সালাফদের ফাতওয়াভীতি (pdf download no available)
লেখক : শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী
প্রকাশনী : বইপল্লি
বিষয় : ইসলামী জ্ঞান চর্চা, ফিকাহ ও ফতওয়া
অনুবাদ: ছানা উল্লাহ সিরাজী
পৃষ্ঠা ১৭৬
(পেপারব্যাক)
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আমাদের মাঝে সবচেয়ে উদাসীনতা কাজ করে ইলম অন্বেষণের ব্যাপারে। আমরা দ্বীন শেখার আগ্রহ পাই না। যা পড়ি, মর্জিমাফিক পড়ি। নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা আমাদের অনেকের পক্ষেই হয়ে উঠে না। একঘেয়েমি লাগে।
একটি সমাজ যখন ইলমশূন্য হয়ে পড়ে, অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেই সমাজে নানা রকম ফিতনাহ দেখা দেয়। সেই ফিতনাগুলোর ভিতর ভয়াবহ একটা ফিতনাহ হলো ‘ফাতওয়া’। স্বল্প কিংবা একদম শূন্য জ্ঞান নিয়ে নিজস্ব মত, অভিরুচি চাপিয়ে দেবার প্রবণতা। এভাবে সমাজে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা, দলাদলি আর কাঁদা ছড়াছড়ি।
অতীতের সালাফদের, অর্থাৎ নেককার পূর্বসূরিদের আর আমাদের মাঝে পার্থক্য এখানেই। তাঁরা সাগর পরিমাণ ইলম থাকা সত্ত্বেও এক ফোঁটা পানি নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন, আর আমরা এক ফোঁটা পরিমাণ কিংবা তার চেয়েও কম শিখে সাগরের পর সাগর পারি দিয়ে ফেলি
শায়খুল ইসলাম মুফতি তকি উসমানী হাফি. বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি আমাদের জন্যই লিখেছেন। এতে তিনি সালাফদের জীবনী থেকে এমন সব মণিমুক্তো তুলে ধরেছেন, যা পাঠকের মনে লাগাম পড়াবে। যত্রতত্র ফাতওয়া, ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা দেবার মানসিকতা থেকে ফিরিয়ে আনবে। এছাড়া তিনি আলোচনা করেছেন একজন যোগ্য মুফতির পরিচয়, গুণাবলী। যেন আমরা ইলমে দ্বীন শেখার জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে নিতে পারি এবং ফিতনাহ ফাসাদ থেকে বেঁচে থাকি।
একই বিষয়ে একাধিক মাযহাব মানার হুকুম
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, একটি মাসআলায় দুটো মাযহাব এমনভাবে গ্রহণ করা যাতে এমন যৌগিক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা কোনো মাযহাবেই বৈধ নয় এমনটিকে তালফিক বলে। যেমন, মহিলাকে স্পর্শ করার ক্ষেত্রে ওযু না ভাঙ্গার ব্যাপারে হানাফী মাযহাব গ্রহণ করল এবং প্রবাহিত রক্তের ক্ষেত্রে ওযু না ভাঙ্গার ব্যাপারে শাফেয়ী মাযহাব গ্রহণ করল। আর সে মহিলাকে স্পর্শ করার পর রক্ত প্রবাহিত হওয়া অবস্থায়ই নামাজ আদায় করছে। তার এ নামাজটি কোনো মাযহাব অনুসারেই সঠিক হবে না।
আল্লামা কারাফী মালেকী রহ. বলেন,
কোনো মাসআলায় এক মাযহাব থেকে অন্য মাযহাবে স্থানান্তরকে বৈধতা দানের ক্ষেত্রে মুফতি সাহেবের জন্য আবশ্যক হলো, যে বিষয়ে ফাতওয়া দেয়া হচ্ছে, তাতে বিচক্ষণতার সঙ্গে লক্ষ করবে; প্রত্যাবর্তিত মাযহাবে তা প্রত্যাখ্যানকারী কিছু আছে কি না? যেমন, কোনো শাফেয়ী মুফতি সাহেব মালেকী মাযহাব থেকে শাফেয়ী মাযহাবে প্রত্যাবর্তনের বৈধতা প্রদান করলে তাকে মালেকী মাযহাবের অনুসারীর জন্য গোসলে ‘শরীর মলা’ পরিহার করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে, তখন তার বৈধতা না দেয়াটা তার জন্য অবধারিত হয়ে যায়।
