আমরা যারা শহরে বড় হয়েছি, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের “আমার ছোটবেলা” রচনার সাথে আমাদের ছোট বেলার কনোমতেই কোনো মিল খুঁজে পেতামনা। যেমন, মনে আছে? রচনায় লেখা থাকত “আমার ছোটবেলা কেটেছে ‘সবুজ-শ্যামল’ অমুক গ্রামে। তার তমুক নদীর পাড়ে আমরা খেলা করতাম। তমুক নদীতে সাঁতরে বেড়াতাম। অমুক বনে বনভোজন করতাম।” এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা শহরে যারা বড় হয়েছি পাঠ্য পুস্তক প্রণেতাদের আমাদের শৈশব নিয়ে কোনো চিন্তাই যেনো ছিলোনা।
আমাদের ছোটবেলার গল্প গুলো না বেশ অদ্ভুত ছিল। শহর এমন জায়গা, যেখানে প্রতিটা মানুষের জীবনের গল্প গুলো আলাদা। গ্রামেও তাই। কিন্তু শহর আরও বৈচিত্রময়। আমাদের শৈশব কেমন হবে তা অনেকটাই যেনো নির্ভর করতো আমাদের বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থার উপর। তাদের রুচি, চিন্তা-ভাবনার উপর। সেজন্য আমাদের গল্পগুলোও ছিল বিচিত্র।
শহরের উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়েদের ছোটবেলাটা দুই রকম ভাবে কাটতে পারে। এক, সেখানে নিয়মের কোনো বালাই নেই। যা ইচ্ছা করো, যেখানে খুশী ঘুরে বেড়াও শুধু ঠিকঠাক ঘরে ফিরে এসো। আর দুই নাম্বার, যার সাথে আমরা মোটামুটি সবাই নিজেদের সাথে মিল খুঁজে পাবো, “কঠোর নিয়মের সাথে বড় হতে হবে। শৃঙ্খলা ছাড়া কিসের কি?” সেই শৃঙ্খলার শৃঙ্খল কখন যে আমাদের মনোজগতটাকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেলে আমাদের বয়োঃজেষ্ঠ্যরা তা ঠাহর করে উঠতে পারেননা সব সময়। তার আগেই চেয়ে বা না চেয়ে তাদের থেকে আমরা অনেকটা দূরে সরে যাই। শহরে আরেক ধরনের শৈশব দেখা যায়। স্কুল থেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে ফেরার পথে যখন রাস্তার কোনো ছোট-খাটো খাবারের দোকানে বাটারবন কিংবা কাপ কেক কিনতে যেতাম, আর যারা সেই কেকটা কিছু টাকার বিনিময়ে আমাদের বাবা-মার হাতে তুলে দিত সেই শিশুদের শৈশব, ওদের গল্প গুলো হতো আরও অন্য রকম। সত্যি বলতে ওদের জীবনটাই একটা মস্ত উপন্যাস। আরেক ধরণের শৈশব হলো পাতা কুড়ানিদের শৈশব। আরেক শৈশব সেই সব শিশুদের যাদেরকে আমরা “পকেটমার” বলে চিনে থাকি। এদের শৈশবটা রাস্তাঘাটে পরের হাত মার খেতে খেতেই যায়। এরা বড় হয়। সমাজের প্রতি জন্ম নেয় ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ থেকে বড় বড় অসামাজিক কাজ করতে তারা পিছপা হয়না।
প্রথম বা দ্বিতীয় স্তরের ইনাকাম করা বাবা-মা দের সন্তানদের শৈশবটা কাটে শহরের বড় বড় বিল্ডিং গুলোর চার দেয়ালের মধ্যে। সেখানে সূর্যের আলো থাকতে পারে। নাও পারে। সেখানে বসন্তের দক্ষিণা বাতাসের ছোঁয়া থাকতে পারে। নাও পারে। সেখানে থাকতে পারে অসংখ্য বই, খেলনা। আবার নাও পারে। তবে পড়াশোনার চাপটা শত ভাগ থাকবে কিন্তু! সেখানে সংগীতের সুরের ঝংকার নাও বা যদি থাকে, পড়াশোনা না করা উপলক্ষে জননীর ঝংকারকৃত বাণী একটাও মাটিতে পড়েনা। আবার এমনও থাকে সেই ঝংকার দেয়ার জন্য