সন্ধ্যাফুল, লেখক : এহসানুল্লাহ জাহাঙ্গীর | Shondhaful By Ehsanullah Jahangir

সন্ধ্যাফুল
লেখক : এহসানুল্লাহ জাহাঙ্গীর
প্রকাশনী : নবপ্রকাশ
বিষয় : সমকালীন উপন্যাস
পৃষ্ঠা : 120
ভাষা : বাংলা

Image

সাপ্লায়ার জানিয়েছেন এই পণ্যটি 28 February প্রকাশিত হতে পারে। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পণ্যটি পেতে আগেই অর্ডার করে রাখুন ।

                    Read Before Buy Shondhaful
উপন্যাসের সাথে যদি চিন্তা-দর্শন ও আদর্শের মিশ্রণ ঘটানো যায় তাহলে কেমন হয়?
নবন লেখক এহসানুল্লাহ জাহাঙ্গীর সে কাজটিই করেছেন তার রচিত প্রথম গ্রন্থ সন্ধ্যাফুল উপন্যাসে।
এই উপন্যাসটি ছোট হলেও মূলত উপন্যাসের প্রচলিত ধারাকে ভাঙ্গার একটি মহৎ প্রয়াস।

আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পারি, প্রতিটি উপন্যাসে প্রধান শক্তি হিসেবে পাওয়া যায়—চরিত্রের রসায়নে গভীর জীবনবোধ, জীবনের বিস্ময়-বিস্তৃতি, হৃদয় ও স্বপ্ন ভাঙার মর্মর আওয়াজ, তীব্র ভাবাবেগ, সামাজিক টানাপোড়েন এবং মৈত্রীবাঁধন। কখনো পাই, বিকশিত জীবনের শৈল্পিক ক্যানভাস, বিশুদ্ধ স্নিগ্ধতায় মুখর প্রেমের মহরত, প্রকৃতির কীর্তনখেলার নান্দনিক পাঠ, সাম্য-মানবিকতার সৌন্দর্য। ‘সন্ধ্যাফুল’ উপন্যাসে আমরা এগুলোর সাথে সাথে নতুন কিছু দেওয়ার কোশেশ করেছি। যেটা একজন পাঠকের স্থায়ী উপকারের মধ্যে গণ্য হবে বলে আশা রাখি।

উপন্যাস মানেই যে শুধু সাময়িক একটা ঘোর। আমরা এই বোধ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সন্নিবেশ ঘটিয়েছি উপন্যাসটিতে।

সন্ধ্যাফুল ১
আষাঢ় মাসের নির্মল নীল আকাশ। গতকাল রাতেও দমফাটা বৃষ্টি হয়েছে। এজন্য পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের ব্যস্ত ওড়াউড়ি নেই। বাতাসের তোড়ে কোনো কিছু ভেসে চলার তাড়া নেই। আকাশজুড়ে শুধু নীল আর নীল। পুরো আকাশটা যেন স্বচ্ছ স্ফটিক। কবিতা-গল্পে যেটাকে বলা হয় ‘সুনীল আকাশ’। বৃষ্টির কারণে ধানখেত থেকে জল উপচে পড়ছে। জলধারা ছুটে চলছে দড়িছেঁড়া গরুর মতন। জল নামার কলকল ধ্বনি। কোথাও আবার ভুরভুর শব্দ করছে। খালের পানি উজান থেকে ঈষৎ বেগে ছুটে চলছে ভাটির দিকে। অনেকেই টাকজাল পেতেছে। টানে টানে দুচারটে টেংড়া, পুঁটি, চাঁদা, মলা কিংবা অন্য কোনো ছোটো মাছ উঠছে। এতেই তারা খুশি। প্রতি টানেই মুখে ছড়িয়ে পড়ছে দিলখোলা প্রাণবন্ত হাসি। কেউ কেউ সেই ফজরের নামাজ পড়েই চলে এসেছে। খালের পাড়ের মৃদুমন্দ বাতাসে হৃদয় জুড়িয়ে নিচ্ছে। শরীরে বুলিয়ে দিচ্ছে পবিত্রতার শীতল পরশ।
ধান সেই কবেই কাটা হয়েছে। এই সময়টাই ধানখেতগুলো শূন্য পড়ে থাকে। পানির জন্য জমি খালি রেখে দেওয়া হয়। বৃষ্টির পানিতে জমি উর্বর হয়। এ সময় আশপাশের গ্রামগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। মনে হয় যেন একটু সামনে এগিয়ে আকাশটা ঘন গাছপালার সাথে মিশে গেছে। এদিকে ক্ষেতের আল উপচে পানি বিলে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে। হলুদাভ বড় বড় ব্যাঙগুলো কেমন সুর করে গান গাইছে। এই গান বোধহয় আনন্দের। মুক্ত জীবনের মুখর পরিবেশের। নিজেদের জন্য প্রশস্ত বাসস্থান পাওয়ার। প্রকৃতিও এই সময়টাই আনন্দে ফেটে পড়ে। ছত্রে ছত্রে মেলে ধরে সৌন্দর্যের রাশি রাশি বিস্ময়রত্ন। যেন এখানে ছড়িয়ে পড়েছে জসীমউদ্দীনের ‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতার বৈচিত্র্যময় চিত্র।
