রেটিং : ⭐⭐⭐⭐⭐
এই বইটির পাতায় পাতায় ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে হাজারো মণিমুক্তাতুল্য উপমা, যেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সলফে-সলেহীনের ব্যক্তিগত জীবন ও অসংখ্য গ্রন্থাবলি থেকে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন এগুলো থেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ করে। আমাদের নবপ্রজন্ম যেন দ্বীনের সোনালি ছাঁচে গড়ে তুলতে পারে নিজেদের যাপিত জীবনকে।
এই বইটি থেকে আমরা আমাদের আকাবির-আসলাফের রাত্রি জাগরণ ও ইবাদত-মুজাহাদার এই বিস্ময়কর ঘটনাগুলো জানবো। প্রত্যেকে রব্বে কারিমের দরবারে বিনয়াবত হবো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গুনাহের জন্য ধিক্কার দিবো। মনে মনে অনুশোচনা করবো। প্রত্যেকেই নিজের আমলগুলোকে ছোট মনে করবো। আমরা যে আমলগুলো করছি সেগুলো মহান আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হবে তো? হবে কি এগুলো পরকালে আমার জন্য নাজাতের উসিলা? – এসব নিয়ে ফিকির করবো।
_________________________________________________
তামাম প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার জন্যই সমর্পিত। হৃদয় নিঙড়ানো হাজারো দরুদ-সালাম নিবেদিত আমার প্রাণপ্রিয় নবীর জন্য।
আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত—ইবাদত কোনো মামুলি বিষয় নয়। এটা মুমিনের জন্য সম্মানের প্রতীক; স্রষ্টার প্রতি বান্দার আনুগত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন। এই সম্মানের বিষয়টির প্রতি লক্ষ রেখেই একজন মানুষ যত বেশি মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে, যত বেশি তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে সে ততই আল্লাহ তাআলার প্রিয় হতে থাকবে। তার অন্তরে ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে বিনয়। হৃদয়ে আসবে কোমলতা। অন্যদিকে একজন মানুষের ইবাদত বন্দেগী যত কম হবে, তার নফস হবে ঠিক ততটাই উচ্ছৃঙ্খল ও অকর্মণ্য। ইবাদতে অলসতা অবহেলার কারণে একসময় সে পরিণত হবে নফসের গোলামে।
মহান আল্লাহ তাআলার অশেষ অনুগ্রহ ও মেহেরবানী; তিনি এই উম্মতের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন পরহেজগার ও ইবাদতগুজার বান্দাদের এমন এক প্রজন্ম, যাদেরকে উপমা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়—অত্যধিক ইবাদত, সীমাহীন আনুগত্য, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ণরূপে।
এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ইসলামের সোনালি যুগের আকাবির, আসলাফ ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়া-পরহেজগারির ক্ষেত্রে আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক অতুলনীয় উপমা। আমাদের সামনে তারা উপস্থাপন করেছেন ইবাদতে মুজাহাদার ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর উপাখ্যান। তারা এক্ষেত্রে অর্জন করে নিয়েছেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা। ফলাফলে আজ তারা হয়েছেন মানবজাতির জন্য শিক্ষার বিষয়, উজ্জ্বল উপমা। বাস্তবিক অর্থেই তারা সবার জন্য উত্তম আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
আপনি চারদিকে একটু তাকালেই দেখতে পাবেন, মানুষের মুখে মুখে আজ তাদের খোদাভীতির কথা আলোচিত হয়। চর্চিত হয় তাদের ‘প্রভু নৈকট্য’ এর কথা। সত্যি বলতে মানুষ আজ এমন এক পুণ্যময় জামাতকে নিজেদের উপদেশ গ্রহণের জন্য নির্বাচন করেছে যারা কোনো পাপমুক্ত নবী নন, নন তারা আকাশের কোনো ত্রুটিহীন ফেরেশতা। আপনিই বলুন, তাদের জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে!
