শান্তি একটি ফুলের নাম – লেখক : সালমা বিনতে শামস | Shanti Ekti Fuler Naam – Salma Binte Shams

শান্তি একটি ফুলের নাম (pdf download no available)
লেখক : সালমা বিনতে শামস
প্রকাশনী : নবপ্রকাশ
বিষয় : সমকালীন উপন্যাস
পৃষ্ঠা : 120
ভাষা : বাংলা

Image
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা……..
কোনো এক রমজান মাস। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, চারপাশে এত এত গল্প-উপন্যাস, যেখানে কেবল অর্থহীন সংলাপ, অবৈধ সম্পর্কের টানাপোড়ন, মিথ্যে সব কাব্য-কাহিনি। এমন কি হয় না—যেখানে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে থাকবে ইসলাম, সত্য, সুন্দর জীবনের সরল পথ-পন্থা। যেখানে থাকবে শুদ্ধ সম্পর্কের বন্ধন; যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন সামাজিক বলয় ভেঙ্গে উদয় হবে সোনালি সূর্য।

সেই ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে যাত্রা শান্তি একটি ফুলের নাম বইটি, বিশেষভাবে আমার বোনদের উদ্দেশ্যে লেখা। জানি না কতটুকু পেরেছি। আমার মনে হয়েছিল, এখন আমাদের যে বয়স, এখনই আমরা বোনেরা ইসলামের প্রকৃত আলোকে ধারণ করে পথ চলতে পারলে সে পথ হবে কেবলই শান্তির। যেখানে দুনিয়া এবং আখেরাত আমাদের জন্য হবে সুন্দর ও সম্মানজনক।

  • স্যাঁতস্যাঁতে ব্যালকনি, মনে হয় কত শত বছরের পুরোনো বাড়ি৷ শুধুমাত্র বাড়ির এদিকটা দেখলেই এমন মনে হয়, তাছাড়া পুরো বাড়িটা ঠিক আছে৷
ব্যালকনি এমন হওয়ার সঙ্গত কারণও আছে। বাড়ির পেছনের দিকে সরাসরি সূর্যের আলো আসে না। তার ওপর দুই পাশে বড় দুটো গাছ—একটা মেহগনি আরেকটা নাম না জানা গাছ, চওড়া ঘন সবুজ পাতা৷
মাঝে মাঝে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হয়। এই জেনারেশনে এসে আমরা প্রকৃতির অনেক কিছুই চিনি না, নামও জানি না। এই যেমন মাছের নাম, ফুলের নাম, গাছের নাম, পাখির নাম৷ অথচ এগুলোই তো আমাদের জীবনের মূল৷ আল্লাহ দুনিয়াতে কত লক্ষ লক্ষ প্রাণী, উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন, আমরা কয়টার নাম জানি? কয়টাই বা চোখে দেখেছি?
এ বাড়িতে আমরা নতুন ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছি আজ আট দিন হলো৷ ঢাকার মূল শহর ছেড়ে কিছুটা ভেতরে বাড়িটা৷ বাড়িভর্তি গাছ গাছালি৷ অনেক খুঁজে আব্বু বাড়িটা পছন্দ করেছেন৷ আব্বু প্রকৃতি পছন্দ করেন, বিশেষ করে গাছ-গাছালি৷ এ কারণে মনে হয়েছে এই বাড়িটা পারফেক্ট।
সমস্যা হলো, আমাকে কষ্ট করে কিছুটা পথ জার্নি করে ভার্সিটিতে যেতে হবে৷ তবে আব্বুর জন্য সুবিধা, তার অফিস কাছে।
এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে উঠলে ফার্নিচার আর জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে সাত দিন লেগে যায়, আমাদেরও ঠিক তাই৷
