শুকনো ফুল

সপ্তম বিবাহবার্ষিকীতে হাসপাতাল থেকে আনা রিপোর্টগুলো স্বামীকে উপহার দিবে বলে তিনদিন ধরে অপেক্ষা করছে নিসা। এই সাত বছরে একটা সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করেছে। চেনা-জানা কোনো ডাক্তার বাদ দেয়নি। অনেকেই বলেছে ফকির-কবিরাজ দেখাতে কিন্তু কাজটা শিরক তাই নিজেকে আটকে রেখেছে। নাহলে হয়তো এটাও বাদ দিতো না। 

তিনদিন আগে টেস্টের রিপোর্ট হাতে পায় নিসা। রেজাল্ট পজিটিভ, সে প্রেগন্যান্ট। এতদিনে আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন। সে ভাবছে রাকিব খবরটা শুনে কতটুকু খুশি হবে!
ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওরা। বিয়ের বছরখানেক পর থেকে রাকিব ও তার পরিবার সন্তানের জন্য বায়না করতে লাগলো। ওদের আবদার দেখে মনে হতো বাচ্চা গাছে ধরা কোনো বরই। গাছ ঝাকা দিলেই ঝরঝর করে পড়বে। যদিও নিসার আরো কিছুদিন পর বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পরিবারের সবার আবদারের সামনে কিছু বলতে না পেরে রাজি হয়ে গেল। দু’মাস, ছ’মাস, বছর যেতেও যখন নিসা কনসিভ করছিল না তখন সবাই বিরক্ত হতে লাগলো। শুরু হলো ডাক্তার দেখানো। কোনোভাবেই কাজ হচ্ছিল না। 
বিয়ের ছয় বছর পর আর ধৈর্য ধরতে না পেরে রাকিব অবশেষে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেই ফেললো। অবশ্য রাকিবের মা অনেক আগে থেকেই বলছিলেন। নেহাত ভালোবেসে বিয়ে করেছে তাই রাকিব মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিল না। কিন্তু ছয় বছর পরও যখন নিসার কোলে সন্তান আসছিল না তখন রাকিবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে বলে নিসা এ বাড়িতেই থাকবে। তার কোনো অযত্ন হবেনা। শুধু নতুন একজন সদস্য পরিবারে যুক্ত হবে। রাকিবের জন্য কথাটা বলা সহজ হলেও নিসার জন্য সহজ ছিল না। সে অনেক অনুরোধ করলো রাকিব যেন দ্বিতীয় বিয়ে না করে। যা ঘটছে এতে আল্লাহ ছাড়া আর কারো হাত নেই। তিনি ইশারা না করলে কিছুই হবেনা।
নিসার অনুরোধে রাকিব থেমে গেল। অবশেষে আজ সেই আনন্দের দিন। নিসা পুরো বেডরুম মোমবাতি আর ফুল দিয়ে সাজালো। সেই প্রথম বিবাহবার্ষিকীর মতো করে। একটা কেক অর্ডার দিয়ে আনলো। অপেক্ষা করছে রাকিব কখন বাসায় আসবে।
বারোটা সাইত্রিশে কলিং বেল বাজলো। নিসা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। সামনে তার শ্বাশুড়ি দাঁড়িয়ে। পেছনে রাকিব আর আধহাত ঘোমটা টানা একটি মেয়ে বেনারসি পরে বিয়ের সাজে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মুহুর্ত লাগলো সবটা বুঝে উঠতে। নিসা রাকিবের দিকে তাকালো। সে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাকিবের মা বললেন,
– নতুন বউকে কতক্ষণ দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে? সরে দাঁড়াও, ওরা ভেতরে আসুক। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে নতুন বউকে দাও।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নিসাকে দরজা থেকে সরিয়ে রাকিব আর নতুন বউকে নিয়ে ভদ্রমহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। সকালে তিনি নিসাকে বলেছিলেন রাকিবকে সাথে নিয়ে আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছেন। ফিরতে রাত হবে। এই বুঝি সেই আত্মীয়! বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে নিসা বিরিয়ানি রান্না করেছে সবার জন্য। ঘরের এদিকটা বিরিয়ানির গন্ধে আর ওদিকটা ফুলের গন্ধে মো মো করছে। 