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ -এর তিরোধানের পর যদি কোনো নবী আসার সুযোগ থাকতো, তাহলে অবশ্যই মানুষ বলতে পারতো—দেখো, এরাই হয়তো সম্মানিত নবীদের জামাত! কিন্তু এখন এটা বলার কোনো সুযোগ আর আমাদের সামনে অবশিষ্ট নেই। তাই এখন আমাদের জন্য এটা বলা একটা অসম্ভব ব্যাপার বটে।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হলো, আমি এখানে আমাদের আকাবির আসলাফের ইবাদতের যে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরবো, তাদের আনুগত্যের যে ব্যাপকতা উপস্থাপন করবো, তা দেখে সমসাময়িক ব্যক্তিত্বদের এটা বলার সুযোগ অবশ্যই আছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে যখন বস্তুবাদী দর্শন ঢেকে ফেলেছে পুরো পৃথিবী, পার্থিব চাহিদা যখন গ্রাস করে ফেলেছে ইবাদতের মজা-স্বাদ, স্বার্থবাদী চিন্তাচেতনা যখন ধ্বংস করেছে হৃদয়ের উত্তাপ, আশা-আকাঙ্ক্ষার পাথরে যখন চাপা পড়ে গেছে বুকের ঈমানী তেজ, ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রয়োজন আমাদের নবপ্রজন্মের সামনে আমাদের পূর্বসূরি আকাবির-আসলাফের ঈমানদীপ্ত সব ঘটনা, তাদের তাকওয়া-পরহেজগারি আর ইবাদত-আনুগত্যের সোনালি উপাখ্যানগুলো তুলে ধরা; যাতে অন্ধকারে ডুবে থাকা সমাজ তাদের উপমা দেখে পেয়ে যায় মহান আল্লাহ তাআলাকে পাবার পথ। তারা যেন লাভ করে আলোর পথের দিশা। তাদের হৃদয়ে যেন আসে এক বিপ্লবী জাগরণ!
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, চিন্তাচেতনা সমৃদ্ধি লাভ করে পুণ্যবানদের দিকনির্দেশনার মাধ্যমে। মুত্তাকীদের ইবাদতের মাধ্যমে। শত্রুর ভয়ভীতি ও ক্রোধ উপেক্ষা করে তাওবার মাধ্যমে। পাপীদের ভালোকাজ ও কল্যাণের পথে ফিরে আসার মাধ্যমে।
সুতরাং আপনাদের কাছে আমার আবেদন—দুনিয়াপ্রেমী হৃদয় ও শত্রুর ক্রোধের ভয়ে তাওবাকারীদের থেকে আপনারা দূরে থাকুন। নেককারদের দোয়াকে নিজের জন্য আপন করে নিন। এটাকে গনিমত মনে করুন। প্রকৃতপক্ষে এটিই মর্যাদাবানদের গৌরবের জিনিস। আমি চাই আপনারাও নিজেদের তাদের মতো ব্যক্তিত্ববান বানানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকুন।
প্রিয় ভাই, আমি তোমাকে বলতে চাই—সামনে এগুলো আমাদের বড়দের ইবাদত ও আনুগত্যের সামান্য কিছু উপমামাত্র। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে এগুলোকে দু’মলাটের মাঝে একত্র করা হয়েছে। আকাবিরদের মণিমুক্তাতুল্য জীবনীগ্রন্থ থেকে চমৎকারভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে—আমাদের মহান উত্তরসূরিদের এসব জীবন্ত উপাখ্যান।
তুমি যদি এই বইয়ের কাছে তাদের বড়ত্বের কথা জানতে চাও, সে হৃদয়গ্রাহী করে তোমার কাছে তুলে ধরবে তাদের চমৎকার উপমা। তুমি যদি এই বইয়ের কাছে তাদের ব্যক্তিত্ব ও নিজস্ব চিন্তাধারা সম্পর্কে প্রশ্ন করো, তাহলে সে তোমার কাছে গবেষণালব্ধ সেরা জিনিসটাই উপস্থাপন করবে। যদি তুমি যুগের বিবর্তন-পরিবর্তন সম্পর্কে এর কাছে জানতে চাও, তাহলে এর অভিনবত্ব তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে আমাদের ফেলে আসা সোনালি গৌরবময় ইতিহাসের সাথে।
তুমি দেখতে পাবে এই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়ানো-ছিটানো আছে হাজারো মণিমুক্তাতুল্য উপমা, যেগুলো আমি সংগ্রহ করেছি আমাদের আকাবির-আসলাফের ব্যক্তিজীবনীমূলক অসংখ্য গ্রন্থাবলি ঘাটাঘাটি করে। এসব সবার সামনে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হলো, মানুষ যেন এগুলো থেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ করে। আমাদের নবপ্রজন্ম যেন দ্বীনের সোনালি ছাঁচে গড়ে তুলতে পারে নিজেদের যাপিত জীবনকে।