আজিকের রোেদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাটে-মেঘের আড়ে, কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে। কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝঝুম নিরালায়, ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়, সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়। কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া! হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি, নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি! চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে, না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
রাস্তাঘাট ঝুমবৃষ্টির কারণে ঝকঝকে তকতকে হয়ে আছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট কাঁদা হলেও প্রবল বর্ষণে বরং রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন হয়। মাটির সরু রাস্তাগুলোকে তখন বড় বিচিত্র লাগে। বালু চিকচিক করে। রাস্তার পাশের ঘাসগুলো বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে কেমন সজীব হয়ে ওঠে। এই সময়টাই হাম্মাদদের গ্রামটা কেমন ছবির মতো লাগে! আজীবনের পরিচিত বোধ হয়। নাড়ির সাথে বাড়ির টানটা তখন আরও গভীর থেকে গভীর মনে হয়। তবুও এমন আনন্দমুখর সময়টায় হাম্মাদের যেতে হয়। গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায়। হাম্মাদ ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জের এক পাড়াগাঁয়ের ছেলে। কিন্তু জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে শহরে। স্কুল জীবনটা গ্রামে ছেলেবেলার দুরন্তপনায় কাটলেও কলেজ জীবন থেকেই সেই শহরে। প্রথমে ময়মনসিংহ শহরে কিছুদিন থাকলেও সবশেষে ঢাকাই হয়ে ওঠে আশ্রয়। পড়াশোনা শেষে সেখানেই হয় কর্মস্থল। মিশে যায় শহুরে জীবনের সাথে। সাগরের সাথে নদীর মিলে যাওয়ার মতো।
এক অফিসে কিছুদিন হলো একটা জব করছে। গত কয়েকদিন আগে গ্রামে বেড়াতে এসেছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে ছুটিটা বেশ উপভোগ্যই হয়েছে। হাম্মাদরা তিন ভাই এক বোন। হাম্মাদ সবার বড়। বড় হিসেবে পরিবার গোছানোর যেমন চিন্তা আছে, বিয়ে করে ঘরে বউ আনার চাপও আছে। হাম্মাদ কম বয়সে বিয়ের পক্ষপাতী হলেও পরিবারের কথা চিন্তা করে তা আর সম্ভব হয়নি। গ্রামের এসব রুসুম রেওয়াজ যে কবে দূর হবে! মেয়ের বয়স বার চৌদ্দ হলেই বিয়ের চিন্তা মাথায় কিলবিল করে। 
কিন্তু ছেলের বয়স বিশ হয়ে গেলেও ভাবা হয় এখনো বাচ্চা ছেলেটিই রয়ে গেছে! এ কেমন দ্বিচারিতা! হাম্মাদ মনে মনে ভাবে, ছেলেদেরও বিশ্বের মধ্যেই বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু কে শুনে কার কথা! এদেশে প্রেমের সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত না হলেও, বিয়ের কথা আসলে ঠিকই বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে কিনা, ছেলে চাকরি করে কিনা, প্রতিষ্ঠিত কি-না আরও কত কী খিস্তিখেউর! একটা ছেলে একক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে দুজন মিলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টাটা যে আরও জোরদার এবং ফলপ্রসূ হয়, সেটা এই মানুষগুলোকে কে বোঝাবে?
হাম্মাদ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করলেও এখন সারাদিন হিশেব নিকেশ নিয়েই পড়ে থাকতে হয়। জেনারেল সাইটের অধিকাংশ মানুষের জীবনটাই এমন। যা নিয়ে পড়াশোনা করে কর্মজীবনে আর তার কোনো হদিসই থাকে না। কোথায় থাকে সে আর কোথায় থাকে পড়ার বিষয়, বাকি জীবনে সেটা ভাববারই অবকাশ পায় না। তবে হাম্মাদ একটু ভিন্নরকম মানুষ। বিষয়টি তার বড্ড পছন্দের। তাই সুযোগ পেলেই ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে। মানুষের সাথে আলোচনা করে। এমনকি নাস্তিকদের সাথে বিতর্কেও হাম্মাদের জুড়ি মেলা ভার!
