বই: অশনি সংকেত
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
রিভিউ: বীথি আক্তার
এক বেলা খেতে না খেতেই আর এক বেলা কী খাওয়া হবে সে চিন্তা। আবার কখনো পেট পুরে তো কখনো আধ পেট খেয়ে থাকা। কিন্তু কেমন হবে/হয় যদি বাজার থেকে কেনার সামর্থ্য আছে অথচ বাজারেই চাল নেই; সর্বত্র চালের আক্রা! কেরোসিন নেই! দেশলাই নেই! চারপাশে শুধু নেই নেই হাহাকার। আর এই হাহাকার খুব অল্প সময়ে পটভূমি পরিবর্তন করে দেয়, অবস্থাপন্ন মানুষকেও বাধ্য করে অন্যের দোরে হাত পাততে। ভাবনার মানস চোখে আঁকা এসব দৃশ্যপটকে জীবন্ত অনুভব করতে চাইলে পড়তে পারেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’।
১৯৪৩ বাংলা ১৩৫০, বাংলার ইতিহাসে কুখ্যাত মন্বন্তর হিসেবে খ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সর্বত্র। ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ করছে, চালান বন্ধ আর সেসবের প্রভাবে বাংলার গ্রাম অঞ্চলে দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সংকট। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে শুকিয়ে অকালে ঝরে যায়। এ সময় “পথের পাঁচালি” খ্যাত বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কলমের ডগায় চিত্রিত করেন দুর্ভিক্ষের জীবন্ত আখ্যান ‘অশনি সংকেত’। উপন্যাসটি ১৩৫০-৫২ বঙ্গাব্দে ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৩৫৪ সালে পত্রিকারটির অবলুপ্তি হলে উপন্যাসটির প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৫৯ সালে লেখকের মৃত্যুর পর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘অশনি সংকেত’। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়।
নদীর ঘাটে স্নানরতা দুইজন গ্রাম্য বধূর কথকতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। দশ বারো বছর আগে নদীতীরে গড়ে ওঠা নতুন গাঁ এর বাসিন্দা মোটে কয়েকটি কাপালী ও গোয়ালা পরিবার এবং একটি ব্রাহ্মণ পরিবার। এই ব্রাহ্মণ পরিবারের কর্তা গঙ্গাচরণ চক্কতি। স্ত্রী অনঙ্গ এবং দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। শিক্ষিত এবং খানিক চতুর গঙ্গাচরণ চরিত্রটিকে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যাকে বিভিন্ন ডাইমেনশনে ব্যাখা করা সম্ভব। তবে সবচেয়ে স্পষ্ট যে বিষয়টি নজরে পরে তা হলো জাত ভেদ। “ব্রাহ্মণ্যের ছেলে হয়ে কি কাপালীর ছেলের মতো দা কুড়াল হাতে থাকবি দিনরাত?” কিংবা “তোমাদের উচ্ছিষ্ট কলকেতে আমি তামাক খাব?” – এই উক্তিগুলোতে জাতি ভেদ স্পষ্ট দৃশ্যমান। জীবিকার সন্ধানে বউ সন্তান নিয়ে নিজ গ্রাম ছাড়ে গঙ্গাচরণ। পারতপক্ষে এমন সব গ্রামে সে অবস্থান নিয়েছে যেখানে ব্রাহ্মণের বাস নেই; এতে ওই গ্রামে তার পসার থাকবে না ভাবনায়। ক্রমে ব্রাহ্মণ পরিবার হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করে। নতুন গাঁ গ্রামে পাঠশালা পড়িয়ে, কখনো পুরোহিতের কাজ করে কখনো বা বদ্দি হিসেবে গঙ্গাচরণের দিন সুখেই কাটতে থাকে। চারপাশের কানাঘুষায় একদিন শোনা যায় বাজারে চাল, তেল পাওয়া যাচ্ছে না। চার টাকা চালের মণ একদিনের ব্যবধানে ছয় টাকা, দশ টাকা এমনকি বত্রিশ টাকা হয়ে যায়। একটা সময় গিয়ে আর পাওয়াই যায় না। যাদের ধান, চাল মজুদ ছিলো তারাও একটু বেশি টাকা পাবার আশায় সব বিক্রি করে দেয়। শুরু হয় ফ্যান, কচু, শাক, লতা পাতা খাওয়া। ভিখিরির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে গঙ্গাচরণের ঘরে আসে তৃতীয় সন্তান। এছাড়া দূর্গা বাড়ুয্যে নামক আর একটি ব্রাহ্মণ পরিবার এসে আশ্রয় নেয় গঙ্গাচরণের বাড়িতে। কাপালীদের এক বউ না খেতে পেয়ে নিজ সংসার ছেড়ে আর একজনের সাথে পালিয়ে যায়। বেলা গড়তে না গড়তে নদীর হাঁটু জল পানিতে মানুষ খুঁজতে থাকে মাছ, জলজ ফল। তারপরও মানুষ বাঁচতে চায়, বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পথের ধারে মতি মুচিনীর মৃত্যু সবার মধ্যে ভয় ধরিয়ে দেয়। লোকজন গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটতে থাকে। তবে জাতিভেদ ঘুচে মনুষ্যত্বেরও উল্লেখ পাওয়া যায় শেষটায়!