আমি চাই—আমাদের প্রত্যেকেই নিজেদের আকাবির-আসলাফের রাত্রি জাগরণ ও ইবাদত-মুজাহাদার এই বিস্ময়কর ঘটনাগুলো পড়ে নিজের গর্ব-অহমিকাকে পদদলিত করে। প্রত্যেকে যেন রাব্বে কারিমের দরবারে বিনয়াবত হয়। প্রত্যেকেই যেন নিজেকে নিজ গুনাহের জন্য ধিক্কার দেয়। মনে মনে অনুশোচনা করে। প্রত্যেকেই যেন নিজের আমলগুলোকে ছোট মনে করে। তাদের অন্তরে যেন এই অনুভূতি আসে, আমি যে আমলগুলো করছি সেগুলো মহান আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হবে তো? হবে কি এগুলো পরকালে আমার জন্য নাজাতের উসিলা?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ—তিনি যেন আমাদের সবার দোষ-ত্রুটিগুলো ঢেকে রাখেন। সবার সামনে যেন আমাদের অপমানিত না করেন।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত—সময় থাকতেই মহান রাব্বে কারীমের পথে ফিরে আসা। আমাদের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজন এ সকল মহামনীষীদের জীবনীগ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করা। তাদের উপমাতুল্য ইখলাস ও ইবাদত-বন্দেগীর কথা শোনা। আমলের ক্ষেত্রে আমাদের বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িগুলোর প্রতিও সযত্ন দৃষ্টি রাখা।
আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমরা যদি ইখলাসের সাথে এই আমলগুলো করতে পারি তাহলে অবশ্যই নিজেদের গুনাহের জন্য আমাদের মনে সৃষ্টি হবে অনুশোচনা। আমরা নিজেদেরকে কাজে-কর্মে আমাদের আকাবির আসলাফ ও ঈমানদীপ্ত শ্রেষ্ঠপ্রজন্মের সাথে মিলানোর আগ্রহ ও উৎসাহ উদ্দীপনা পাবো। সর্বোপরি, আমাদের হৃদয়ে সৃষ্টি হবে আখিরাতে সর্বোচ্চ সফলতা লাভের জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আগ্রহ।
একজন আরব্য কবি কত চমৎকারভাবেই না উপস্থাপন করেছেন নিজের মনের অভিব্যক্তি। মহান আল্লাহ তাআলা তাকে নিজের রহমতে চাদরে ঢেকে নিন।
নেককারদের ভালোবাসি কিন্তু তাদের দলের নই, আশা রাখি শাফায়াত পেয়ে তাদের যোগ্য হই। ভয় পাই মনে গুনাহ অপরাধ, দোষ ত্রুটি হয় যত, যদিও আমরা সবাই সমান, দুনিয়ায় কাজে রত।
মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে আশা রাখি—তিনি যেন আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন। কিয়ামতের ময়দানে এটা যেন হয় আমার জন্য নাজাতের মাধ্যম। আমার আমলের পাল্লায় যেন হয় এটা সুসংবাদের উসিলা। যেদিন কারো মাল, ছেলে সন্তান তার কোনো উপকারে আসবে না, তবে যে ব্যক্তি পূতপবিত্র হৃদয় নিয়ে আসবে মহান আল্লাহ তাআলা তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও পুরস্কার দিবেন।
তার কাছে আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা, তিনি যেন এটাকে বিশেষভাবে তাঁর নিজের সন্তুষ্টির জন্য কবুল করে নেন। আল্লাহ—তিনি মহান দাতা ও মহাসম্মানিত। হৃদয় উজাড় করা সব প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য।
__________________________________________________
মানবীয় বৈশিষ্ট্যের প্রথম স্বভাবজাত চাহিদাই হলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত করা। মহীয়ান আল্লাহ বলেন,
وإذ أخذ ربك من بني آدم من ظهورهم ذريتهم وأشهدهم على أنفسهم ألست برتكم
قالوا بلى شهدنا
হে নবী, আপনি ঐ সময়কে স্মরণ করুন, যখন আপনার প্রতিপালক আদমের সন্তানদের থেকে তার ঔরসে থাকা অবস্থায় অঙ্গীকার নিলেন এবং তাদেরকে নিজের ব্যাপারে সাক্ষী রেখে বললেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বললো, হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক। আমরা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিলাম।
সুতরাং কুরআনুল কারীমের এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম, মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হলো, মহান আল্লাহ তাআলার দাসত্ব করা ও তার আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়া। আর এই আনুগত্য প্রকাশের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জীবন পরিচালনার জন্য রাসূলদের মাধ্যমে আমাদেরকে যে সকল দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নেওয়া।