কেননা মালেকী মাযহাবের অনুসারীর নামাজটি উভয় ইমামের ঐকমত্যে বাতিল হয়ে যাবে। কারণ মালেকী মাযহাবের অনুসারী গোসলে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করে না। ফলে ‘শরীর মলা’ পরিহারের কারণে ইমাম মালেক রহ. নামাজটিকে বাতিল বলে গণ্য করেন; আর ইমাম শাফেয়ী রহ. বাতিল বলেন বিসমিল্লাহ পরিহার করার কারণে। একবার আমি শুকরের পশমের সাহায্যে সেলাইকৃত মোজার ক্ষেত্রে ওযু সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম যে, সেলাইকৃত অংশের সঙ্গে মিলিত পানিসহ নামাজটি সহিহ হবে কি? প্রশ্নকারী ছিল শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী।
আমি তাকে বললাম, মালেকী মাযহাবে শুকরের পশম পবিত্র। তবে তুমি তো শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। মাথার কিছু অংশ মাসাহ করে থাক। সুতরাং তোমার নামাজ বাতিল হওয়ার ক্ষেত্রে উভয় ইমাম একমত। ইমাম মালেক রহ.-এর নিকট ‘পূর্ণ মাথা মাসাহ না করার কারণে’, আর শাফেয়ী রহ.-এর নিকট ‘শুকরের পশম নাপাক হওয়ার কারণে’। এজাতীয় মাসআলার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার প্রয়োজন। কেননা এগুলো অধিকহারে সংঘটিত হয়ে থাকে।
বিতর্কিত এই তালফিক বৈধ হওয়া না হওয়ার বিষয়ে ব্যাপাক মতানৈক্য রয়েছে।
তবে ইবনু আমির হাজ রহ. মাযহাবের রুখসত অন্বেষণকারীর ফাসেক হওয়ার বিষয়টি তালফিকে লিপ্ত ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করেছেন এবং রুওয়াইনি রহ.-এর ভাষ্যের মাধ্যমে তালফিকের নিষিদ্ধতা শক্তিশালী করেছেন। তারপর এমন কোনো বক্তব্য নিয়ে আসেননি যা তার সঙ্গে একমত পোষণ বোঝায়। অতএব, এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তাদের প্রতি বৈধতার সম্বন্ধের বিষয়টি অস্পষ্ট।
ইবনু নুজাইম রহ. ফাতাওয়া বাযযাযিয়া থেকে যা উল্লেখ করেছেন তা তালফিকের বৈধতা বোঝায়।
তিনি বলেন, ইবনু হুমাম রহ.-এর লিখনির শেষাংশে তালফিক নিষিদ্ধ হওয়ার যে অভিমতটি উল্লেখ রয়েছে তা কেবল কতিপয় ওলামায়ে মুতাআখখিরিনের প্রতি সম্বন্ধ করা হয়েছে। এর ওপর মাযহাবের ফাতওয়া নয়।
শায়খ তাকি উসমানী হাফি. বলেন, আমার নিকট তালফিক নিষিদ্ধ হওয়াটাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত অভিমত বলে মনে হয়। আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জ্ঞাত। কেননা এ কথা সর্বজন-বিদিত যে, মাযহাবসমূহ নিয়ে ইচ্ছেমতো খেল তামাশা করা প্রবৃত্তির অনুসরণ। আর এটা কুরআনে কারিম দ্বারা নিষিদ্ধ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَاحْكُمْ بَیْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الْهَوٰی فَیُضِلَّكَ عَنْ سَبِیْلِ اللّٰهِ اِنَّ الَّذِیْنَ یَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِیْلِ اللّٰهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِیْدٌۢ بِمَا نَسُوْا یَوْمَ الْحِسَابِ.
অর্থ : অতএব, তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায় সঙ্গতভাবে ফায়সালা করো, খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহ তাআলার পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ তাআলার পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা হিসাব দিবসকে ভুলে যায়।
এখন যদি তালফিকের পথটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তা প্রবৃত্তির অনুসরণের দিকে নিয়ে যাবে এবং শরিয়তের গন্ডি থেকে বের করে দেবে। তবে নিষিদ্ধ তালফিক হলো, কোনো মানুষ একটি মাসআলায় দুটো মাযহাবকে এমনভাবে গ্রহণ করা যাতে এমন যৌগিক অবস্থার সৃষ্টি হয়; বিশেষত কেউই সেক্ষেত্রে এর বৈধতা দেন না।