শহরের উষ্ণতম দিনে : তাসনিয়া আহমেদ | Shohorer Ushnotomo Done By Tasnia Ahmed

  • বই : শহরের উষ্ণতম দিনে 
  • লেখক : তাসনিয়া আহমেদ 
  • প্রচ্ছদ : সানজিদা স্বর্ণা 
  • প্রকাশনী : সতীর্থ প্রকাশনা 
  • রিভিউ : সজল আহমেদ
  • মুদ্রিত মূল্য : ২১০
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১০
  • বই রেটিং- ৪.৫/৫ 

‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ বইটি মূলত একটি একক গল্প সংকলন। এর গল্প সংখ্যা ১৪।  গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার সহজ, সাবলীল প্রকাশ। কখনো কখনো রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়; আবার কখনো বিয়োগ, বিচ্ছেদের ক্লেদ; কখনো বা প্রাপ্তি, ভালোবাসা, আবেগের অনুভূতি প্রতিটি গল্পকে দিয়েছে বৈচিত্র‍্য। পড়া শুরুর আগে পাঠকগণ বুঝতে পারবেন না কোন গল্পটা ঠিক কোন ঘরানার।

পড়তে পড়তে একজন পাঠক আবিষ্কার করতে পারবেন কোন গল্পটা কোন ধারা বা আঙ্গিককে নির্দেশ করে। ধারাবাহিকভাবে কোনো একটি নির্দিষ্ট জনরাকে একত্রে ঠাঁই দেওয়া  হয়নি। এই ব্যাপারটা আমার ভালো লেগেছে। কোনো একটা গল্প পড়ার শুরু থেকেই একটা চাপা উত্তেজনা বা কৌতূহল টের পেয়েছি। কারণ রোমাঞ্চ, রোমান্টিক আর সামাজিক বিষয়গুলো বইয়ের একেক পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। 
যেমন- পাঁচতলা, পুতুল, নয়ন, আঠারোই জুন গল্প চারটি ছিলো অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক রহস্যের। পড়তে পড়তে কিছুটা ভয়ে আচ্ছন্ন হয়েছি, রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়েছি পরবর্তীতে কী ঘটতে চলেছে সেই সম্বন্ধে।  
শান,  জলপদ্ম, মতিন সাহেবের একদিন, তর্জনী, ঠিকানা – এই গল্পগুলো ছিল সামাজিক অবয়ব বা বাস্তবতা কেন্দ্রিক। এই ৫টি গল্প পড়তে গিয়ে পাঠকগণ  বাস্তবতা বা সমাজ নির্ভর কিছু পরিস্থিতি, অপরাধ, কার্যক্রম এবং অনুভূতির সাথে পরিচিত হবেন। 
বাকি ৫ গল্প- একদিন, অপেক্ষা কিংবা মায়াবতীদের গল্প, অধরা,  ‘প্রথমবার’ এবং সর্বশেষ ‘শহরের উষ্ণতম’ দিনে পড়তে পড়তে নিজেকে আবিষ্কার করেছি অপেক্ষা, অভিমান,  প্রেম, বিচ্ছেদ,  ভালোবাসার মতো কিছু শুদ্ধতম অনুভবের ভিড়ে। 
এই সুন্দর প্রচ্ছদের ভেতরকার প্রতিটি গল্পই আলাদা রকমের সুন্দর। প্রতিটি গল্প আমাদের নতুন কোনো অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাসনিয়া আপুর লেখা এটাই আমার প্রথম পড়া বই। পড়া শেষে একরাশ স্বস্তি নিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়েছি।  এই তো! 🌸
‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ নামটা রোম্যান্টিক; তাহলে গল্পগুলোও কি সব রোম্যান্টিক জনরার? 
না। গল্পগুলো জীবনের; গল্পগুলো বাস্তবতার। এখানে হরর, থ্রিলার, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, রোম্যান্টিক, সামাজিক সব জনরার গল্পই আছে। 
 
গল্পগুলোর সারাংশ এরকম… 
পাঁচতলা—আদনানের নতুন অফিস বিল্ডিং-এর ছয়তলায়। প্রথম দিন লিফটে করে উঠতে গিয়েই সে আবিষ্কার করলো লিফটে ‘ফোর’ বাটনটি নেই। অর্থাৎ লিফটে করে পাঁচতলায় যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। 
কিছুদিন অফিস করার পর সে আরও খেয়াল করলো লিফট কখনো পাঁচতলায় থামে না। 
পাঁচতলা থেকে কেউ লিফটে ওঠেও না। অবাক হয় আদনান। খুঁজে বের করে পাঁচতলার সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলায় উঠতে গিয়ে আরও অবাক হয়। পাঁচতলার দিকে সিঁড়ি উঠে গেছে ঠিকই, কিন্তু পাঁচতলার ফ্লোরে পৌঁছানোর ঠিক আগে দেয়াল বরাবর সিমেন্ট দিয়ে ঢোকার মুখটা বন্ধ। 
অনেক ভেবে পাঁচতলা নিয়ে আর মাথা না ঘামানোর সিদ্ধান্ত নেয় আদনান। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আদনান সত্যিই আর পাঁচতলা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। থাকুক না কিছু ব্যাপার অজানা? 
নতুন অফিসে ভালোই সময় কাটতে থাকে আদনানের। কিন্তু একদিন অফিস শেষে বের হওয়ার সময় হঠাৎ লিফট থেমে যায় পাঁচতলায়। খুলে যায় লিফটের দরজা। তারপর…! 
 
