সুফি চৈতন্যের বিচিত্র কথকতা – সুফি সাহিত্যের পর্যায়

সুফি সাহিত্যের পর্যায়

মৌলিকভাবে তিনটি পর্যায় আছে সুফি সাহিত্যের।

প্রথম পর্যায়ের সময়কাল ইসলামের উদ্ভব থেকে শুরু করে অব্যাহত ছিল দ্বিতীয় হিজরি শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত। সে সময়ের সাহিত্যের মূল বিষয় ছিল প্রজ্ঞা, ধর্মীয় উপদেশ ও উত্তম আখলাকের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ। সেখানে আহ্বান ছিল। আল্লাহর ফয়সালার সম্মুখে বিনয়াবনত সমর্পণ, দুনিয়াবিমুখতা এবং এবাদতের আধিক্যের প্রতি। সামগ্রিকভাবে এই পর্যায়টি আমাদের সামনে সেই কালের মানুষদের চিন্তাকেন্দ্রিক সারল্য ও অস্থিরতার চিত্রায়ণ করে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়কাল হিজরি দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ থেকে অব্যাহত থাকে চতুর্থ হিজরি শতক পর্যন্ত। এ সময়কালে আরবের সাথে অন্যান্য জাতির ভাষা ও চিন্তার ব্যাপক সংমিশ্রণ ঘটে; অধিবিদ্যা বা ঈশ্বরতত্ত্বে মানুষের একাডেমিক চর্চার রং বদলাতে থাকে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, দর্শন ও এলমে কালামের জ্ঞানবৃত্তিক ছায়ায়। তখন মুসলিমবিশ্বে গ্রিক দর্শনের অনুবাদ হয়, পরিবর্তন আসে মানুষের ভাবনার গতিপথে।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সুফি সাহিত্যের সিংহভাগ ছিল গদ্য; সামান্য কিছু পদ্য যদিও রচিত হয়। সুফি পরিভাষা ও নতুন চিন্তাধারাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে।
তৃতীয় পর্যায় অব্যাহত থাকে হিজরি চতুর্থ শতাব্দী থেকে সপ্তম হিজরি শতকের শেষ ও অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত। সুফি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ ছিল এই পর্যায়, সমৃদ্ধতা অর্জন করেছিল সর্বক্ষেত্রে কী কাব্যে, কী গদ্যে, কী ফিলোসফির বৃত্তে। জগৎশ্রেষ্ঠ কাব্যের স্রোতে তখন সে ভাসিয়ে নিচ্ছিল চারপাশ; এর প্রতিটি নির্মাণ ছিল আধুনিক ও জটিল; এর দর্শন ছিল অধিবিদ্যা চর্চায় স্বতঃস্ফূর্ত ও তেজোদীপ্ত এর ফ্যান্টাসির শেষ পাড় ছিল অস্পৃশ্য, অসীম অর্থময়তায় পরিপূর্ণ।
এ সাহিত্য মানুষের সামনে তার অবগুণ্ঠন খুলে দাঁড়ায়— শব্দ-বাক্য এখানে কোনো বিষয় না, এখানে কথা বলে সুফির নিঃশ্বাসের রক্ত! এই সাহিত্য এমন এক ইউনিভার্স নির্মাণ করে, যার প্রতিটি ধূলিকণা সৌন্দর্যের রূপে বিভূষিত। এর সুর আকাশ থেকে নেমে আসা ফেরেশতাদের আঙুলের ব্যঞ্জনা। এখানে অঙ্কিত হয়েছে একটিমাত্র নাম—ভালোবাসা। একটিমাত্র ক্রন্দন—প্রেম।
সুফি সাহিত্যের পরিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য সুফিবৃত্তে আবর্তিত আচার ও হালতের অধিকারী হতে হয়, অন্যথায় এর সম্পূর্ণ বোধ লাভ করা সম্ভব নয়। সুফি গদ্যের মতো সুফি কবিতারও ক্রমবিবর্তন হয়েছে। এর নীরব ইতিহাস লুকিয়ে আছে আরবের ইবনে আরাবি, ইকাল ফরিদের কাব্যে: অন্য দিকে রুমির পার্সিয়ান কাব্যের প্রতিটি লাইনে।
এ ছাড়াও পত্রসাহিত্যের এক বিশাল সম্ভার গড়ে উঠেছিল সুফি ঘরানার শায়খ ও মুরিদের মধ্যকার পারস্পরিক লেখালেখিতে। এ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য ছিল— প্রজ্ঞার দেহ দুই ভাগে বিভক্ত। অর্ধেক তার প্রশ্ন, আর অর্ধেক হল জবাব।🔊
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?