সিরাতের সৌরভ লেখক : আরাফাত শাহীন | Sirat Showrov

সিরাতের সৌরভ
লেখক : আরাফাত শাহীন
প্রকাশনী : দারুল ইলম
বিষয় : সীরাতে রাসূল (সা.)
পৃষ্ঠা : 96, কভার : হার্ড কভার
ভাষা : বাংলা

যাবতীয় প্রশংসা আমার রবের নামে। আমার নবীজিকে নিয়ে দু’লাইন লেখার মতো হিম্মত আমার কখনো ছিলো কিনা সঠিক অনুধাবন করতে পারিনি। আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ পাক যখন কারো মাধ্যমে কোনো খেদমত করাতে চান, তখন অযোগ্য ব্যক্তিকেও তিনি নিজ অনুগ্রহ বারিতে সিক্ত করেন। রাসূল প্রশস্তি যেমন আত্মার খোরাকী, কোনো ব্যক্তির জন্য তেমনই সম্মানি। আমি হয়ত তেমনই একজন; রব যাকে নিজ অনুগ্রহের চাদরে মুড়ে সেই কাতারে এনে ফেললেন। আলহামদুলিল্লাহ! সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ।
ভূমিকা শুরুর আগেই ছোট্ট করে কতক কথা না বললেই নয়; তাই বলে ফেলি। ঝটপট। সীরাতের পাতা জুড়ে পবিত্রতার পরশ বুলানো আর স্নিগ্ধতার সৌরভ মাখা! বিহামদিল্লাহ, অসংখ্য সীরাতের কিতাব ইতিমধ্যে রচিত হয়েছে। অসংখ্য মনীষীরা এই ময়দানে কলম তুলেছেন, রচনা করেছেন উপকারী প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, কবিতা, ইতিহাস। আল্লাহ পাক তাদের সকলকে জান্নাতের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিন। আমীন।
সকল রচয়ীতাদের নামের সাথে আমি বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাই শাইখ মুহাম্মাদ আল কুলাইয়্যিকে। বাংলায় অনূদিত, বাংলায় লিখিত সীরাত পড়তে পড়তে এক সময় শুরু করি আরবি গ্রন্থ সংগ্রহ এবং পাঠ। সেই ধারাবাহিকতায় একদিন হস্তগত হয় শাইখ মুহাম্মাদ আল কুলাইয়্যির ‘কাম উহিব্বুকা ইয়া রাসূলুল্লাহ’ বইটি। পড়তে পড়তে তৃপ্ত হই। ছোট্ট একটা বই অথচ উঠে এসেছে আনুসাঙ্গিক সব আলোচনা। ভাষার নৈপূন্যে এর পাঠ ছিল দূরহ! কিন্তু ভাববাচ্যে দারুণ সেই বইটি যেন আমার আত্মায় জায়গা করে নিয়েছিল। প্রিয় পাঠক, এই বইটিতে সে পান্ডুলিপির ছায়া স্পষ্ট পাবেন।
নবী জীবনী ঠিক ততখানি বিস্তৃত, যতখানি বিস্তৃত নবীজির জীবন। সেই জীবনের গল্পকে প্রকৃত আঙ্গিকে ধারণ করতে পারে না কোনো কাগুজে পান্ডুলিপি। তাই স্বল্প পরিসরে নবী জীবনীর আনাচে-কানাচে উঁকি দিতে চাইলে আমার বিশ্বাস এই বইটি আপনাকে তৃপ্ত করবে।
প্রিয় পাঠক … তাঁর জীবন সাগর থেকে এক চুমুক বিশুদ্ধ জল রেখে দিলাম আপনাদের সম্মুখে! পাঠ করবেন আর পান করবেন সেই বেহেশতী জাম; যার প্রেম শরাবের প্রতিটি চুমুকে চুমুকে আপনি প্রশান্তি অনুভব করবেন। আর বলতে থাকবেন, “প্রিয়তম মুহাম্মাদ, আপনি আমার শুদ্ধতম প্রেম!”