সন্ধ্যাফুল ২
ময়মনসিংহ থেকে হাম্মাদ ঢাকাগামী একটা ট্রেনে চড়ে বসে। ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ময়মনসিংহ স্টেশন ছেড়ে যাবে। মানুষের ব্যস্ত পদচারণা। ট্রেনের হুইসেল শুনে ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেল কয়েকগুণ। কেউ কেউ স্বজনদের বিদায় জানাতে এসেছে। তাদের দেখলেই বোঝা যায়। করুণ চোখে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ এসেছে প্রিয় মানুষকে এগিয়ে নিতে। ওরা এদিক ওদিক কেমন ছটফট করতে থাকে। ঐ বুঝি এল! কেউ মোবাইল হারায়। কেউ হারায় টাকার মানিব্যাগটা। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির এতশত হিশেব কে জানে! এমন কত ঘটনার সাক্ষীই তো হয়ে থাকে একেকটা স্টেশন। সেসব কেউ জানে না। কেউ দেখে না।
ঢাকাগামী ট্রেন শেষ হুইসেল বাজিয়ে নড়তে শুরু করেছে। মানুষ হুড়মুড় করে উঠছে। কিছু মানুষ আছে প্রয়োজন ছাড়াই প্রতিটি স্টেশনে নামবে। আবার উঠবে হুইসেল শোনার পর। ভিড় ঠেলে উঠতে গিয়ে হাঁপাতে থাকবে। কিন্তু পরের স্টেশনে আবার এই কাজটি করবে। মানুষ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। শেষ দেখা দেখে নিচ্ছে প্রিয় শহরটাকে। হাম্মাদ বসে থেকে বাড়ির ঘটনাগুলো মনে মনে আউড়ে যাচ্ছে। একটা মানুষই কি আর এক জীবনে কম ঘটনার সাক্ষী হয়! হাম্মাদ স্মৃতির উঠোনে মোমবাতি জ্বালায়। ছোটবোন উমামার কথা মনে পড়লেই বুকটা কেমন টনটন করে ব্যথায়। দেখতে ঠিক পরীর মতো। বয়স তো দশের কোটায়! এখনো সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখার অভ্যাসটা গেল না। হাম্মাদ কত শক্ত কথা শোনায়। শেষে নিজেরই কষ্ট লাগে। কিন্তু ও পরক্ষণেই ভুলে যায়।
হাম্মাদ তার বোনের এই বয়সেও এমন দুষ্টুমি দেখে মনে পড়ে ঐ ছয় বছরের ছোট্ট উমামাকে। চাঁদের মতো ছোট্ট মায়াবী মুখটা। সারাক্ষণ কেমন চঞ্চলতায় মেতে থাকত। এজন্য হাম্মাদ আদর করে ওর নাম দিয়েছিল চপলা। চপলা বলেই ডাকত।
হাম্মাদ যখন বাড়ি থেকে চলে যেতে প্রস্তুত হতো কীভাবে যেন বুঝে যেত। সে কী কান্না! সাথে যাওয়ার জন্য কেমন অদ্ভুত বায়না। ওর কান্না দেখে শেষে হাম্মাদ নিজেও কেঁদে দিতো। এখনো তো কাঁদে। আড়ালে আবডালে এখনো কম কাঁদে না। হাম্মাদের মাঝেমধ্যেই মনে হয় মা-বাবার পর উমামার মতো ভালো আর কেউ তাকে বাসে না। আসলে বোনেরা এমনই হয়। ভাই যেন ওদের জীবন। সত্যিই এরা কলজের ধন। নিজের অজান্তেই হাম্মাদের চোখে জল আসে। টিস্যু দিয়ে মুছতে গিয়ে যেন লজ্জা পেয়ে যায়। ভাবনার আগুন কতকিছুই তো পুড়িয়ে দিলো। কতো কাণ্ডই তো ঘটাল। আশেপাশের লোকজন বোধ হয় দেখেছে। হাম্মাদ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ল।
হাম্মাদ যে সিটে বসেছে, তার সোজা সামনেই এক মেয়ে বসা। মাঝেমধ্যেই বড় বড় চোখ করে হাম্মাদের দিকে তাকাচ্ছে। অবশ্য নারী বলার তেমন কোনো কারণ নেই। আদতে নারী হলেও বেশভূষায় পুরুষের আদল। চুলগুলো ছোটো ছোটো করে কাটা। পরনে প্যান্ট-শার্ট। অল্পবয়সি এই নারীটি যেন পুরুষ থেকেও বেশি চটপটে। বয়েস খুব বেশি হলে বাইশ-তেইশ হবে। তবে চঞ্চলতায় কেমন কিশোরীদের মতো। চলাফেরায় পুরুষালি আচরণ। গলাটাও উচ্ছ্বাসে উচ্চারণে যেন গমগম করে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আশপাশটায় একটা ছোটোখাটো গল্পের আসর বানিয়ে ফেলেছে।
হাম্মাদ জানালা দিয়ে ঘাসের সবুজ শামিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন আরামে আহ্লাদে মায়ের কোলে শুয়ে আছে ছোট্ট শিশু। কোথাও দেখা যায় পানির ছোট্ট ডোবা। পুকুর ভরে আছে টলটলে জলে। শূন্য ধানখেতে পানি জমে আছে। কোথাও চোখে পড়ে মাছ চাষের জন্য লাগোয়া অনেক পুকুর। সারি সারি গাছ সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়েছে যেন। কলাগাছের ঘন জটলা। দাঁড়িয়ে আছে মাটি আঁকড়ে। আরও কত নাম না জানা গাছের সারি। কত লতাপাতার ঝোঁপঝাড়। নিমিষেই হারিয়ে যাচ্ছে চোখের উপর দিয়ে। আসমান নুয়ে আছে জমিনের উপর। দিগন্তে গিয়ে মিশেছে মাটির সাথে। জমিন ঘুমিয়ে আছে পানির উপর। হাম্মাদ গভীর বিস্ময়ে লক্ষ করে আল্লাহর সৃষ্টির কারিশমা!

