লিবারেলিজম লেখক : ড. মুহাম্মাদ বিন আহমাদ মুফতি | Liberalism By Dr. Muhammad Bin Ahmad Mufti

  • বই : লিবারেলিজম
  • লেখক : ড. মুহাম্মাদ বিন আহমাদ মুফতি
  • প্রকাশনী : ফাউন্টেন পাবলিকেশন্স
  • বিষয় : দর্শন বিষয়ক বই
  • অনুবাদক : আবদুল করিম নোমানী
  • পৃষ্ঠা : 64, কভার : পেপার ব্যাক
ইউরোপ থেকে উঠে আসা প্রতিটি চিন্তাই মূলত সেখানকার সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনা, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। ফলে পশ্চিমের নিজ ঘরে তার উৎপাদিত চিন্তার যথার্থতা কতটুকু; তা আলোচনার বিষয় হলেও মুসলিম প্রাচ্য যে কোনোভাবেই এই চিন্তার প্রয়োগক্ষেত্র নয়, সে কথা অনায়াসেই বলা যায়।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের অন্ধকারের প্রহরীরা ক্রুসেডের আয়োজনে যখন মুসলিমবিশ্বে পদার্পণ করে, ইসলামি সভ্যতার তীব্র আলো ঝলকানিতে তাদের দৃষ্টি ধাঁধিয়ে যায়। কয়েক শতাব্দীব্যাপী হিংস্র বর্বরতা চালিয়েও এই আলোকে সামান্য নিষ্প্রভ করতে তো পারেইনি, উপরন্তু আঁধারের বাসিন্দারা তখন আলোর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু কোথায় পাবে আলো? ইসলামের সুমহান ঐশী আলো গ্রহণ করতে যে তারা প্রস্তুত না! ফলে নিজেরাই নিজেদের জন্য ‘আলো’ তৈরি করতে হয় তাদের, যার নাম এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়ন।
৮. লিবারেলিজম
শতত সম্প্রসারমান এই মহাবিশ্বের যিনি মালিক, যেই মহান সত্তা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই একমাত্র মানবজীবনের জন্য আলো তৈরি করতে পারেন। তার প্রদত্ত আলোর বাইরে মানুষ নিজ থেকে যে আলো তৈরি করবে, তা দিনশেষে অন্ধকারই বৃদ্ধি করবে। এর ব্যতিক্রমও হয়নি। ইউরোপের আলোকায়ন চিন্তার আদর্শিক জায়গা লিবারেলিজম। লিবারেলিজম বা উদারনৈতিকতা ইউরোপে একজন ব্যক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ নির্ধারণ করে। কিন্তু কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই মূল্যবোধ ও জীবনাদর্শের মধ্যে এত বেশি বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্যতার ছড়াছড়ি যে, তা মানুষকে সুস্থ মূল্যবোধ শেখাবে তো দূরের কথা, মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে।
অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তার মতোই এই চিন্তাও উত্তর ঔপনিবেশিক মুসলিম মানসে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং শক্ত ভিত্তি গেড়ে বসেছে। ইসলামের মূল কনসেপ্ট হচ্ছে দাওয়াহ বা মানুষকে সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। লিবারেলিজম একটা সমাজ থেকে এই মূল্যবোধকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামের সার্বজনীন প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে তাকে তার এঁকে দেওয়া সীমানায় বন্দি করে ফেলে।
লিবারেলিজমকে অ্যাকাডেমিকভাবে পাঠ করার মতো বইপত্র বাংলা ভাষায় নেই বললেই চলে। এই ছোট্ট বইটা এই শূন্যতা দূর করার পথে আশা করি একটি মাইলফলক হবে। লিবারেলিজমের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, স্বরূপ ও ইসলামের সাথে এর পার্থক্যের
জায়গাটা খুব সংক্ষেপে তুলে ধরেছে এই বই। কিং সৌদ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ বিন আহমাদ মুফতির এই ছোট্ট পুস্তিকাটি এই বিষয়ের প্রাথমিক পাঠকদের জন্য দারুণ উপকারী হবে আশা করি। বইটি অনুবাদ করেছেন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ও চিন্তক আবদুল কারিম নোমানী এবং দক্ষ হাতে সম্পাদনা করে দিয়েছেন প্রিয় রাকিবুল হাসান ভাই। দুইজনকেই অশেষ কৃতজ্ঞতা। পাঠকরা এর মাধ্যমে সামান্য লাভবান হতে পারলেই আমাদের শ্রম সার্থক বলে বিবেচিত হবে।
পরিশেষে পাঠকদের বলতে চাই, বইটি যদি ভালো লাগে, তাহলে অফলাইনে প্রিয়জনদের মাঝে এবং অনলাইনে বন্ধুদের মাঝে আপনার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে ভুলবেন না। বইটিকে আলোর মুখ দেখাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ও নানা সূত্রে যারা এর সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য রইল অগ্রিম শুভেচ্ছা।