মানুষের এই স্বভাবজাত চাহিদা নফসকে ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত করে। ফলাফলে হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মারেফাতের মতো মহাদৌলত। অন্তরে সৃষ্টি হয় আল্লাহর ভয়। হৃদয়ে বহুগুণে বেড়ে যায় সাওয়াবের আশা ও তাকওয়া। সকল ইবাদতে সৃষ্টি হয় ভিন্নধর্মী স্বাদ ও মজা। ইখলাস আর সততায় সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় মন। বিপদাপদে পায় ধৈর্যধারণের অসাধারণ শক্তি। হৃদয় ব্যাকুল হয় রবের ভালোবাসায়। বান্দার মাঝে দেখা যায় মনকে উদাসীনকারী সব জিনিস
1
সূরা আরাফ, আয়াত: ১৭২
থেকে নির্মুখিতা। ভিন্নধর্মী এই প্রক্রিয়াগুলোর কারণেই অন্তরে সৃষ্টি হয় অনন্য সেই নূর যাকে আমরা ব্যক্ত করি ঈমান ও ইয়াকীনের নামে। তাই প্রত্যেকের উচিত এই গুণ দুটো অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হলো, ইবাদত এবং আনুগত্য এত ব্যাপক দুটি জিনিস যেগুলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনেক বেশি পছন্দ করেন। এগুলোর স্তরে স্তরে মিশে আছে কল্যাণকর সব জিনিস এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের আমল।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবাদত একটি ব্যাপক জিনিসের নাম। মহান আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় প্রতিটি কাজকে ইবাদত বলা হয়। চাই সেটা কথা হোক বা কাজ, প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য, নামাজ হোক বা যাকাত, রোজা হোক বা হজ।
সত্য কথা বলা, আমানত আদায় করা, মা-বাবার সাথে ভালো আচরণ করা, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা, ওয়াদা পূর্ণ করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, কাফির ও মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ করা, প্রতিবেশীর সাথে ভালো আচরণ করা, এতিম-মিসকিন-পথচারীসহ নিজের গোলাম-গৃহপালিত পশুপাখি সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা, দোয়া-জিকির কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা—সবগুলো আমলই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
তেমনিভাবে মহান আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা, তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, ইখলাসের সাথে আমল করা, ধৈর্যের সাথে তাঁর আদেশ পালন করা, তাঁর নেয়ামতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, তাকদীরের ফয়সালায় খুশি থাকা, তাঁর ওপরই তাওয়াক্কুল করা, তাঁর রহমতের আশা রাখা, তাঁর আজাবকে ভয় করা—সবগুলোই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
ওপরের আলোচনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ-এর ভাষ্যমতে ইবাদতের পরিধি অনেক ব্যাপক। এর পরিসীমা অনেক বিস্তৃত। তার প্রদত্ত ব্যাখ্যা দ্বীনের প্রতিটি অংশকে নিজের মধ্যে শামিল করে। তার কথা অনুযায়ী আলোচিত প্রতিটি বস্তুই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হয়। চাই সেটা ইবাদত হোক বা নৈতিকতা, পারস্পরিক লেনদেন হোক বা অন্তর্জাতিক সম্পর্ক, চরিত্রগত হোক বা রাষ্ট্রীয় রাজনীতি—সবকিছুই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের মনে রাখা উচিত, ইসলামের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় রয়েছে মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দ্বীনের পুরোটাই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এর কারণ হলো দ্বীন নিজের মধ্যে ধারণ করে বিনয় ও তুচ্ছতার অর্থ। যেমন আরবিতে বলা হয় Blass অর্থাৎ আমি তাকে তুচ্ছ করলাম তাই সে অপমানিত হলো।
بدين الله او يدين الله
অর্থাৎ সে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করলো। তাঁর বিধিবিধান অনুসরণ করলো। তাঁর অনুগত হলো।
সুতরাং এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম, মহান আল্লাহ তাআলার দ্বীন মেনে চলার অর্থ হলো, তাঁর ইবাদত করা। তাঁর আনুগত্য করা। তাঁর প্রতি বিনয়াবনত থাকা। ইবাদতের আরেকটি অর্থ আছে। সেটা হলো, আমাদের আলোচিত দ্বীন শব্দটি অপদস্থতার অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ-এর ভাষ্যমতে আমরা যখন বুঝতে পারলাম, দ্বীনের পুরোটাই ইবাদত তখন এটাও বুঝতে পারলাম, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এই দ্বীন আমাদের জন্য এনেছে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। চাই সেটা জনসমাজে আমাদের অবস্থানের ব্যাপারে হোক বা অভ্যন্তরীণ জীবনে। পাশাপাশি এটা মসৃণ করে দিয়েছে আমাদের আধ্যাত্মিকতার পথ ও পারস্পরিক সম্পর্কগুলো।