অবিশ্বাসের জবানবন্দী …….

অল্প সময়ের ব্যবধানে মেয়েটি গল্পের মোড় সুকৌশলে নাস্তিক্যবাদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। হাম্মাদ এবার সাবধান হয়ে ওঠে। আরিফা জেসমিন যূথী। একজন বিখ্যাত নারীবাদী লেখিকা এবং প্রতিষ্ঠিত এক সংগঠনের কর্মী। কথায় গল্পে তার ভরপুর বিস্ময়। কী অনায়াসে দিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাসের জবানবন্দী! মাঝেমধ্যে কারো থেকে দু-একটা প্রশ্ন আসলেও যূথী এর সন্তোষজনক উত্তর দিচ্ছে। এগুলো বিজ্ঞান থেকে উত্তর খুঁজে নিচ্ছে। মানুষ রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে শুনছে তার কথাগুলো। কথায় যেমন আকৃষ্ট করছে চেহারাও যেন টানে সমানভাবে। রূপ-সৌন্দর্য যেকোনো পুরুষকে কাবু করার মতো। না, হাম্মাদ আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না। চোখের সামনে এভাবে এতগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে, এজন্য কি হাম্মাদ আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবে না? তবুও হাম্মাদ বুঝে উঠতে পারে না।

হাম্মাদও সহজেই মিশে যেতে পারে মানুষের সাথে। মানুষকে অল্প সময়ের ব্যবধানে আপন করে নেওয়ার কৌশলে সে বেজায় পাকা। তবে সাধারণত হাম্মাদ কথা বলে খুব কম। সে আস্তে করে ঢুকে যায় সকলের গল্পের মাঝে। যূথী যেন এই প্রতীক্ষাই করছিল এতক্ষণ। একটা মিষ্টি হাসিতে আপন করে নিতে চাইল হাম্মাদকে। যূথী জানে না, হাম্মাদও যুক্তিতে বেশ পাকা! জীবনে অনেক নাস্তিকদের সে কুপোকাত করে ছেড়েছে।
হাম্মাদ বলে, আচ্ছা, বিবর্তনবাদের পক্ষে আজ পর্যন্ত কেউ কি কোনো শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করতে পেরেছে? আমি কিন্তু পাইনি। আপনার জানা থাকলে আমাকে বললে আমি খুশি হতাম।
যূথী এমন অযাচিত প্রশ্নে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। ধার্মিক টাইপের মানুষ থেকে এমন সাহসী প্রশ্নের আশা করেনি যূথী। তবে যূথী হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়। একটু চুপ থেকে সে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে, আচ্ছা, আপনি বিবর্তনবাদ নিয়ে কী জানেন? বা আপনার জানাশোনা কতটুকু বলুন তো!
হাম্মাদ একনাগাড়ে বলে যেতে লাগল, আসলে বিবর্তনবাদ হলো, ধর্মে অবিশ্বাসী কিছু বিজ্ঞানীর বানানো মনগড়া একটা ব্যাখ্যা। আদম (আঃ) আদিমানব; এই মতবাদ, এই সৃষ্টিতত্ত্বকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতেই বিজ্ঞানে বিবর্তনবাদের এমন অনৈতিক প্রশ্রয়। এজন্যই তো একজন বিজ্ঞানীর সর্বপ্রথম অন্ধভাবে ডারউনের বিবর্তনবাদকে মেনে নিতে হয়। নয়তো তার সমস্ত গবেষণা ছুড়ে ফেলা হয়। বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের গবেষণার ফসল আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এই ঘটনা নিশ্চয়ই জানেন, বিখ্যাত জীবাশ্মবিদ গুন্টার বেকলি যখন অনেক গবেষণার পর বিবর্তনবাদের কথিত প্রমাণাদির ওপর সন্দেহ করতে থাকেন। এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, এই রকমভাবে এলোপাথাড়ি বিবর্তনের প্রস্তাবিত কোন পদ্ধতিই বিবর্তনের প্রমাণাদি হিসেবে যথাযথ নয়। 
তখন তাকে নাই করে দেওয়া হয়। হ্যাঁ, নাই-ই বলব। প্রথমে তাকে মিউজিয়ামের কিউরেটর পদ থেকে কোনো উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া অপসারণ করা হয়। আর এদিকে উইকিপিডিয়ার মতো তথাকথিত নিরপেক্ষ অনলাইন বিশ্বকোষ থেকে থেকে তার সমস্ত অবদান মুছে ফেলা হয়। এভাবেই কোণঠাসা করা হয় বিবর্তনবাদের বিপক্ষে নাক সিঁটকালে। ইউটিউবে ‘Expelled: No intelligence allowed’ লেখে সার্চ দিলেই দেখতে পারবেন একটা দারুণ ডকুমেন্টারি। দেখতে পারবেন নাস্তিক বস্তুবাদী বিবর্তনবাদীরা বিবর্তনবাদ বিরোধীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে। আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন এরা স্পষ্ট কারচুপি করে যাচ্ছে অথচ কী অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস দেখায়।