গঙ্গাচরণ চরিত্রের আর একটি বিষয় আলাদা করে উল্লেখ করবার দাবী রাখে। প্রথমেই উল্লেখ করেছি গঙ্গাচরণ পাঠশালা চালায় পাশাপাশি পুরোহিত এবং বদ্দির কাজও করে। শিক্ষা, ধর্ম বিশ্বাস এবং চিকিৎসাকে পুঁজি করে যেকোনো জায়গা দখলে রাখা সম্ভব তা বেশ সুক্ষ্মভাবে নিয়ে এসেছেন বিভূতিভূষণ। “সব দিক থেকে বেঁধে ফেলতে হবে ব্যাটাদের।” – এই উক্তিটি স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে কাউকে অধিকারে রাখার। এছাড়া উপমহাদেশে স্যার ডাকার বিষয়টির রেফারেন্স পাওয়া যায়। “গুরুমশায় কী রে? সার্ বলবি। শিখিয়ে দিইচি না?”
অন্যদিকে অনঙ্গ চরিত্র নারী জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। নিজে না খেয়ে স্বামী সন্তানের জন্য রেখে দেয়া, অতিথি পরায়ণ অনঙ্গ সকলের কাছে পরিচিত বামুন দিদি হিসেবে। একদিন এই বামুন দিদির কথাতেই সংসার ছেড়ে যাওয়া কাপালী বউ ফিরে আসে। স্বামীকে লুকিয়ে অন্যের বাড়িতে ধান ভাঙ্গার কাজ করে, শাক, লতা, মেটে আলু কুড়িয়ে স্বামী ছেলের মুখে তুলে দেয়। ক্ষান্তমনি নামে আর একটি চরিত্র লুকিয়ে গঙ্গাচরণের হাতে চাল তুলে দেয়। আর এক কাপালী বউয়ের কথার মধ্যে ফুটে ওঠে নারী চরিত্রের আর একটি দিক “তুই সব্বস্ব উটকে বের করবি। তোর জ্বালায় ঘরে কিছু থাকবার জো আছে? আমি যাই গিন্নি, তাই সব জিনিস যোগাড় করে তুলে লুকিয়ে রেখে দি, আর তুই সব উটকে উটকে বার করিস।” আলাদা করে একটু রেখে দেয়া এবং প্রয়োজনের সময় বের করে নিয়ে আসা আমাদের পরিবারের গিন্নিদের মধ্যেই দেখা মিলে। একে অপরের পাশে থেকে সংসার এগিয়ে নিয়ে যায় আমাদের গিন্নিরা। এছাড়া বইটিতে চোরাচালান বা মজুদদারীর বিষয়টিও নজরে আসবে।
সর্বশেষ প্রকৃতি। লেখক যখন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তখন প্রকৃতি আসবে না বা থাকবে না এটা পাঠক মাত্র আশ্চর্য হবেন। উপন্যাসের শুরুতেই অনঙ্গ বউয়ের হাসির কারণ ছিলো তাদের আগের গ্রামের পদ্মবিল। নামে পদ্মবিল হলেও চৈত্র মাসে তার জল যায় শুকিয়ে। এছাড়া কথার ফাঁকে সূর্য পাটে গেছে, গাছের ডগায় রাঙা আলো, চাঁদনী রাত, কাপালী বউয়ের যদু পোড়ার সাথে দেখা করে আসার পথে দু চারটে জোনাকির আলো, জোড়া নৌকাতে গরুর গাড়িসুদ্ধ পার হওয়া, ঘেঁটুফুল, আমের বউলের মিষ্টি সুবাস পাঠককেও সুবাসিত করবে। এছাড়া অনঙ্গ বউয়ের নদীর পাড়ে বাড়ি করবার বাসনা পাঠকের মনেও বাসনা জাগাবে।
এখন পাঠক হিসেবে নিজস্ব অভিমত যদি বলি বিভূতিভূষণকে নিয়ে লেখা সত্যিই দুরূহ। প্রত্যেক চরিত্র, প্রত্যেক লাইন, প্রকৃতি সমস্ত কিছু লেখক এতো নিখুঁতভাবে এবং বড় কিছুর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে লিখে গেছেন যে তা ধরা বা আলাপে নিয়ে আসা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অনেক কঠিন লাগে। তারপরও ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। ‘অশনি সংকেত’ দুর্ভিক্ষের এক জীবন্ত আখ্যান। এই বই একবার হলেও সবার পড়া উচিত। খাবার নষ্ট করার আগে ভাবতে বাধ্য হবেন। এমনও হতে পারে মতি মুচিনীর মুখ আপনার সামনে ভেসে উঠছে! আমি পড়ার সময় দুর্ভিক্ষের বাইরেও ছোটো যে দুই একটি বিষয় নজরে এসেছে তা নিয়ে কথা বলেছি। ওই রূপ খাদ্য সংকট এবং ক্ষুধার তাড়না আমার পক্ষে অন্তত সম্ভব না লেখায় নিয়ে আসা।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?