এই কয়দিন ঘর গোছানো আর পড়াশোনা নিয়ে এতই ব্যাস্ত ছিলাম যে নতুন বাড়ির নতুন প্রতিবেশীরা কে বা কেমন জানা হয়নি। আমার হয়নি তো কী হয়েছে, আম্মুর ঠিকই দু-তিনজন ভাড়াটিয়া আন্টির সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে৷ শুধু কি পরিচয়? তিন তলার এক আন্টির সাথে তো রীতিমতো বান্ধবী পাতা হয়ে গেছে। সারাক্ষণ বাসায় এসে তার কথা বলে। তার হাজবেন্ড মসজিদের ইমাম আর এক মাদরাসার শিক্ষক। পাঁচ সন্তান তার, বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আর এখন তিন সন্তান।
নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী এ বাসায় আছেন পাঁচ বছর ধরে। এক মেয়ে আর দুই ছেলে৷ মেয়েটা নাকি যেমন সুন্দরী তেমন লক্ষ্মী। আমি আর আব্বু এসব শুনি আর হাসি৷
দশ দিনের দিন আম্মু বাসায় পাটিসাপটা পিঠা বানালেন৷ এ পিঠা আমার পছন্দ খুব৷ বছরে তিন থেকে চারবার এ পিঠা বানানো হয় আমাদের বাসায়৷ বিকেলে আম্মু একটা পিরিচে পাঁচটা পাটিসাপটা পিঠা দিয়ে আমাকে বলল, “যা তো, তিন তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে পিঠাগুলো দিয়ে আয়।”
‘আমি তো চিনি না, দেব কী করে??
‘গিয়ে তোর নাম বলবি আর বলবি এগুলো আম্মু পাঠিয়েছেন৷
‘আমার নাম বললে আমাকে চিনবে?”
‘হ্যাঁ, চিনবে৷”
‘আম্মু, আনইজি লাগছে, তুমি যাও আমি যাব না৷?
‘তুই যা, তোর সমবয়সী একটা মেয়েও আছে ওই বাসায় গিয়ে পরিচিত হা ভালো লাগবে, মেয়েটা খুব ভালো৷? ‘জ্বি আম্মু, আমি ছাড়া দুনিয়ার সব মেয়েই তোমার কাছে ভালো৷ দাও দাও,
যাচ্ছি।’
আমার মাঝে মাঝে করা এই উগ্র স্বভাবটা আম্মু সহ্য করে নেন, সন্তানদের খুব ভালোবাসেন তাই।
এক প্রকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিন তলার বামপাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে নক করলাম৷ তখনও আমার দুই ভ্রূর মাঝখানে একটা ভাঁজ ছিল, সম্ভবত বিরক্তির ভাঁজ৷ এক মিনিটেরও কম সময়ে দরজা খুলে গেল৷ সাত-আট বছরের একটা ছেলে দরজা খুলে সালাম দিল, সাথে একটা শুকনো মুচকি হাসি৷ কী বলব বুঝতে পারছি না৷
‘তোমার আম্মু কোথায়?’
‘আম্মু রান্নাঘরে, আসেন৷
ঘরে ঢুকে একটু অবাক হলাম, খুব সুন্দর গোছানো ড্রয়িংরুম৷ একটা জায়গায় তাকিয়ে রীতিমতো চোখ আটকে গেল৷ দেয়ালে বিশাল বড় বুকশেলফ৷ দেখে তো মনে হয় হাজারখানেক বই হবে৷
এই একটা জায়গায় আমার বড়ই দুর্বলতা৷ খুশিতে আমার চোখ জ্বল জ্বল করতে লাগল৷ এখানকার অর্ধেক বইও আমার বাসায় নেই। ছোট্ট একটা বুকশেলফ আমার, সব মিলিয়ে ছয়শোর মতো বই হবে। 
মনে মনে খুশি হলাম, যাক, ভালো একটা প্রতিবেশী পেলাম৷ এখান থেকে বই
নিয়ে পড়তে পারব। আচ্ছা, এ বাসায় কে কেমন বইপড়ুয়া, দেখতে হবে তো! রান্নাঘরে এগিয়ে গেলাম, আমার আম্মুর বয়সী এক মহিলা রান্না করছিলেন। ‘আস্সালামু আলাইকুম আন্টি।”
‘ওয়ালাইকুম সালাম, তুমি কে গো?? ‘আমি সালমা, চারতলায় থাকি।
‘ও আচ্ছা তুমিই সালমা, তোমার আম্মুর সাথে কথা হয়েছে। বসো মা, আর কী এনেছো এগুলো! আল্লাহ, এসবের কী দরকার, পাগলী মেয়ে৷”
আমি মুগ্ধ হয়ে আন্টির কথা শুনছি আর ভাবছি, আম্মু কি সাধেই এ পরিবারের প্রশংসা করে!