এতটুকু বলে হাম্মাদ একটু থামে। এতক্ষণ যে সমস্ত দর্শক তৃপ্তির ঢেকুর তুলে যূথীর বক্তব্য শুনে যাচ্ছিল এদেরও চোখেমুখে কেমন ঘোরলাগা ভাব। ওরা বুঝতে পারছে না কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক! কারটা মানবে কারটা প্রত্যাখ্যান করবে। তবে এটা ঠিকই বুঝতে পারছে, পূর্বে বলা যূথীর বক্তব্যগুলো এর তুলনায় যেন চুপসানো বেলুন। কারো মুখেই রা নেই। নিথর নীরবতা নেমে এসেছে এই কামরাটিতে। যূথীর ফর্সা মুখটা লালচে আভা ছড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই প্রচন্ড গতিতে বাতাস বইছে। এতক্ষণের ভ্যাপসা গরম ভাবটা কাটতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ ধরেই সবকিছু কেমন ঝিম মেরে ছিল। 
গুমোট আবহাওয়ায় সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। বৃষ্টির পূর্বাভাস। সবকিছুতেই কেমন থমথমে ভাব বিরাজ করছে। যূথীর ঘর্মাক্ত চেহারাটা শুকিয়ে অদ্ভুত মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। হাম্মাদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাতাস সবকিছু ধুয়ে নিচ্ছে। দৃষ্টিতে আকাশ ছুঁয়ে দেয়। আবছা আলোয় পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকাশ। আচ্ছাদিত মেঘমালায় কী দারুণ লাগছে আকাশটাকে। হাওয়ার তোড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোপ ছোপ মেঘ। পাখিদের মতো ব্যস্ত ওড়াউড়ি। আকাশে কেমন সাজ সাজ রব। হাম্মাদের মনের কানে বেজে ওঠে, সুরা আর রহমানের একটি আয়াত। ‘অতঃপর তোমরা জ্বীন ও ইনসান তোমাদের প্রভুর কোন কোন নিদর্শনকে অস্বীকার করবে??
হাম্মাদের মনে হয়, বর্ষাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে না আজ বহুদিন। আজ বহুবছর বর্ষায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় না। তবুও বেঁচে আছে। মানুষ বেঁচে থাকে। তবুও বেঁচে আছে স্মৃতির উঠোনে একগাদা মোমবাতি জ্বেলে। শৈশবের একফোঁটা রোদ্দুরে একটু ঝলকানিতেই আজও বেঁচে আছে। একটু ভাবনার আগুনে পুড়েই কেমন আনমনা হয়ে যায় হাম্মাদ। ভাবতেই চোখের পাতায় চুমু খায় শৈশবের বর্ষামুখর দিনগুলি।
ছোটবেলা থেকেই হাম্মাদ খেলায় ছিল ভীষণ পাকা। বিশেষত ফুটবলে হাম্মাদের জুড়ি মেলা ভার। বর্ষার বিশাল বিশাল মেঘখণ্ড হাম্মাদদের দীর্ঘসময় ফুটবল খেলার স্বপ্ন নিয়ে উঁকি দিতো। বিশাল ধানখেতকে মাঠ বানিয়ে চলত ফুটবল খেলা। আলপথ ছিল সীমানা। বৃষ্টির তোড় হাম্মাদদের খেলায় যোগ করত ভিন্ন মাত্রা। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে সৃষ্টি করত এক অন্যরকম ভালোলাগা। উদোম শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা যেন বন্দুকের গুলির মতো গেঁথে যায়। সেদিকে কারো খেয়াল থাকত না। একসময় পানি ও দীর্ঘ সময় খেলার কারণে বল আর চলত না। বৃষ্টির পানিতে খেত উপচে যেত। তবুও ওদের খেলার আশ যেন মিটত না। বাড়ি ফেরার টানও অনুভব করত না। কিন্তু সবশেষে ক্লান্তিতে, অবসাদে নেতিয়ে পড়ত। শৈশবে বৃষ্টি এলেই হাম্মাদের স্কুলযাত্রার প্রমাদ গুনত। সুর করে গাইত ফররুখ আহমদের ‘বৃষ্টির ছড়া’।