একদিন—মানুষের মনে জানা-অজানা কতো কতো স্বপ্ন থাকে, আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। তেমনই এক আশার গল্প ‘একদিন’। এই গল্পটার কোন সংক্ষেপ নেই। শুধু এতোটুকু বলি, গল্পটা পড়তে পড়তে কোনো এক অজানা কারণে চোখের কোণে জল চলে এসেছিলো। 
 
শান—গভীর রাত। জমিলাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার পরে বেড়ার ফাঁক থেকে দা-টা বের করে নিয়ে তাতে শান দিতে বসে জাহেদা। তার মাথার ভেতর ট্রেনের হুইসেলের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। 
 
অপেক্ষা কিংবা মায়াবতীদের গল্প—আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে মায়াবতীরা ক্যামন হয়? 
আমি বলবো, মায়াবতীরা অভিমানী হয় 
মায়াবতীরা অভিযোগ করে 
মায়াবতীরা আক্ষেপ করে 
মায়াবতীরা রাগ করে 
মায়াবতীরা অপেক্ষা করে 
মায়াবতীরা ভালোবাসে 
হ্যাঁ, মায়াবতীরা এমনই হয়।। 
 
পুতুল দুপুরবেলা নওশীন ঘুমিয়ে পড়লে ফারহানা তার ঘরে ঢুকলো। মেয়েটা কি নিশ্চিন্তেই না ঘুমাচ্ছে। পাশে পুতুলটা রাখা। ফারহানার মনে হলো, পুতুলটা ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার অস্বস্তি হতে লাগলো। সে জোর করে পুতুলটার দিক থেকে চোখ সরালো। 
ফারহানা এগিয়ে গিয়ে খুব সাবধানে পুতুলটা হাতে তুলে নিলো। অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলে গেলো তার শরীরে। কেন যেন মনে হলো, এর মধ্যে অশুভ কিছু একটা আছে। সে স্টোররুমের দরজা খুলে পুতুলটাকে ভেতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো। কিন্তু…! 
 
জলপদ্ম—পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে ভাতের কষ্ট। এই এক ভাতের জন্য এতো সংগ্রাম। ভাতের জন্যই এতো ঝামেলা। ক্ষুধা না পেলে, ভাতের দরকার না হলে এইসব ঝামেলা কখনো হতো না। এই ভাতই সব নষ্টের মূল। আসলে বেঁচে থাকার চেয়ে চিরন্তন এবং আদিম লড়াই আর কিছু নেই। 
 
মতিন সাহেবের একদিন—এই গল্পের সেই ছেলেটির মাঝে আমি নিজেকে দেখেছি, আমার সহপাঠীদের দেখেছি। গল্পটা পড়ে আমার এই শহরের মতিন সাহেবদের একটা প্রশ্ন করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো, “একদিনতো বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে; সেদিন কি জবাব দেবেন?” 
 
তর্জনী—বাবার মৃত্যুর দু’বছর পর তার বন্ধু পরিচয়ে বাড়িতে এলেন জামাল উদ্দীন। আমি তাকে চিনি না। বাবা কখনো তার সম্পর্কে কিছু বলেননি আমাদের। ভদ্রলোক সালাম দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সালামের উত্তর দিয়ে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়াতেই ভদ্রলোকের হাতের দিকে আমার চোখ আটকে গেলো। তার ডান হাতে মোট আঙুল চারটা। ডানহাতের তর্জনীটা নেই! 
 
অধরা—তিথি আপুকে আমি প্রথম দেখি ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু করার সপ্তম দিনে। জুনিয়র আসার পরপর ভার্সিটির ক্লাবগুলির কাজকর্ম বেড়ে যায়। ক্লাবের সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর জন্য বর্তমান সদস্যরা উঠেপড়ে লাগে। তিথি আপুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ফটোগ্রাফি ক্লাবের পরিচয় সন্ধ্যায়। আমি এবং আমার মতো কিছু ভ্যাবলা জুনিয়র, যাদের ফটোগ্রাফি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাদেরকে তিথি আপু একঘণ্টার ডেমো দিলেন। সেই ডেমো খেয়ে বাকিরা উনার ভক্ত হয়ে গেলো আর আমি উনার প্রেমে পড়ে গেলাম। এরপর…! 
 