আল্লাহপ্রদত্ত এই জীবনব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা এটাও জানতে পারলাম, মানুষের পুরো জীবনজুড়েই আছে ইবাদতের সীমা-পরিসীমা। ইসলামের মধ্যে আছে সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের নিজস্ব মতামত বা নিছক ধারণার মতো ইবাদত শুধু নামেমাত্র কিছু নামাজ, রোজা, হজের সাথে সম্পৃক্ত তিলাওয়াত-জিকির-দোয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আপনি একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, বাস্তবিকপক্ষে তাদের এই মনোভাব মানুষের সামনে তখনই স্পষ্ট হয় যখন তাদেরকে দ্বীনের পথে ডাকা হয়।
এই সাধারণ মানুষদের মতো আমাদের সমাজে আরও কিছু লোক এমনও আছে, যাদের ধারণা হলো— ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আদায় করতে পারলেই যেন সে মহান আল্লাহ তাআলার আনুগত্য পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছে। আদায় করেছে ইবাদতের পরিপূর্ণ হক্ব। অথচ তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, আত্মতৃপ্তিমূলক।
আমাদের একটা বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নিজস্ব অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্বীনের এই বড় বড় বুনিয়াদি জিনিস ও মূল বিষয়গুলো শরয়ি ইবাদতের একটি অংশমাত্র। এটা কখনোই পূর্ণাঙ্গ সেই ইবাদত নয় যেটা মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের থেকে কামনা করেন।
মূলকথা হলো, মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। এটাকেই তিনি জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বলে অভিহিত করেছেন। পৃথিবীর বুক মর্যাদা ও সম্মানের কারণ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون
আমি মানুষ ও জ্বীন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।
সূরা যারিয়াত, আয়াত : ৫৬
তিনি নিজের কিতাব পবিত্র কুরআনুল কারীমের এই আয়াতে পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের যে ব্যাপকতার কথা আলোচনা করেছেন সেটার পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। যা কি না গোটা জীবনের প্রতিটি শাখা-প্রশাখাকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে। বেষ্টন করে রাখে মানুষের ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি কাজ।
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ যখন আবদুল্লাহ আল-উমারি রাহিমাহুল্লাহ-এর নিকট চিঠি লিখেন, তখন এই বিষয়টাই তিনি সেখানে স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহিমাহুল্লাহ তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘তাহমিদ’ এর মধ্যে বলেন, আমি এই বর্ণনাটা এখানে নিজের স্মৃতিপট থেকে লিখছি। মূল পাণ্ডুলিপিটা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
একবার প্রসিদ্ধ আবিদ আবদুল্লাহ আল-উমারী রাহিমাহুল্লাহ ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ-কে একাকিত্ব অবলম্বন ও আমলের প্রতি উৎসাহ দিয়ে একটি চিঠি লিখেন। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ প্রতিউত্তরে লিখেন, ‘মনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সকলের মাঝে কাজ ভাগ করে দিয়েছেন যেভাবে ভাগ করেছেন প্রত্যেকের রিজিক। তাই কারো ভাগ্য খুলে যায় নামাজের মাধ্যমে কিন্তু রোজা রাখলে তার কল্যাণ হয় না। কারো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় দান-সাদকার মাধ্যমে কিন্তু রোজা রেখে সে উপকৃত হয় না। কারো কল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত হয় জিহাদের ময়দানে।