মাই নেই। বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবি। ঘরে থাকা ৩ থেকে সাড়ে ৪ ফুটের জীবটির পেটের চাহিদা মিটাতে গিয়ে তার মনের চাহিদা মিটিয়ে উঠতে পারছেন। সময় নেই। শহরের বাচ্চাদের বাবা-মার জায়গাটা অনেক সময়ই বন্ধুরা দখল করে নেয়। মনে আছে সেই বরফ-পানি, ফুলটোক্কা, ছোঁয়াছুয়ি, মেলা গো মেলা? আমরা স্কুলে যেতাম। টিফিন টাইমে সেখানে দল হয়ে খেলতাম। আবার একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের বাচ্চারা ক্লাসের এক কোনায় চুপ করে বসে থাকতো। কেউ কেউ আবার পিছনের বেঞ্চে বসে টেক্সট বুক পড়তো। মাঝে মাঝে টেক্সট বুকের মধ্যে থেকে উঁকি দিতো রূপকথার বই। শহরতলীতেই এই বই পোকাদের সাক্ষ্যাৎ বেশি মেলে। কি করা, ঘরের বাইরে তো যাওয়ার অনুমতি নেই। বাইরে বেরুলেই “ছেলেধরারা ধরে নিয়ে যাবে”। অতএব যা করার ঘরে বসেই। এই ঘরে বসেই কারো কারো শৈশব কেটে যায় মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রিনের সামনে। আয়তাকার ঐ যন্ত্রটাই সেই শিশুটির জগৎ হয়ে ওঠে। আমাদের অনেকের কাছেই যৌথ পরিবারের ধারণাটা স্বপ্নের মতো ছিল। সেই সমাজ বইয়ের পাতায় পড়া ” মা, বাবা, দাদা, দাদী, চাচা, চাচী” নিয়ে কাটানোর ব্যাপারটা আমাদের কল্পনাতেই থাকত। তাইতো গ্রামে গিয়ে অমন করে মেতে উঠতাম। গ্রামে গিয়ে চার দেয়ালের দালানকোঠা থেকে গিয়ে খেলার খোলা জায়গা দেখে কত খুশি হতাম! গাছ-পালা, নীল আকাশ, পুকুর, বিল শহরে পাবো কোথায়?
তবে কিছু ব্যাপার আছে, আমরা শহরের বাচ্চারা অনেক কিছু দেখতে পারি। ঘর থেকে বেরুলে যেমন উঁচু ইমারতে মানুষের আরামদায়ক জীবনযাপন দেখি, তেমনি দেখি তার পাশের বস্তিতেই মানুষের মানবেতর অবস্থা। আমাদের আশেপাশে খুঁজে পাই নানা মতের মানুষ। কেউ কেউ উদারচিন্তার অধিকারী, কেউ কেউ আবার সংকীর্ণতাবাদী। আমাদের কাছে অনেক কিছু নিয়েই অনেক সুযোগ আছে (এবং আবার, কতটা সুযোগ সুবিধা পাবো, তা বাবা-মার ইনকামের উপর নির্ভর করে)। শহরের শিশুদের সব মানুষের কাছে যাওয়ার অধিকার থাকেনা। কিন্তু বহু মানুষকে দেখার সুযোগ থাকে। তাই বা কম কিসে? এটাই তো শহর। যেখানে বহু অঞ্চলের বহু মানুষের ভীড়।
সত্যি বলতে, প্রকৃতির সংস্পর্শে কাটানো নান্দনিক শৈশব আমরা শহরের ছেলে-মেয়েরা পাইনা। উপশহর গুলোর নামের শুরুতে “উপ” কথাটি থাকায় এই সবুজ প্রকৃতির ব্যাপারটা সেখানে একটু হলেও মেলে। কিন্তু ঢাকার মতো বড় শহর গুলোয় তা মেলা ভার। এমন একটা শৈশব চাই আমরা যেখানে সেই শিশু সুলভ “বাঁদরামি” গুলো করার মতো জায়গা থাকবে। চার দেয়ালে আটকে থাকা প্রাণ গুলোকে শান্ত করার মত যথা প্রশস্ত জায়গা থাকবে। যেই শৈশবে কাউকে আর পকেটমারি কিংবা দোকানদারি করা লাগবেনা কিছু টাকার জন্য। এই “টাকা” ব্যাপারটা থাকলে যেমন অনেক কিছু পাওয়া যায়, না থাকলে তেমনি কিছুই পাওয়া যায়না। কিন্তু একটা সুন্দর শৈশব তো প্রত্যেকটা মানুষের পাওনা। তাইনা?
➤শহুরে শৈশব
➤বিদিশা মন্ডল
ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?