৎমিশ। হিন্দুস্তানের বাহিনী ইয়াজ শাহ কে পরাজিত করতে সক্ষম হয় এবং গৌড় পুনরায় দিল্লী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়। 
শাহজাদা নাসিরউদ্দিন মাহমুদ কে গৌড়ের গভর্নর নিযুক্ত করেন ইলতুৎমিশ। ১২২৯ সালে সিংহাসনের সবচেয়ে যোগ্য উত্তরাধিকারী নাসিরউদ্দিন মাহমুদ লখনৌতিতে ইন্তিকাল করেন। ফলে হিন্দুস্তানের পরবর্তী যোগ্য উত্তরাধিকার নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়..
অনেক ভেবে-চিনতে নিজ কন্যা শাহজাদী রাজিয়া কে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন সুলতান ইলতুৎমিশ।। 
১২৩৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ। কথিত আছে, মৃত্যুশয্যায়ও বারবার তিনি শাহজাদী রাজিয়ার উত্তরাধিকারী হবার কথা বলছিলেন।
 যদিও সবাই তাঁর জীবদ্দশায় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আমাত্যবর্গ ১ জন নারীকে সিংহাসনের অধিকারী করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন ও ইলতুৎমিশের অযোগ্য পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহ্ কে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু রুকনউদ্দিন ফিরোজ মসনদে বসলেও সমস্ত ক্ষমতা তার মা শাহ তুর্কানের হাতে কুক্ষিগত থাকে এবং সুলতানা শাহ তুর্কান ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে সুলতান ইলতুৎমিশের অন্য স্ত্রী ও সন্তানদের উপর নানাবিধ অত্যাচার করতে থাকেন, পাশাপাশি খেয়ালখুশিমত নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করায় সালতানাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
 তখন আমাত্যবর্গ বাধ্য হয়ে শাহজাদী রাজিয়াকে ক্ষমতাগ্রহণের আহ্বান করেন। রাজিয়া নিজ সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে রুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহ ও শাহ তুর্কান কে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করে সর্বজন সম্মতিক্রমে দিল্লী সালতানাতের সিংহাসনে আরোহণ করেন। 
প্রথমবারের মতো হিন্দুস্তানের শাসক হন একজন নারী। সুলতান রাজিয়া সালতানাতে চলমান বিদ্রোহসমূহ দমনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
__________________________
লেখক : রাজিত তাহমীদ জিত
১৫.১০.২০২২
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?