ঘরে ঢোকামাত্রই একটা প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে, ঘুরে ঘুরে বুকশেলফে সাজানো বইয়ের সমারোহ দেখছি। নানা ধরনের বই। একদম উপরের দুই তাকে সাজানো কেবল ইসলামি বই৷ প্ৰসিদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থ, পবিত্র কুরআনের কয়েকটা তাফসির তরজমা, বিভিন্ন নবী-রাসুল ও সাহাবির জীবনী
ক্রমান্বয়ে প্রতিটা তাকে সাজানো বই। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী সমগ্র, জানা অজানা বিদেশি লেখকদের কাব্যগ্রন্থ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বই—কী নেই এখানে!
আন্টি আমাকে বসতে বলে কিচেনে চলে গেলেন৷ এক কাপ চা হাতে একটু পরেই ফিরে এলেন৷ ঠিক কতক্ষণ পর এলেন তা নির্ণয় করতে পারছি না। দশ মিনিট না পাঁচ মিনিট? ধারণা নেই। বইয়ের নাম পড়তে পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম৷
গরম চায়ে চুমুক দিতেই হঠাৎ কানে একটা সুর ভেসে এল৷ পাশের কোনো এক রুম থেকে আসছে সুরটা৷ কিসের সুর এটা ভালো করে বোঝার জন্য চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে সুরটা অনুসরণ করতে লাগলাম৷
আমার অনুসরণ বুঝতে পেরে আন্টি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার মেয়ে৷’
‘ওহ আচ্ছা’ বলে ওঠে দাঁড়ালাম, হাতে চায়ের কাপ৷ আমিও মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম সুরটার দিকে৷ শান্ত মোহনীয় বিকেল, মিষ্টি আকাশ, চারপাশে কেমন সুগন্ধ ছড়ানো হাওয়া৷ ঠিক এমন এক সময়ে এত সুন্দর সুরের কুরআন তেলাওয়াত, চারপাশে স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
চায়ের কাপ হাতে আমি রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে৷ খাটের উপর বসে আছে আমার বয়সী একটি মেয়ে৷ পাশ থেকে মুখটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না, সাদা ওড়না দিয়ে প্যাচানো মাথা আর শরীর৷ ফুলহাতা গোলাপী কামিজ তার উপর সাদা রেশমী সুতো, সাদা পাথরের কাজ, সাদা প্লাজো৷ মেয়েটার সামনে দুটো বালিশ, সে বালিশের উপর পবিত্র কুরআন৷ মাথাটা মৃদু নেড়ে নেড়ে এক স্বর্গীয় সুরে কুরআন তেলাওয়াত করছে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি।
বিকেলটা সাধারণত বিনোদনের, আমার মনে হয় না কখনো এই সময়ে আমি কুরআন তেলাওয়াত করেছি, রমজান মাস ছাড়া।
অনেকটা স্ট্যাচুর মতোই দাঁড়িয়ে আছি, কখন যে মেয়েটা পড়া শেষ করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, টেরই পাইনি৷ সুন্দর সেই কণ্ঠে সম্বিত ফিরে এলো, সাথে মুচকি হাসি৷ ব্যাপার কী, এ বাড়ির সবাই এত সুন্দর করে হাসে কী করে?