নয়ন—হঠাৎ অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনলাম। চমকে বাবুল সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি একটা কষ্টের হাসি হেসে খাটের নিচে ইশারা করলেন। আমি তাকাবো না তাকাবো না করেও চাদরটা একটু তুলে খাটের নিচে উঁকি দিলাম। খাটের নিচে অন্ধকার, সেই অন্ধকারের মধ্যেও জমাটবাঁধা অন্ধকার হয়ে এককোণায় একটা অস্পষ্ট অবয়ব। হাঁটুতে মুখ গুঁজে একটা বাচ্চা ছেলে বসে আছে। পচা মাংসের গন্ধ আরো তীব্র হলো। আবছা অবয়বটা মাথা তুলে তাকিয়ে কিছু একটা বললো। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, সে বললো, “আমি নয়ন।” 
 
ঠিকানা—অরুণিমার মুখাগ্নি করলো তার মেজো ছেলে। বড় ছেলে আসতে পারেনি। চিতা জ্বলছে। ধোঁয়ার কুন্ডুলি হয়ে অরুণিমা একটু একটু করে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি দূর থেকে দেখছি আর ভাবছি, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত একটা ঠিকানা খুঁজে পেলো! 
 
প্রথমবার—স্পয়লার দিবো না। একটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের গল্প। ভালো লাগতে বাধ্য। 
 
আঠারোই জুন—’গত কয়েকদিন ধরে আমার ওয়াইফকে আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করে।’ 
আলিফ সোজা হয়ে বসলো। রোগীর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক কতোদিন ধরে আপনার খুন করার ইচ্ছাটা হচ্ছে?’ 
‘ধরেন চার-পাঁচ মাস।’ 
‘শুধু উনাকেই খুন করতে ইচ্ছা করে, না আরো কাউকেও ইচ্ছা করে?’ 
‘শুধু ওকেই। আর কাউকে খুন করতে ইচ্ছা করে না। আপনি জানেন তো, আমি কারো সাতে-পাঁচে থাকা মানুষ না। আমার কেন কাউকে খুন করতে ইচ্ছা করবে? নিজের ওয়াইফকে খুন করতে চাই, এইটা ভেবেই আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে।’ 
 
শহরের উষ্ণতম দিনে—জীবনের ছোট্ট একটা অধ্যায়ের প্রতিফলন মাত্র… 
 
পাঠ প্রতিক্রিয়া 
তাসনিয়া আহমেদ’র দ্বিতীয় ছোট গল্পের বই ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’। ১৪টি গল্প নিয়ে রচিত বইটি নামে রোম্যান্টিক মনে হলেও গল্পগুলো শুধু রোম্যান্টিক নয়। কয়েকটি গল্প অতিপ্রাকৃত, কয়েকটি সাইকোলজিক্যাল আর বাকিগুলো এক একটি বাস্তবতার। মানবজীবনের বিভিন্ন অধ্যায় গল্পের মধ্যে দিয়ে দেখানো হয়েছে। মাত্র ১১০ পেইজের একটা বই। কিন্তু এর বিস্তৃতি ব্যাপক। 
বইটা এক কথায় চমৎকার। একদম “দশে দশ পাইছো” টাইপের আর কী। গল্পগুলোর উপস্থাপন খুবই ম্যাচিউর। মনেই হয়নি লেখক মাত্র দ্বিতীয় বই লিখেছেন। লেখক চাইলেই এখানের কয়েকটা গল্পকে টেনে উপন্যাসে রূপ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। ব্যপারটা বেশি ভালো লেগেছে। 
বইতে অতিরঞ্জিত করে কোনকিছু দেখানো হয়নি। এই বইয়ের গল্পগুলো এতোটাই বাস্তব যে পড়ার সময় এর কোন কোন গল্পে নিজেকে খুঁজে পাবেন অথবা পাবেন আপনার প্রিয় মানুষটিকে। কোন বিরক্তি বা ক্লান্তি ছাড়াই একবসায় শেষ হয়ে যাবে “শহরের উষ্ণতম দিনে”। 

 

প্রচ্ছদ-প্রোডাকশন 
সতীর্থের প্রোডাকশন বরাবরই ভালো। এটারও তাই। আমার পড়া প্রথম বই এটিই ছিল। বইয়ের পৃষ্ঠা, বইয়ের বাঁধাই সবই ভালো। বানান ভুল ত্রুটি ছিল না বললেই চলে। 
আর প্রচ্ছদ..! 
একরকম বলা যায় বইটা আমি শুধু প্রচ্ছদ আর বইয়ের নাম দেখেই কিনেছিলাম। এই বইয়ের গল্পগুলোর মতো করে বইয়ের প্রচ্ছদেও ডুবে যাওয়া যায় 
Happy Reading 
~~~~~~~~~~~~~~~~~ 
[চমৎকার ছবিটি তুলেছেন লেখক নিজেই] 
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?