সন্তানের জীবনে মা-বাবার প্রভাব! – লাবনী আক্তার

একজন সন্তান তার মা-বাবার প্রতিবিম্ব স্বরূপ। একটি শিশুর পুরোটা জগৎ জুড়েই থাকে তার মা-বাবা।বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষা সে মা-বাবার কাছ থেকেই পেয়ে থাকে।সন্তানের কাছে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নিরাপদ আশ্রয়ের নাম হচ্ছে মা-বাবা।সেই নিরাপদ আশ্রয়ই যদি হয় নেতিবাচকতা,অশান্তি, ভয়,ঝামেলা দ্বারা পরিপূর্ণ তবে সৎ-আদর্শবান-সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তিত্ব বিকাশে ব্যাঘাত ঘটবে/ঘটছে অবশ্যই!

আমরা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ প্রস্তুত করতে পারিনা তবে আমরা অন্তত তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারি।যদিও অভিভাবকত্ব সহজ বিষয় নয়! সন্তান লালনপালনের ফলে তাদের উপর যে প্রভাব ফেলে তা বোঝা কঠিন যতক্ষণ পর্যন্ত না এর দৃশ্যমান লক্ষণগুলো শিশুর ব্যক্তিত্বের উপর প্রতিফলিত হয়।
‌চলুন তবে কয়েকটি দিক বিবেচনা করে বিষয়টি আলোচনা করা যাকঃ
মা-বাবা হিসেবে আমাদের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা-দোয়ার শক্তি যেন এতটাই হয় যাতে আমাদের সন্তানরা তাদের ব্যর্থতা-গ্লানি ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে এগোতে পারে।সবসময় সে যেন এটা অনুভব করে যে, তার একটি পরিবার আছে,বিশ্বস্ততার জায়গা আছে,নিরাপদ একটি আশ্রয় আছে।পৃথিবীর আর সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসার ভান্ডার তার জন্য সর্বদা খোলা।
টমাস আলভা এডিসন সম্পর্কে বলতে গেলে স্কুল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় তার মাকে একটি চিঠি দিয়ে। তার মা চিঠি লুকিয়ে এডিসন কে বলেছিলেন, তুমি এতটাই ভালো ও বুদ্ধিমান যে,তোমাকে পড়ানোর মতো যোগ্যতা ঐ স্কুলের নেই।মায়ের সেই দূরদর্শী কথার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আমরা জগৎ বিখ্যাত আবিষ্কারক কে পাই!
এরকম আরো শতশত উদাহরণ আছে!আসলে সন্তানের জীবন গড়তে সবচেয়ে বেশি ভূমিকাই পালন করে মা-বাবা। তাদের ইতিবাচক কথা,আচরণ, দোয়ার বদৌলতে সন্তানের সোনালী ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে।
শিশুবিশেষজ্ঞ ডা.আহমদ মরতুজা বলেন, একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে শতশত সিসিটিভি যেমন ছোটখাটো সবকিছুই রেকর্ড করে রাখে তেমনি নবজাতক মস্তিষ্কের অগণিত সিসিটিভি দিয়ে সবকিছু রেকর্ড করে রাখে। কচি নবজাতকের মা বিরক্তি নিয়ে দুধ খাওয়ালে,কাঁথা বা ডায়াপার বদলানোর সময় রাগ করলে তা তার ব্রেনের নিউরনে জমা থাকে। যখনই এই শিশু বড় হতে থাকে তখন মস্তিষ্কে জমানো নেতিবাচকতা- অবহেলা, রাগ,চিৎকার,অভিমান ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।মা-বাবা তখন আফসোস করে বলে থাকেন, আমার ঘরে এত বেয়াড়া,অমনোযোগী, অসামাজিক সন্তান আল্লাহ কেন দিলেন! আসলে আল্লাহ দেয়নি,বরং শিশুর প্রতি অবহেলা , অসন্তুষ্টি, অল্পতেই রাগ দেখানো ইত্যাদি শতকলায় পূর্ণ হয়ে পরিণত বয়সে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে।