‘আসসালামু আলাইকুম৷
‘ওয়ালাইকুম সালাম৷’
‘দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন, বসুন৷’
“না না ঠিক আছে, চলে যাব৷”
‘আপনার চোখ কিন্তু তা বলছে না৷”
‘আপনি কি চোখ পড়তে পারেন? ‘কিছু পারি বটে৷ বসুন, আমিও চা নিয়ে আসি, এক সাথে বসে গল্প করব৷’
সত্যিই তো, আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না, মেয়েটার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে৷ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটার নাম কী? কিসে পড়ে? ড্রয়িংরুমের বুকশেলফের বইগুলো কি মেয়েটার সংগ্রহের? কত্তগুলো প্রশ্ন! কৌতূহল৷
চা হাতে নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসুন, বারান্দায় গিয়ে বসি৷”
আমিও রোবটের মতো মেয়েটার পেছন পেছন বারান্দায় গেলাম৷ চমৎকার একটা বারান্দা৷ দুটো চেয়ার পাতা, মাঝে ছোট্ট একটি টেবিল, টেবিলের এক পাশে চারটা বই। দুটো ইংরেজি, সম্ভবত উপন্যাস, বাকি দুটো বাংলা প্রবন্ধ৷ এত্ত উচ্চমানের বই কে পড়ে? এরকম একটা ইংরেজি বই পড়তে গেলে নির্ঘাত আমার দাঁত ভাঙবে৷
টেবিলের অন্য পাশে মেরুন কালারের একটা কাচের ফুলদানি৷ কালকের ফোটা নির্জীব একটা গোলাপ তাতে, আমাদের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে৷
‘আচ্ছা আমরা আগে পরিচিত হয়ে নিই।’
“জ্বি অবশ্যই, আমার নাম সালমা বিনতে শামছ৷ চারতলায় আব্বু-আম্মু, ভাইসহ থাকি, ইতিহাসে অনার্স পড়ছি৷’
‘মাশাআল্লাহ, আমি জান্নাতুল ফেরদৌস৷ ডাক নাম শান্তি, ফিজিক্স নিয়ে পড়ছি৷’ ‘আপনি করে বলতে ভালো লাগছে না৷ যেহেতু আমরা প্রতিবেশী, তুমি করে বললেই মনে হয় ভালো।
‘হুম, খুবই ভালো হয়, আমিও আপনিতে অভ্যস্ত নই।”
‘তোমার আর আমার নামে একটা সুন্দর মিল আছে, সেটা কী জানো??
‘না তো, কী রকম মিল? ‘আমার নাম শান্তি, তোমার নাম সালমা। সালমা শব্দটা আরবি—যার মূল শব্দ সালাম, এর আভিধানিক অর্থ প্রশান্তি বা শান্তি৷”
‘বাহ্, দারুণ তো।”
‘হুম্ম, যাক ভালোই হলো, একটা বান্ধবীশূন্যতায় ভুগছিলাম।”
‘আশা করি এবার পূর্ণতা পাবে, হিহিহি।
‘ইনশাআল্লাহ৷’
‘আচ্ছা শান্তি, উঠি এবার৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মাগরিবের আজান দেবে৷ আবার কথা হবে, ভালো থেকো।
‘ঠিক আছে যাও, টেক কেয়ার, ফি আমানিল্লাহ৷”
ওই ঘর থেকে বের হয়ে কেমন যেন মনটা ফুরফুরে লাগছে৷ আমিও একটা বান্ধবীশূন্যতায় ভুগছিলাম এতদিন৷ শেয়ার করার মতো কোনো সঙ্গী পাইনি৷ কলেজ ভার্সিটিতে যে বান্ধবীগুলো পেয়েছি, তারা কেউ আমার মনমতো নয়৷ ওরা সাজগোজ, পার্লার, শপিং, আড্ডা, বয়ফ্রেন্ড—এসবে ব্যস্ত থাকে, আর এসব আলাপই বেশি করে৷ বিশেষ করে নাটক-সিরিয়ালের কাহিনি নিয়ে গল্প, যা আমার মোটেও পছন্দ না৷ আমি বরাবরই প্রত্যাশা করতাম, আমার যে বান্ধবী হবে তাকে অবশ্যই পড়ুয়া হতে হবে, বইপোকা হতে হবে৷ তবে কি এ স্বপ্নটা আমার পূরণ হতে যাচ্ছে?
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?