নিসার শ্বাশুড়ি নতুন বউকে নিয়ে নিসার বেডরুমে গেলেন। রুম সাজানো দেখে একটু জোরেই বললেন,
“ভালো করেছো রুম সাজিয়েছো। নাহলে কাউকে মার্কেটে পাঠিয়ে ফুল আনাতে হতো এত রাতে।”
নিসা কোনো উত্তর দিলো না। আসলে কি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না। সে জানতো সন্তানের জন্য রাকিব কতটা উৎসুক হয়ে আছে। মাঝে মাঝে ওর মুখে দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে নিসা কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিতো। ভাবতো সন্তানের জন্য এমন কথা অনেকেই বলে। তাই বলে কি রাকিব সত্যি সত্যি বিয়ে করবে! হাজার হোক, ভালোবেসে বিয়ে করেছে ওরা।
নিসার সব ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে অবশেষে রাকিব নতুন বউ নিয়েই আসলো। নতুন বউকে রুমে রেখে রাকিব ড্রয়িংরুমে এসে নিসার পাশে বসলো। নিজের ভেতর কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করছে। তবে অতটাও না। কারণ নিসার সন্তান হচ্ছে না, অনেকদিন অপেক্ষা করেও কোনো লাভ হলো না। নিসা তো সব দেখতেই পাচ্ছে। তাই ওর রাগ করা উচিত না। এমনটাই ভাবছে সে।
রাকিব নিসার পাশে বসতেই নিসা উঠে যেতে উদ্যত হলো। রাকিব নিসার হাত ধরে বললো, “রেগে আছো তাইনা? কি করবো বলো? আমার তো ইচ্ছে হয় সন্তানের মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনতে। এত বছর মানা করেও অবশেষে মায়ের কথায় রাজি হতে হলো। তোমাকে আমি কখনোই কষ্ট দিব না। অবহেলাও করবো না। তুমি দেখিও!”
নিসা কোনো উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখেছে। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়তে দিচ্ছে না। এক মগ কফি নিয়ে এসে দেখে রাকিব এখনো সোফায় বসে আছে। স্বাভাবিকভাবে রাকিবকে জিজ্ঞেস করলো, “ক্ষুধা পেয়েছে? কিছু খাবে?”
রাকিব বললো, “কিছুই খাবো না। তুমি আমার পাশে একটু বসবে?”
নিসা উত্তরে বললো, “এখন ইচ্ছে করছে না”।
বলেই নিসা সেখান থেকে চলে গেল। এভাবে রাকিবের মুখের উপর “না” কখনোই বলেনি নিসা। কোনোদিন বলবে সেটাও ভাবেনি। কিন্তু আজ কীভাবে যেন বলে ফেললো। এর জন্য নিসার খারাপ লাগছে না। ওর মনে হচ্ছে এটাই রাকিবের প্রাপ্য। কিছুক্ষণ বসে থেকে উপায় না পেয়ে রাকিব বেডরুমে গেল। নতুন বউকে কি একা বসিয়ে রাখা যায়!
কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে নিসা। এখানে অনেকগুলো ফুলের টব। প্রতিটি টবে ফুলগাছ, সবই রাকিবের পছন্দের। নিসা গাছ খুব পছন্দ করে। তবে রাকিবের পছন্দের সব ফুলের গাছ এনে ঠাঁই দিয়েছে নিজের বারান্দায়। সারাক্ষণ এগুলোর পরিচর্যা করে। ফুলের দিকে তাকিয়ে নিসা ভাবছে, ফুল ফোটার সময় তাতে কতই না ঘ্রাণ থাকে। কিন্তু একসময় এই ফুলকে ঝরে পড়তে হয়। সেই ডালে ঠাঁই পায় নতুন ফুল!