বিষ্টি এল কাশ বনে জাগল সাড়া ঘাস বনে, বকের সারি কোথা রে লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে৷ নদীতে নাই খেয়া যে, ডাকল দূরে দেয়া যে, কোন সে বনের আড়ালে ফুটল আবার কেয়া যে৷ গাঁয়ের নামটি হাটখোলা, বিষ্টি বাদল দেয় দোলা, রাখাল ছেলে মেঘ দেখে, যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা। মেঘের আঁধার মন টানে, যায় সে ছুটে কোন খানে, আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে আমন ধানের দেশ পানে।
বই-খাতা রেখে পরক্ষণেই খালে-বিলে ঝাঁপিয়ে পড়ত। একের পর এক ডুবের মহরত চলতেই থাকত। একসময় চোখমুখ লাল হয়ে যেত। জ্বালাপোড়া শুরু হতো। তবুও যেন নিস্তার নেই। এদিকে টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দে রিনরিনে একটা তান উঠত। শুনে মনেপ্রাণে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যেত। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন এক একটা বিস্ময়। শরীরে লাগলেই পশম দাঁড়িয়ে যায়। মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। বর্ষার দিনগুলোতে টানা বর্ষণে বাড়ির পাশ দিয়ে কলকলিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট খালটা পানিতে উপচে যেত। খাল ভরে পার্শ্ববর্তী ফসলের খেত পানিতে টলমল করত। বড় বড় হলুদাভ ব্যাঙের আনন্দমিছিলে মন আঁকুপাঁকু করে উঠত। তখন যেন হাম্মাদ ও তার সঙ্গীদের আনন্দ আর ধরত না। 
কী থেকে কী করে ফেলে এ নিয়ে বাড়ির মুরুবিবরা বেশ টেনশনে থাকতেন। কার বাঁশের কঞ্চিটা কেটে ফেলে; কার কলার ছড়িওয়ালা কলাগাছটা কেটে ফেলে; কে জানে! খাল উপচে পড়া স্বচ্ছ টলটলে পানি দেখলেই ওদের মাথায় ভেলা বানানোর ভূত চাপত। কার কলাগাছে ওদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে এটাই ছিল ভয়ের কথা। সেই সময়টাই ওরা নাওয়া-খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যেত। তখন হাম্মাদ আর ওর বাল্যসঙ্গীদের দেখে জলের কোন প্রাণী ভ্রম হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। সামান্য একটা হাফপ্যান্ট নাভির নিচে জড়িয়ে চলত ওদের যতসব দুরন্তপনা। হাফপ্যান্ট একসময় নেতিয়ে পড়ত তবুও ওদের যেন ক্লান্তি নেই। ওদের যেন অবসাদ নেই।
স্কুল থেকে ফেরার পথে যদি কোনোদিন হাম্মাদকে বৃষ্টি পেয়ে বসত সেই দুর্ভোগের সময়টা হতো ওর কাছে আরও বেশি উপভোগ্য। পলিথিনে বইখাতা মুড়িয়ে ভিজতে ভিজতে বাড়িতে ফিরত। আর রাস্তায় ঘটাত সব অদ্ভুত কাণ্ড। একদিনের কথা এখনো ওর বেশ মনে পড়ে। স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি নামে। হাম্মাদের বাড়ি থেকে প্রাইমারি স্কুলটা অনেক দূরে। পথিমধ্যে অনেক ফিশারি পড়ে। বৃষ্টিতে কই মাছ পানি থেকে উঠে আসে সেই কথা জানত হাম্মাদ। কিন্তু সেদিন কই মাছের পার্শ্ব গুটিয়ে দিব্যি হাঁটাহাঁটি চর্মচক্ষে দেখে অবাক হলো খুব। শুধু আবাক হয়েই ক্ষান্ত হলো না, শার্ট আর প্যান্টের পকেটে ঝটপট ভরতে লাগল। একটা ভরে তো আরেকটা ছুটে যায়। কী যে ত্যাঁদড় এক মাছ কই! তবুও সেদিন ছয় সাতটা কই নিয়েই তবে বাড়ি ফিরেছিল হাম্মাদ। বৃষ্টিতে পথঘাট পিচ্ছিল করার ভূতটাও তখন মাথায় কম চাপেনি। মানুষকে ধপাস করে ফেলতে পেরে ছেলেমানুষি আনন্দে লাফিয়ে উঠত হাম্মাদ আর ওর বন্ধুরা। কখনো তো মাটি পিচ্ছিল করতে গিয়ে নিজের হাফপ্যান্ট ছিঁড়ে নিতম্বের ছাল তুলে ফেলত। কী আশ্চর্য আনন্দ আর অদ্ভুত কলহাস্যে মেতে উঠেছে হাম্মাদের বর্ষামুখর দিনগুলি! আজ ভাবতে গেলেই চোখ উপচে জল আসে।
