রোজার মাসে কেন তারাবির নামাজ পড়ে? Blog

রোজার মাসে কেন তারাবির নামাজ পড়ে

by অপূর্ব চৌধুরী 

এক পরিচিতা ফোন করলেন । তার কিশোরী মেয়েটির একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না । 

প্রশ্নটি ছিল, 

— আম্মু, তারাবির নামাজ কেন রোজার সময় পড়ে ? 

মেয়ের মা ফোন করে বললেন, 

— ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, মুরুব্বি আত্মীয়দের জিজ্ঞাস করলাম, এক পরিচিত ইমামকেও ফোন করলাম, কোথাও কোনো সন্তোষজনক উত্তর পেলাম না । শেষে মেয়ের বাবা বললেন, চৌধুরী সাহেবকে ফোন করো, নাস্তিক হলেও ইসলামের উপর আলোচনা শুরু করলে মাওলানা চৌধুরী মনে হয় ! 

হালকা হাসির পর্ব শেষ হলে বললাম, 

— ফোন টা দেন মেয়েকে । 

কন্যাকে ফোন ধরিয়ে দিতেই বললাম, 

— মামনি, বল তোমার প্রশ্ন ! 

মুখের কাছেই হয়তো প্রশ্ন রেডি ছিল, বললো, 

— আংকেল, রোজার সময় তারাবির নামাজ পড়ে কেন ! 

— ওকে মামনি, সহজ করে স্টেপ বাই স্টেপ বলবো, তুমি মনোযোগ সহকারে শুনবে ! 

— ওকে আংকেল ! 

প্রথম : তারাবি একটি নফল প্রাথর্না, কারো কারো মতে সুন্নত । নফল মানে— যা করা তোমার ইচ্ছার স্বাধীনতা, সুন্নত মানে— যা সবসময় করাটা বাধ্যতামূলক নয়, মহানবী মুহাম্মদ কখনো কখনো করতেন বলে মুসলিমরা তা করতে পছন্দ করে । তারাবির দুটি ভিন্ন মতের কারণ হলো — মহানবী মুহাম্মদ তার জীবনে একেক সময়ে একেকভাবে এই এক্সট্রা নামাজগুলো পড়তেন, কখনো একেবারেই পড়তেন না । তিনি কখনো আট, কখনো বারো, কখনো বিশ রাকাত পড়তেন । 

তাই তারাবি পড়ার প্রথম কারণ — মহানবী মুহাম্মদ পড়তেন । 

দ্বিতীয় : তিনি কখনো মসজিদে গিয়ে পড়তেন, তার পিছনে তখন সাহাবীরা দাঁড়িয়ে যেত, তিনি কখনো ঘরে একাকী পড়তেন এই কারণে যে— 

 সাহাবীরা যাতে এটাকে জামাতের সাথে মসজিদে পড়া আবশ্যকীয় না করে । উমরের আমলে খলিফা নির্দেশ জারি করেন জামাতের সাথে একত্রে পড়তে, সেটাই এখন সুন্নি মুসলিমরা মানে । শিয়া মুসলিমরা তারাবি পড়েন না । 

সুতরাং, তারাবি পড়ার বর্তমান আবশ্যকীয় কালচার মহানবী মুহাম্মদ কর্তৃক চালু নয়, এটা মুসলিমরা পরবর্তীতে রমজানের সময় আবশ্যকীয় করে তুলেন । 

তৃতীয় : সুন্নি মুসলিমদের মাঝে এক মাসে ত্রিশ পারা কুরআনের তেলোয়াত শুনে শুনে জামাতে নামাজ পড়ার বর্তমান যে কালচার— এটাও ইসলাম প্রবর্তনের চারশো বছর পরে চালু হয় । মহানবী মুহাম্মদ, পরবর্তী চার খলিফা, এমনকি সাহাবাদের জীবদ্দশায় কুরআনের ত্রিশ পারার আলাদা কোনো ভাগ ছিল না । এই ত্রিশ পারার কনসেপ্ট চালু হয় এগারো শতাব্দীর দিকে যখন সাধারণ মুসলিমরা সমগ্র কুরআন কেনার সামর্থ রাখতো না । বেশিরভাগ কোরআনের একটি বা দুটি হাতে লেখা খণ্ড মসজিদগুলোতে থাকতো, সেগুলো কপি করা হতো খলিফা উসমানের আমলে সর্ব প্রথম একত্র করে এক খণ্ড করা কোরআন থেকে । খলিফা উসমান সাতটি কপি করে বাকি বিচ্ছিন্ন কপিগুলো ধ্বংস করতে নির্দেশ দেয় । হিজাজী স্ক্রিপ্টে লেখা উসমানের সেই কোরআনের কিছু অংশ এখনো প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরি এবং মস্কোতে রাশিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আছে । এর আগ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কোরান বলে কিছু ছিল না ! ওই সময়টিতে কোরআনকে ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করে এক একটি পুস্তকের মতো করে রাখা হতো, যাতে মুসলিমরা পড়তে পারে ! রমজানের ত্রিশ দিনে ত্রিশটি এমন খণ্ড তেলোয়াত করার একটি কালচার সেই সময় থেকেই জনপ্রিয় হয় । সেই থেকে লোকে তারাবিতে সমগ্র কুরআন একবার শেষ করার নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ! কোরআনের সেই ভাগগুলো পারা হিসাবে পরিচিতি পায় । 