সারারাত বারান্দায় বসে থাকলো নিসা। শ্বাশুড়ি একবার এসে ডেকে গেছেন, “আজ আমার রুমে এসে ঘুমাও। ওই রুমে তো নতুন বউ আছে”।
শুনে নিসা ভাবছে, আজ ওই রুমে নতুন বউ আছে, কাল কি থাকবে না? আজ নাহয় শ্বাশুড়ির রুমে ঘুমালো, কাল কোথায় ঘুমাবে? পরশু? এভাবেই তো চলবে তাইনা? 
ভোরে রুমের দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসলো। রাকিব রুম থেকে বের হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেছে। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে শাওয়ার নিচ্ছে। নিসার বুকের ভেতর খচ করে উঠলো। রুমে গেল সে। আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে নতুন বউ ঘুমাচ্ছে। কোনো শব্দ না করে ওয়্যারড্রবের ড্রয়ার খুলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো নিসা। 
রাকিব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পর বাইরে গেল। ভোরে বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করা অভ্যাস ওর। আধাঘন্টা পর বাসায় এসে কিচেনে নিসাকে দেখলো না। প্রতিদিন এই সময়ে নিসা চা রেডি করে রাখে। আজ ব্যতিক্রম হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। ওকে স্বাভাবিক করতে হবে। পুরো ঘরে খুঁজেও নিসাকে দেখলো না রাকিব। টিভির উপর একটা খাম দেখলো। খাম থেকে কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলো,  
“প্রিয়,
কখনো ভাবিনি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার শক্তি পাব না। বাধ্য হয়ে লিখে রেখে যাচ্ছি। 
তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবেসেছি, এখনো কতটা বাসি। পরেও বাসবো, কিন্তু তখন তোমার কাছে থাকবো না। 
আমি বন্ধ্যা নই। ডাক্তার বলেছিল আমাদের দু’জনের কারোই কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহর যখন ইচ্ছা মুখ তুলে চাইবেন। সেই ভরসায় থেকেছি সবসময়। তোমাকেও বুঝিয়েছি, ভাগ্যে সন্তান থাকলে আল্লাহ নিশ্চয়ই দিবেন। কিন্তু তোমার অবুঝ মন আমার কথা মানেনি। তুমি অন্য কাউকে এনে আমার জায়গাটা তাকে দিলে। মুখে যতই বলো যে আমার জায়গা আমারই থাকবে। কিন্তু একরাজ্যে দুজনের রাজত্ব হতে পারেনা। এতে সুখ-শান্তি থাকবে না। আর যাকে এনেছো সে তো কোনো দোষ করেনি। আমি কেনই বা তাকে কষ্ট দিব!
তাই আমি-ই সরে যাচ্ছি। তোমার কোনো সিদ্ধান্তে কখনো বাঁধা দেইনি। শুধু এই একটা ব্যাপারে তোমাকে আটকেছি। কারণ আমি অন্য কাউকে মানতে পারতাম না। তবুও, কপালে যা আছে কেউ ঠেকাতে পারেনা। সেটা মেনে নিয়েই আমি চলে যাচ্ছি। 
প্রেগন্যান্সির রিপোর্টটা রেখে গেলাম। আমি কনসিভ করেছি দু’মাস হলো। চারদিন আগে রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। ভেবেছিলাম বিবাহবার্ষিকীতে তোমাকে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু তুমিই আমাকে সারপ্রাইজড করে দিলে।
তোমাকে জানাতে চাইনি। কিন্তু আমি যে কষ্টটা পাচ্ছি তার সমান অংশীদার তো তুমিও তাইনা? এটা ভেবে কষ্ট পাবে, যে কমতির কারণে অন্য কাউকে আমার জায়গাটা দিলে তা আমার মাধ্যমেই পূরণ হলো। 
তোমাকে আমি ডিভোর্স দিব না। আমার সন্তানের তার বাবাকে প্রয়োজন হবে। সময় মতো তুমি তাকে দেখতে পাবে। আমার ফেরানোর চেষ্টা করো না। তাতে ফলাফল খারাপের দিকে যেতে পারে”
চিঠি পড়ে রাকিবের অনুভূতি লেখার ভাষা লেখিকার কাছে নেই। কিছু অনুভূতি শুধু অনুভব করা যায়।
গল্পঃ শুকনো ফুল
কলমেঃ Asma Aktar Urmi
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?