প্রকাশনার পক্ষে আবদুর রহমান আদ-দাখিল ডেমরা, ঢাকা।
অনুবাদক বলেন,
পৃথিবীতে বহু জাতি-গোষ্ঠী ও একাধিক মতাদর্শের মানুষ বিদ্যমান। তাদের মাঝে সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সহনশীলতা। ইসলাম শান্তির ধর্ম হিসেবে সহনশীলতার বাস্তবায়ন করেছে শতভাগ। এর উদাহরণ ইসলামি সভ্যতার অধীনে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠী, যারা নাগরিক পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সব ধরনের অধিকার সমানভাবে ভোগ করে। তাদের দেখা হয়নি জাতপাততান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তাদের প্রতি পোষণ করা হয়নি বর্ণবাদী মনোভাব। ইসলামে সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর ন্যায়পূর্ণ অবস্থান হিংসুক ও পরশ্রীকাতর ব্যতীত কেউ অস্বীকার করবে না। সহনশীলতার এই বাস্তবায়নে ইসলাম ন্যায়-প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যেমন অনড় ছিল, একই সাথে তার অনুসারীদের মনে বহাল রেখেছিল গ্রহণযোগ্যতা ও সত্যযোগ্যতা—আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলাম।
এ গেল সহনশীলতার ইসলামি প্রকৃতি ও স্বরূপ। অন্যদিকে মধ্যযুগীয় ইউরোপের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তৎকালীন সময়ের নিপীড়ন-নির্যাতন, অনাচার, মূর্খতা, জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিরোধিতা সে যুগকে দিয়েছিল ‘অন্ধকার যুগে’র অবিধা। সেখানকার ধর্মব্যবস্থা কাবু হয়ে পড়েছিল পোপতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদে। পোপরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য অবলম্বন করে অনৈতিক সব কর্মকাণ্ড, প্রতিহত করে জ্ঞানচর্চা ও শুভবুদ্ধির উদয়। কেননা এসব হতে থাকলে তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকবে না, গোমর ফাঁস হয়ে যাবে, মানুষকে ধর্মের নামে যে দীর্ঘদিন ভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে রেখেছিল, তাও প্রকাশ পাবে সবার সামনে। তাই তারা নিজেদের কর্তৃত্বের মুখে অশনি হুমকি জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে হলো সিদ্ধহস্ত, কঠোর হাতে দমন করতে থাকল জ্ঞানী ও জ্ঞান চর্চাকারীদের।
বস্তুত ইউরোপের পোপদের এই ধরনের কঠোরতা বা অসহিষ্ণুতার বিপরীতে উদারতাবাদ ও সহনশীলতার ধারণা প্রতিষ্ঠা ছিল সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তা প্রতিষ্ঠিত হয়। পোপতন্ত্রের স্বৈরাচার স্বেচ্ছাচার মুখ থুবড়ে পড়ে। বিপরীতে জয়ী হয় বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা, প্রগতিবাদী ধারণা। যেহেতু তাদের এসব কার্যক্রম তথাকথিত ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাই উদারবাদ ও সহনশীলতার মতো ধারণার ভিত্তি হয় ধর্ম-বিদ্বেষ, সাথে যুক্ত হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, আপেক্ষিকতাবাদ, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। ইউরোপে এসব ধারণা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এসব ধারণার ইসলামীকরণ করে মুসলমানদের মধ্যে প্রসারের প্রচেষ্টা।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ এসব বিষয় নিয়ে। লেখক এখানে প্রথমত লিবারেল সহনশীলতার সংজ্ঞা, সংজ্ঞা-সংশ্লিষ্ট আলোচনা (ফাওয়ায়েদে কুয়ুদ) করেছেন। এরপর আলোচনা করেছেন ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে সহনশীলতার উদ্ভব নিয়ে। এ ক্ষেত্রে আলোকপাত করেন গির্জা ও চার্চের স্বৈরাচার নিয়ে। এভাবে আলোচনার ধারাবাহিকতায় সহনশীলতার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা, আপেক্ষিকতা, বহুত্বতা গণতন্ত্রের সম্পৃক্ততার বিষয়ে 3 আলোকপাত করেন।
লেখক সর্বশেষ অলোচনা করেন গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রশ্ন নিয়ে :
এক. পাশ্চাত্যের মতো যে সমাজের জীবনব্যবস্থা ব্যক্তিগত সুবিধা ও স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, সেখানে কি সহনশীলতা বাস্তবায়ন হতে পারে?