হাম্মাদদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা খালটিতে আজকাল যদিও তেমন একটা মাছ পাওয়া যায় না, কিন্তু হাম্মাদের শৈশবের দিনগুলিতে দেখেছে, কত কিসিমের মাছ। ছোট্টো ছোট্টো টাকজাল দিয়েও দশ-পনেরো মিনিটের প্রচেষ্টায় অনায়াসে এক তরকারি মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরত হাম্মাদ। বড় টাকজাল দিয়ে যা ধরা যেত তা তো রাখত রীতিমতো ধানসিদ্ধ করার বড় ডেগগুলোতে। একজন মাছ ধরত তো আর দশজন পাশে বসে একসাথে অনেক মাছ ওঠার আনন্দে চারপাশ চিৎকারে কাঁপিয়ে তুলত। চিৎকার শুনে মানুষের জটলা বেঁধে যেত। ছোট্ট ছোট্ট ব্রিজগুলোতে মাছ ধরার বিশাল মহরত চলত। হাম্মাদ তখন সবান্ধব কোন ব্রিজে কতগুলো মাছ ধরেছে, তা দেখতে অস্থির পায়চারি করত। কখনো তো দুই আলের মাঝখানে বেতের তৈরি মাছ ধরার ঝাঁপি তুলে মাছ নিয়ে আসত। যেগুলোকে ওরা ‘উন্নেয়া’, ‘বাগা’ বলে থাকে। আজকাল এসব হাম্মাদ কেন, সকলের কাছেই স্বপ্নের মতো শোনায় বৈকি।
সেই শৈশব থেকেই কদম হাম্মাদকে মোহিত করত। হাম্মাদদের কোনো কদমগাছ ছিল না। ওদের বাড়ির পাশের বাড়িতে একটা বিশাল কদমগাছ ছিল। আষাঢ়রাঙা কদমে নুইয়ে পড়ত গাছটা। চাইলে কদম দিবে না, এটা ভেবে টানা বৃষ্টির দিনগুলোর সদ্ব্যবহার করত হাম্মাদ। বৃষ্টির মধ্যে গাছে উঠে মুঠো মুঠো কদম ফুলে ঘর ভরে ফেলত। কারো কানে গুঁজে দিত। আবার কখনো ওপরের পাপড়িগুলো ছাড়িয়ে বিছানায় বিছিয়ে রাখতো। ঘ্রাণে ঘ্রাণে হারিয়ে যেত অন্য কোথাও। সেদিন থেকে আজ, আষাঢ়রাঙা কদমের মূল্য এতটুকুও কমেনি হাম্মাদের কাছে। এটা হাম্মাদের রাঙা শৈশবের একটুকরো বর্ষামুখর স্মৃতি। হাম্মাদ মৃদু ঠোঁট নেড়ে বলে, ভালো থেকো স্মৃতিরা আকাশের মতো। ভালো থেকো স্মৃতিরা স্বপ্নের মতো।
সন্ধ্যাফুল ৩
মেঘে মেঘে আকাশ কালো হয়ে গেছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন নেমে এল রাজ্যের অন্ধকার। যূথীর মুখে অদ্ভুত মায়া খেলা করছে। আলো আঁধারির নীরব সৌন্দর্য সকলের চেহারায়। এক নীরব স্নিগ্ধতা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাম্মাদের চোখ যূথীর চেহারায় পড়তেই দুজনে চোখাচোখি হয়ে যায়। হাম্মাদ দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হাম্মাদের এই লাজুক ভাব দেখে যূথীর মুখটা হাসিতে ভরে ওঠে। এতে যেন এক নতুন সৌন্দর্য অবমুক্ত হয় প্রকৃতির মাঝে। বৃষ্টির আগ মুহূর্তটা সত্যিই অপূর্ব। বিশেষত যারা সবসময় শহরে থাকে তাদের জন্য যেন এমন পরিস্থিতিতে বৃষ্টি পরম পাওয়া। গতরাতের সেই ঝুমবৃষ্টি। আরেক দফা ঝুমবৃষ্টির যেন প্রস্তুতি চলছে।
বহুদিন অনাবৃষ্টির কারণে রাস্তা-ঘাট, পাতা-ফুল কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এই কদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে ভিজে সবকিছু কেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। গাছের পাতায় পাতায় বৃষ্টির তুমুল নৃত্য। মাঠেঘাটে বৃষ্টির ফোঁটার তুমুল আন্দোলন। সবকিছুতেই কেমন সুখের আবেশ জাগে। এসব দেখতে কার না ভালো লাগে? গ্রামে বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে নতুন নতুন পিঠেতে শিশু-কিশোরের রাঙামুখ। গল্পের আসরে মুখর আনন্দ। ধানশূন্য ধানখেতে ফুটবলের মাতামাতি। পুকুর-খালে ডুবাডুবিতে চোখ লাল করা। খালেবিলে মাছ ধরার তুমুল উল্লাস। কলাগাছ কেটে ভেলা বানানোর ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস। গ্রামে বৃষ্টি মানেই সবার মুখে হাসি। ঐশ্বরিক আত্মতৃপ্তি। কিন্তু শহরে বৃষ্টির চিত্রটা পুরোপুরি ভিন্ন রকম। শহরে বৃষ্টি মানে একটা উটকো ঝামেলা। কারো তো পাঁজর ভাঙার আয়োজন। পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। না হয় অফিস, স্কুল-কলেজ আর না চলে ব্যবসা-বাণিজ্য। অসহ্য এক বন্দি জীবন। ঢাকায় বৃষ্টি মানেই সবকিছু ফাঁকা। রাস্তাঘাট তলিয়ে নদী বনে যাওয়া। কারো চোখের করুণ চাহনি। এই ঢাকা শহরে বৃষ্টি মানেই চরম অপ্রাপ্তি।