তাই আমি মনে করি, ইলমের সম্প্রসারণ সর্বশ্রেষ্ঠ আমলগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আর মহান আল্লাহ তাআলা আমার জন্য যেটাতে কল্যাণ রেখেছেন সেটাতেই আমি খুশি; আলহামদুলিল্লাহ। আমি এটা কল্পনাও করি না যে, তুমি আমার চেয়ে ভালো অবস্থানে আছো। তবে আমি আশাবাদী আমরা প্রত্যেকেই কল্যাণের পথে আছি; আলহামদুলিল্লাহ।’
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ মনে করতেন, মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনা ও আমলের স্তরভেদে অনেক পার্থক্য আছে। কাউকে বিশেষ কোনো ইবাদতের সুযোগ বেশি দেওয়া হয়। ফলাফলে সে দারুণভাবে এই কাজটা করতে পারে কিন্তু অন্য আমলে সে সফলতা লাভ করতে পারে না। আরেকজনকে এমন একটি আমলের তাওফীক দেওয়া হয় যা অন্যজনকে দেওয়া হয় না।
প্রত্যেকটি জিনিসের ব্যাপারে একই কথা। যতদিন পর্যন্ত সকলে শরীয়ত অনুযায়ী আমল করতে থাকবে, ততদিন শরীয়তের পক্ষ থেকে আমলের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই; বরং প্রত্যেকেই ভালো ও কল্যাণের পথে থাকবে।
বরেণ্য ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহিমাহুল্লাহ একবার মক্কায় বিখ্যাত আবিদ ফুজায়েল ইবনে ইয়াজ রাহিমাহুল্লাহ-এর কাছে একটি চিঠি পাঠান। তিনি তখন তরতুস শহরে রোমিও সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তাকে এটা সংবাদ দেওয়ার জন্য চিঠি প্রেরণ করেন যে, আমি জিহাদের ময়দানে যুদ্ধরত অবস্থায় যে সওয়াব অর্জন করছি সেটা কখনোই ফুজায়েল ইবনে ইয়াজের বাইতুল্লাহ শরীফে অবস্থান করে ইবাদতের চেয়ে বেশি হবে না বরং স্তরভেদে আমিই তার চেয়ে বেশি নেকীর অধিকারী হবো।
মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাফিনা রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহিমাহুল্লাহ ১৭৭ হিজরীতে আমার কাছে একটি চিঠি পাঠান। তিনি আমাকে সেটা তরতুসের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ফুজায়েল ইবনে ইয়াজের কাছে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে কবিতাকারে কিছু কথা লেখা ছিল। কবিতাটির কাব্যানুবাদ:
তোমাকে বলছি—হারামাইনে যে ইবাদতে মশগুল, আমাদের যদি দেখতে তাহলে ভাঙত তোমার ভুল। দেখো যদি কত সংগ্রামে কাটে মুজাহিদদের বেলা, বুঝতে তখন ইবাদত নামে করছো কেবলই খেলা।
প্রভুর প্রেমের অশ্রুতে ভিজে যায় তোমাদের গাল, আর আমাদের বুক প্রতিদিন তাজা খুনে ভিজে লাল। আতরের মনমাতানো সুবাসে তোমরা আকুল প্রাণ, আমাদের কাছে ঘোড়ার খুরের ধুলো থেকে আসে ঘ্রাণ।
আমাদের প্রিয় নবীজির বাণী আমরা শুনেছি এই যে বাণী নিরেট সত্য ও যাতে মিথ্যার লেশ নেই। আল্লাহর রাহে জিহাদের মাঠে নাকে ধুলো ঢুকে যার, জাহান্নামের গন্ধটুকুও পৌঁছবে না নাকে তার। তাছাড়া প্রভুর বাণী আমাদের বলে যায় আর ডাকে, শহীদি আত্মা মরে না কখনো চিরকাল বেঁচে থাকে।
আমি সেই চিঠিটা নিয়ে হারাম শরীফে ফুজায়েল ইবনে ইয়াজ রাহিমাহুল্লাহ এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি সেটা পড়ে অশ্রুসিক্ত হলেন। বললেন, আবূ আবদুর রহমান সত্য বলেছেন। আমাকে উত্তম উপদেশ দিয়েছেন।
ভাবুন একবারটি, আমাদের আকাবিরদের মহান দুজন ব্যক্তিত্ব ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহিমাহুল্লাহ কতটা স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে ইবাদতের বিষয়বস্তু স্পষ্ট করেছেন। তারা নিজেদের কথা ও বক্তব্য দিয়ে আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন, ইসলামে ইবাদত এমন একটি সার্বজনীন বিষয় যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের বিধিবিধানকে নিজের মধ্যে ধারণ করে।
ইসলামে ইবাদতের ব্যাপকতার প্রভাবে মানুষ নিজের ব্যক্তিজীবন ও আধ্যাত্মিকতায় অনন্য বরকতময়তা ও কল্যাণকর উপমা দেখতে পারে। সে নিজের মধ্যেও অনুভব করতে পারে দারুণ পবিত্রতা। অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে সৌন্দর্য। পরিপূর্ণ আস্থা ও সংযমের সাথে থাকলে সে নিজের আশপাশেও অনুভব করতে পারবে অভাবনীয় বরকতময় স্পর্শ ও রহমতের ছোঁয়া।