সুতরাং, তারাবির নামাজ লোকেরা বর্তমান যে পদ্ধতিতে পড়ে, সেটা মহানবী মুহাম্মদ বা তার সাহাবীদের পন্থায় নয়, পরবর্তীতে একটি পদ্ধতি সহায়ক ছিল বলেই— তারাবি পড়ার একটা কালচার হয়ে গেলো সেটাই ! 

একটু দম নিয়ে আবার শুরু করে বললাম, 

মামনি, এতক্ষন তারাবির ইতিহাসটুকু বললাম এই জন্যে যে— এটা কেন পালন করছে, কিভাবে পালন করছে, তার গোড়ার কথা, বিবর্তনের কথা জানলে, কারণটি বুঝতে সহজ হবে । আর এই ইতিহাসটুকু ধর্মের ইতিহাস, ধর্মের আইনের ইতিহাস এবং যে কোনো ধর্মে— কেন কিছু করে — এটার প্রথম  উত্তর — তার ইতিহাসে । এইভাবে করতো বলেই এখনো তা করে ! 

এবার তোমার প্রশ্নের মনস্তত্ব এবং দর্শনগত উত্তর দেব ! এই ব্যাখ্যা আমার নিজের অনুধাবন । 

মহানবী মুহাম্মদ তার জীবনে কিছু চিন্তা না করে করতেন না । তিনি গভীর চিন্তাশীল একজন মানুষ ছিলেন । চারপাশের সমস্যাকে বাস্তবিক এবং মানবিক চোখে দেখতেন । রোজা বা উপবাস রীতি ইসলাম পূর্ব আরবদের পৌত্তলিক ধর্মে আগে থেকেই চালু ছিল, সাথে ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মেও এটা চালু ছিল এবং আছে । পৃথিবীর অনেক ধর্মহীন সংস্কৃতিতেও উপবাস রীতি চালু আছে । 

রোজার প্রধান উদ্দেশ্য মহানবী মুহাম্মদ ভাবতেন এই ভাবে যে : বছরের এগারো মাসের জন্যে একজন ভালো মুসলিম তৈরী করতে শারীরিক ট্রেইনিং । দিনের বেলায় এমন উপবাস তার দেহ-মন-স্রষ্টাকে সার্বক্ষণিক স্মরণ, নিয়মাবলী অনুসরণ, এবং ভাবনার মধ্যে জাগ্রত রাখে । উদ্দেশ্য থাকে— শরীরকে যাবতীয় ক্ষুধা এবং বিভিন্ন চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন করে মনের একটি উর্ভর ক্ষেত্র তৈরী করা । জমি প্রস্তুত হলো, এখন বীজ না বুনলে ফসল তো পাবে না ! তারাবির দীর্ঘ নামাজ হলো— এই বীজ বোনা, মনের বীজ বোনা । সহজ করে বললে— মনের মেডিটেশন । বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে দীর্ঘ সময় তারাবির নামাজ হলো মনকে পরিশুদ্ধ করার দীর্ঘ প্রাথর্না । 

পুরো কথাগুলো এক করলে বলা যায় — 

দিনের বেলা রোজা হলো শরীরের পরিশুদ্ধি, রাতের তারাবি হলো মনের পরিশুদ্ধি । 

পুরোটা মিলে এক মাসের রোজা হলো নিজেকে বাকি এগারো মাসের দূষিত অবস্থা থেকে পরিশুদ্ধি, এবং পরবর্তী এগারো মাসের জন্যে প্রস্তুতি । 

এমন করে কি বর্তমান মুসলমান রা ভাবে ? যদি ভাবে, তারা কি কেউকে হত্যা করতে পারে ? খারাপ কাজ করতে পারে ? দুর্নীতি করতে পারে ? কারো ক্ষতি করতে পারে ? এমন করে রোজা রাখলে তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের কখনো কি ছোট করতে পারে ? এমন করে নিজেকে শুদ্ধ করে নিলে যে কোনো অপরাধ – অমানবিকতা – অরাজকতা – অসামাজিকতা থেকে চাইলেই সহজে নিষ্কৃতি পেতে পারে । 

ধর্মের উন্মত্ততা মূর্খতা, যার যার ধর্মের নিয়মগুলো নিষ্ঠার সাথে মেনে চলা নিজেরই শুদ্ধতা ।

© Opurbo Chowdhury 

ছবি : কোরআনের ক্যালিওগ্রাফি ( সংগৃহিত )

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?