হাম্মাদ এবং যূথী উভয়ে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। হারিয়ে যায় ভরপুর নিস্তব্ধ সৌন্দর্যে। পাখিরা ছুটে যাচ্ছে নীড়ে। গরু-বাছুর দড়ি থেকে ছাড়া পেয়ে ‘হাম্বা হাম্বা’ শব্দে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে ব্যস্ত কাজের লোক। তার আরো বহু কাজ পড়ে আছে। সবকিছুতেই কেমন বাড়ি ফেরার তাড়া পড়েছে। সবাই দ্রুত নিজের আশ্রয়ে আশ্রিত হতে যেন বেকারার। সবাই আপন জনের কাছে ছুটে যাচ্ছে। সত্যিই এই সময়টা আপনজনের সাথে কাটানোর। এই সময়টা মুখর আনন্দের।
সবকিছুর এমন আশ্রয়মুখিতা দেখে যূথীর মনে পড়ে তার আশ্রয়হীনতার কথা। দিনশেষে তো যূথী আশ্রয়হীনই। সবাই থেকেও যেন কেউ নেই। সবকিছু থেকেও যেন কিছুই নেই। মুক্তা আছে। হৃদিতা আছে। মারিয়া আছে। আছে প্রিয় বান্ধবী মেহরিমাও। আরো কতো ছেলেবন্ধু আর মেয়েবন্ধুতে জীবনের খেলাঘর। তবুও যেন কী নেই, কী নেই! মায়ের মুখটা মনে পড়ে। কেমন আত্মতৃপ্তির চাহনি। রাঙাজীবন যেন। তাঁর আর কিছু চাওয়ার নেই। তিন তিনটে ছেলেমেয়ে মিলেই যেন তার জীবনের প্রেম। মনে পড়ে বাবার হাসি হাসি মুখটাও। সর্বক্ষণ ‘মা, মা’ বলে ছোট বাচ্চাদের মতো আব্দার আহ্লাদ! সবাই তো আছে। ছোট্ট ভাইটা কী আদরেরই না ছিল! যূথী যখন ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরত তার পিছু ছাড়ত না। মাঝেমধ্যে খুব বিরক্তই লাগত৷ 
তুই ছেলে মানুষ। তুই না গিয়ে বাড়ির সামনে খেলবি। তবুও এমন ঘরকুনো স্বভাবের কেন! বুঝে আসে না যূথীর। শেষে আম্মুর কথা শুনে সব বিরক্তি কিনা উবে যেত। এমনিতেই সারাদিনে ওর হদিস পাওয়া যেত না। এতটুকু ছেলে কোথা থেকে কোথা যায়। যা দুষ্টুমি করে! তবে বোনের জন্যই নাকি এমন বেকারার। বোন আসার দশদিন আগ থেকেই খেলার সঙ্গীদের বলে বেড়ায়, বৃহস্পতিবার আমার যূথী আপু আসবে। ওইদিন আর খেলতে আসব না রে। আসলে বোনের জন্য ভাইগুলো এমনই। বোন যে হৃদয়ের ধন! মনে পড়ে বড় বোন সায়েমার কথাও। কেমন আদুরে গলায় ‘যূথী যূথী’ ডেকে ফিরত। ছোট্ট ভাগ্নেটা যা দুষ্টু না! শুধু কোলে উঠতে চাইবে। সেই চিরচেনা তালপুকুর। কত বেলায় না কেটেছে এখানে। তাল গাছের ছায়ায় ছোট্ট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কত রকম খেলাধুলাই না করেছে। মনে পড়ে আরও কত কী! ভাবতে ভাবতে যূথীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আজ যেন কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। কিছু নেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে আজ বড় একা লাগে যূথীর নিজেকে। যেন বিশাল এই পৃথিবীতে যূথী কেবল একা। কোথাও কিচ্ছুটি নেই।
হঠাৎ যূথীর মনে হয়, দূর ছাই! কী সব ভাবছি আমি? অন্ধকারকে কখনো প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কুসংস্কারের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। মনির স্যার বলেছিলেন, একজন সংস্কারবাদী প্রকৃত মানুষ আস্তিকদের ধারণাকৃত প্রভুর মতো। তার না থাকবে মা-বাবা, ভাইবোন আর না থাকবে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী কিংবা স্ত্রী। সংস্কার এটা মুখের কথা নয়। রীতিমত কোনো বিশ্বযুদ্ধ। এর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক আত্মত্যাগ দিতে হয়। জীবনের পর জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিতে হয়। তবেই না এই পৃথিবী হবে মানবতার। এই পৃথিবী হবে মানুষের। হবে স্বপ্নসাধের বসতবাড়ি। তাহলেই না হবে মানুষের বাসযোগ্য। তবে এর জন্য যারা কষ্ট করে যাবে এরা পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে থাকবে। একদিন এরাই প্রকৃত নায়ক বলে প্রমাণিত হবে। ইতিহাস তাদের ভুলবে না।
আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। We Respect Every Author Hardwork (boipaw™)
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?