অভিভাবকত্ব শিশুর প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলে কারণ তারা তাদের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়।পরিবারে ঘটে যাওয়া ভালো কিংবা মন্দ সবকিছুর দ্বারাই শিশু প্রভাবিত হয়।আর তাই মা-বাবার মধ্যে যত খারাপ সম্পর্কই থাকুক না কেন সেখানে সন্তান কে যুক্ত করবেন না।”বাবার মতো বেয়াদব হয়েছো,মায়ের সব খারাপ কিছু পেয়েছো,রক্ত যেখানে দূষিত সেখানে ভালো সন্তান পাওয়া দায়” ইত্যাদি সন্তান কে বলা থেকে বিরত থাকুন।বরং মা-বাবার উচিত সন্তান কে এটা বুঝানো যে, তারা তাকে অনেক ভালোবাসে।
টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে যে, ছোটবেলা পার করার পরও যেসব শিশু কড়া নিরাপত্তার চাঁদরের ভেতর থাকে তাদের মধ্যে স্বকীয়তা ও আত্ন-নির্ভরশীলতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো অনুপস্থিত থাকে,সিদ্ধান্ত নেবার মনমানসিকতা গড়ে ওঠে না,তার নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস থাকেনা ইত্যাদি। এটাই স্বাভাবিক যে, মা-বাবা তাদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত থাকেন বিশেষ করে সে যখন ছোট থাকে।কিন্তু শিশু যখন ক্রমাগত বড় হতে থাকে তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে আগের মতো ভাবার কিছু থাকেনা। এটা একটা ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ। কারণ সে যত বড় হতে থাকে ততই নিজে নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো বুঝে নিতে শিখে যায়।এক্ষেত্রে আপনার উচিত হবেনা মাত্রাতিরিক্ত কর্তৃত্ব ফলানো।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রায় ৫০বছর ধরে দেড় লক্ষ শিশুর উপর গবেষণা করে দেখেছে যে, যেসব শিশুদের শারীরিকভাবে শাস্তি দেওয়া হতো তারা পরবর্তীতে পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে তেমন সফল হয়নি।তাছাড়া পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অবসাদগ্রস্থ থাকা,ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা রয়েছে প্রচুর।
শিশুর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন তাকে মহামানবে পরিণত করতে পারে তেমনি নেতিবাচক আচরণ তাকে বানাতে পারে যুগের কুখ্যাত ব্যক্তি।মা-বাবার ছোট্ট ছোট্ট আচরণ শিশুর মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন আনে।তার কল্পনার জগতে আপনি হয়ে যেতে পারেন ভিলেন।তাই শাস্তি কে প্রাধান্য না দিয়ে ভালোবেসে আপনার শিশুকে বড় করুন আর হয়ে উঠুন তার মনোজগতের আসল নায়ক!
পরিশেষে এটাই বলব যে, প্রতিটি শিশুই সম্ভাবনাময়।নিজ সন্তান কে ছোট করে নয়,অন্যের সাথে তুলনা দিয়ে নয়,সেল্ফ-স্টীম কে আঘাত করে নয় বরং আদর দিয়ে ভালোবেসে তাকে স্বপ্ন দেখান,তার ভেতরের প্রতিভা জাগিয়ে তুলতে, তার আস্থার প্রতীক হতে তার গুড প্যারেন্টস হোন।তাকে সময় দিয়ে,তার চাহিদাগুলো রাইট ওয়েতে পূরণ করে,তার আগ্রহের জায়গাগুলো যতটুকু সম্ভব সমর্থন করে তার বন্ধু হোন। 
একটা কথা সবসময় মনে রাখা প্রয়োজন,,, আপনার সন্তানকে আপনি Preadolescence Stage থেকে যা শিখাবেন,তা তার সমগ্র জীবনে প্রভাব ফেলবে।
তাকে স্বাধীনতা দিন প্রকৃতপক্ষে তার যতটুকু প্রয়োজন। তাকে আকাশ-বাতাস চিনতে দিন,খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে দিন,নিজের জগৎ বলে একটা কিছু হয়- সেটা তাকে কল্পনা করতে দিন,সৃষ্টিকর্তার পরে মা-বাবা সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা- এটা তাকে বুঝতে দিন!
লেখনীতে,,,
লাবনী
ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?