আপনি আমার শুদ্ধতম প্রেম শুরুর কথা
সকল প্রশংসা মহান প্রভুর সমীপে; যিনি হেদায়েতের প্রদীপ হাতে, সত্যদ্বীনের ধারকরূপে প্রিয় রাসূলকে পাঠিয়েছেন আমাদের মাঝে। ঘটিয়েছেন তাঁর পূর্ণিমাময় মর্যাদার আকাশে অপূর্ব সব নক্ষত্রের সমাহার। কী শিক্ষক! কী অভিভাবক! পথনির্দেশক কিংবা যুদ্ধের অধিনায়ক – পুরো সত্তাজুড়ে খোদাই করে দিয়েছেন পিতৃত্ব, নেতৃত্ব আর কর্তৃত্বের অনুপম সৌন্দর্য। আল্লাহ তাআলা বলেন –
لقد من الله على المؤمنين إذ بعث فيهم رسولا من أنفسهم يثلوا عليهم عايته ويزكيهم ويعلمهم الكتب والحكمة وإن كانوا من قبل لفي ضلي مبين
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অত্যন্ত অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন, যখন তাদের নিকট তাদের নিজস্ব একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, সে তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনাচ্ছে, তাদেরকে পরিশোধন করছে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত (সুন্নাহ) শিক্ষা দিচ্ছে, যদিও তারা পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল।১
দুরুদ ও সালাম সেই মহামানবের তরে, যিনি ছিলেন জগতবাসীর অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ে আলোর ফল্গুধারা। অঝোর ধারায় বর্ষিত হোক তাঁর রওজায় রহমত ও প্রশান্তির শীতল শিশির। বর্ষিত হোক তাঁর নিষ্কলুষ ও পবিত্রআত্মা পরিবারের উপর। আরো বর্ষিত হোক সৌভাগ্যের প্রতীক তাঁর সাহাবীদের উপর। কেয়ামত পর্যন্ত সত্যনিষ্ঠ অনুসারীদের উপর।
পর কথা এই যে –
আমাদের সম্মুখে দৃশ্যমান বইটি প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাপিত জীবন হতে আহরিত কিছু দোদীপ্যমান আলোর সমাহার। যার প্রতিটি তথ্যই সীরাতবিদদের কষ্ঠিপাথরে শুদ্ধতার যাচাইয়ে উৎকর্ষিত। আমি চেষ্টা করেছি সরল বাক্যে সহজ শব্দের সেই আলোকধারার চিত্রায়ন করতে। যাতে নবিজীর পুরোটা
* সূরা আল ইমরান। আয়াত ১৬৪।
জীবন একনজরে চিত্রিত হয়ে ওঠে পাঠকের অন্তরে। যেন তাঁর মহাত্ম, তাঁর অনুপম চরিত্র আলোড়ন তুলে দেয় হৃদয়-অনুভবে। ফুটে ওঠে তাঁর নেতৃত্বের কর্মধারা, কানে কানে যেন অনুরণন হতে থাকে তাঁর সুসংসবাদ ও সতর্কতার বাণী-বার্তা।
বইটি সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আশা করি তাতে রয়েছে তৃষ্ণার্ত আত্মার কিছু খোরাক। সংশয়বাদী বিবেকে চিন্তার শুদ্ধতার যোগান। অশান্ত হৃদয়ে শীতল প্রশান্তি। চৈতী রোদ্দুরে ক্ষয়ে যাওয়া জীবনে বসন্তের সজীবতা।
তাই আসুন! প্রিয় নবীজির জীবনজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিরে-মুক্তোর ছোঁয়ায় নির্মল হোক আমাদের পঙ্কিল আত্মা। খুলে যাক হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার। জাগ্রত হোক সত্তাজুড়ে শুদ্ধতার অনুভব। কারণ একটি পরিশীলিত সমাজ ও পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে নববী কর্মপন্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের বিকল্প নেই। দাওয়াত ও দৃঢ়তায় রাসূলের দিকনির্দেশনাই আমাদের একমাত্র পাথেয়। এজন্য প্রতিটি কাজে কুরআন ও সুন্নাহর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে নির্ধারণ করতে হবে নিরাপদ ও সাবলীল কর্মপন্থা! আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন –
لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة لمن كان يرجوا الله واليوم الاخر وذكر الله كثيرا
অর্থঃ তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি আশা রাখে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। ২