দুই. দেশে যদি কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তবে পশ্চিমা সহনশীলতা তাদের ধর্মীয় মতাদর্শে নেতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত করা ব্যতীত বাস্তবায়ন হতে পারে?
তিন. বহুত্ববাদ কী বাস্তবেই এমন এক অধিকার, যার অনুসরণ করতে হবে এবং সমাজে আবশ্যিকভাবে তার বাস্তবায়ন করতে হবে?
লেখক যৌক্তিকভাবে এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেন, সাথে এটাও সাব্যস্ত করেন, তথাকথিত অর্থে সহনশীলতার ধারণা গ্রহণ করার
মানে হচ্ছে ইসলামের মৌলিক ভিত্তিকে অবমূল্যায়ন করা, ইসলামি শিক্ষা থেকে উৎসারিত মূল্যবোধের অবজ্ঞা করা, যার অনিবার্য ফলশ্রুতি হচ্ছে—
  • উপাস্যের স্থানে প্রকৃতিকে রাখা
  • ওহির স্থানে যুক্তিকে রাখা
  • আল্লাহর স্থানে মানুষকে রাখা
  • আল্লাহ প্রবর্তিত আইনকে মানব-প্রবর্তিত আইন দ্বারা
  • প্রতিস্থাপিত করা।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি ছোট হলেও নির্দিষ্ট বিষয়ে আনুষাঙ্গিক সব আলোচনা হয়েছে। লেখক পশ্চিমা সহনশীলতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। যদিও তিনি প্রতিউত্তরের ক্ষেত্রে সংক্ষেপ করেন; তবে তার আলোচনার ধরন ছিল বৈষয়িক ও বস্তুনিষ্ঠ।
আবদুল করিম নোমানী
১৬ জুলাই, 2022 চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা।
তথাকথিত সহনশীলতার ধারণা বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ওপর আমেরিকা কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া এক পরিভাষা। যা বর্তমানে প্রচলিত লিবারেলিজম, ডেমোক্রেসি ও নাস্তিকতার সাথে সম্পৃক্ত। ফলে এটি তাদের অন্যান্য লিবারেল দাবিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা মুখরোচক দাবি বৈ কিছু নয়। তাই অন্যের অধিকার রক্ষার আলাপ তাদের ‘সাম্য’ ‘স্বাধীনতা” ও ধর্মীয় মুক্তির সভ্যতার অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়।
অনেক লেখক-গবেষক এ তথাকথিত সহনশীলতাকে ইসলামি সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। ফলে সহনশীলতারও ইসলামিকরণ হয়, যেমন হয়েছে ‘ইসলামি লিবারেলিজম’, ‘ইসলামি ডেমোক্রেসি’, আর ‘ইসলামি বহুত্ববাদ’। পশ্চিমা জীবনবোধ আর পশ্চিমা সভ্যতার তল্পিবাহকদের নিকট কোনদিন না আবার নাস্তিক্যবাদও ইসলামের রঙে রঙিন হয়ে যায়!
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের গবেষণা এ কথা বলে যে, লিবারেল সহনশীলতা কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা নয়; বরং কিছু মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেগুলো মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা তৈরি করেছে। ফলে সহনশীলতা টিকে থাকতে হলে, গোটা সেটটা টিকে থাকতে হবে। সেই সেট না থাকলে সহনশীলতাও থাকবে না। এমনকি এই সেটের কোনো অংশ হারিয়ে গেলেও লিবারেল সহনশীলতার কোনো অর্থ থাকে না। নীতিগুলো হচ্ছে—
১. ধর্মনিরপেক্ষতা (ধর্মহীনতা)
২. আপেক্ষিকতা
৩. বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?