আহ! কী অনুপম আদর্শ ছিলেন তিনি। কী ছিল না তাঁর জীবনজুড়ে দুঃখ-কষ্ট, হাসি আনন্দ, ব্যথা-বিরহ, আশা-নিরাশা প্রতিটি গিরিপথ তাঁর পাড়ি দিতে হয়েছে। সীরাতের পাতা উল্টালে চোখে পড়বে ক্ষুধার তাড়নায় কোনদিন তিনি পেটে পাথর বেঁধেছেন। উমর ইবনুল খাত্তাব প্রিয় হাবিবের অন্দরমহলে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন প্রিয় নবী চাটাইয়ের উপরে শুয়ে আছেন। পিঠজুড়ে দগদগে দাগ অভাবের জানান দিচ্ছে। আবার কোনদিন তিনি দান করে যাচ্ছেন হৃদয় উজাড় করে।
* সূরা আল আহযাব। আয়াত ২১।
কুরাইশ পাষাণ কাফেরদের হাতে নিষ্পেষিত হয়েছেন নির্মমভাবে। পেয়েছেন মাতৃভূমির লোকদের কাছ থেকে ঘৃণা আর অমানুষিক নির্যাতন। দাওয়াতের বাণী নিয়ে গিয়েছেন দুয়ারে দুয়ারে। তাদের সফলতা ও কল্যানকামনার তড়প নিয়ে যতবারই গিয়েছেন তারা ভেবে নিয়েছল যেন অবাধ্যতা আর দুর্ভাগ্যের পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের উপরে। স্বার্থপরের মত তাড়িয়ে দিয়েছে মাতৃভূমির ভিটেমাটি হতে। এতকিছুর পরেও তিনি যখন বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন তখন দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন –
قال لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم وهو أرحم الرحمين
অর্থাৎ, ‘তিনি বললেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনই অভিযোগ নেই, আল্লাহ তোমাদেরকে মাফ করুন! তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।”
কখনো বিষন্নতা, কখনো রাজ্যের সুখ। কখনো ধনীর উদারতা কখনো অনাহারের দু’খ।
রণাঙ্গনে মহাবীর তিনিই আবার নিরাপদ মিত্রও; অভিজ্ঞ কুটনৈতিক। তাঁর যুদ্ধজীবন পাঠে একজন সেনাপতি যেমন অর্জন করতে পারেন যুদ্ধের কলাকৌশল; জেনে নিতে পারেন কেমন ছিল রণাঙ্গনের বিক্রমতা সন্ধির বৈঠকে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। বিজয়ের আনন্দ – উচ্ছ্বাস। পরাজয়ে চরম দৃঢ়তা ও প্রার্থনায় ধৈর্যের খড়গ।
একজন বিচারকও পেতে পারেন অনুসরণীয় অসংখ্যা অধ্যায়। জেনে নিতে পারেন – কীভাবে তিনি ফয়সালা করতেন। অজস্র বিবাদ মিটিয়ে দিতেন চোখের ইশারায়।
একজন শিক্ষকের জন্য রয়েছে সে জীবনে অনুপম আদর্শ। মসজিদে নববীতে দ্বীন শেখানোর সেই মজলিসে বিনয়ের সে কী অনুমপম দৃষ্টান্ত। ছেয়ে যেত শীতল নিরবতা ও ভারত্বের গাম্ভীর্য।
একজন ছাত্রের রয়েছে সেখানে আদর্শের খোরাক। কী চমৎকার সেই দৃশ্য – যখন মহান রবের পাঠানো বানী জিবরীল আলাইহিসসালামের মুখ নিঃসৃত হয়ে টপ টপ করে গলে পড়ত প্রিয় নবিজীর হৃদয়-জমিনে।
• সূরা ইউসুফ। আয়াত ৯২।
একজন দুনিয়াবিমুখ সূফীর জন্যও তিনি একজন বড়পীর। যুহদ, তাকওয়ার বাস্তবতা ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জিত হতে পারে কেবল তার অনুসরণে। বিপদগ্রস্থ প্রতিটি মানুষের জন্য তিনি সান্ত্বনার পরশ। তাঁর ধৈর্য আর দৃঢ়তা শিক্ষা থেকে দা’ওয়াহর পথে অর্জিত হয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। মহান প্রভুর প্রতি অগাধ বিশ্বাস। অন্তরে লালিত হতে থাকে মহাপ্রতিদান প্রাপ্তির স্বপ্ন।
সুতরাং একজন দায়ীর জন্য দাওয়ার পথে নবিজীর জীবনকর্ম এক অনন্য পাথেয়। একজন সেনাপতি, পরিবারের অভিভাবক; এমনকি প্রতিটি সাধারণ আর বিশেষ মানুষ সকলের জন্য প্রিয় হাবিবের সীরাত অনুপম আলোকবর্তিকা, প্রোজ্জ্বল দিক দিশারী।
আমার আশা – বইটি পড়া শেষ করার পরে আমাদের প্রতিটি কথার বাস্তবতা
অনুভব করতে পারবেন।
তাই আসুন শিখে নিই প্রিয় নবিজীর জীবন থেকে। সন্তানদেরকে শেখাই কীভাবে চলতে হবে প্রিয় রাসূলের দেখানো পথে।
প্রিয় পাঠক, আসুন শিরোনামের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মুক্তোগুলো কুড়িয়ে
নিই। চলুন তবে শুরু করা যাক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার নামে৷
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?