যাপিত জীবন বাংলা বুক রিভিউ by shariful islam

 

যাপিত জীবন 

সেলিনা হোসেন 

১৯৪৭ সালের শেষভাগ। বহরমপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় আশ্রয় নেয় সোহরাব আলি – আফসানা খাতুন দম্পতি ও তাদের তিন ছেলে মারুফ, জাফর ও দীপু। একে তো সাত পুরুষের ভিটে ছাড়ার কষ্ট, তার সাথে ওদের জীবনে যুক্ত হয় দাঙ্গার রক্তাক্ত অধ্যায়, পথের ক্লান্তি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা বাড়িতে উঠলেও তাই নিজেদের ঠিকমতো খুঁজেই পায় না ওরা। আর যতক্ষণে একটু গুছিয়ে উঠেছে, ততক্ষণে পরিবারের একেক সদস্য একেক দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

জাফর জড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির সাথে। তমুদ্দিন মজলিসের পুস্তিকা থেকে শুরু করে, ধীরেন্দ্রনাথের বাংলা ভাষার পক্ষে দাবি, শহীদুল্লাহর বাঙালি পরিচয়কে বড় করে দেখার ঘোষণা বা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রতিবাদ সমাবেশ – প্রতিটা আন্দোলনেই জাফর যোগ দেয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সাথে রাজপথ থেকে পাওয়া সঙ্গী আঞ্জুম তো আছেই। সোহরাব আলি রাজনীতির টুকটাক খোঁজ রাখলেও তার প্রধান কাজ তার স্বপ্নের হাসপাতাল তৈরি করা যা এলাকার হতদরিদ্রদের দেবে চিকিৎসার জাদুর ছোঁয়া। মারুফ দুনিয়া থেকেই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, বহরমপুরে ফেলে আসা মনিকা সেনকে যে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না কিন্তু ইদানিং বন্ধুর বোন সুমনা তার মধ্যে যেন এক পরিবর্তন সঞ্চার করে। একদিকে সমূলে উৎপাটিত এক পরিবারের নতুন মাটিতে শেকড় তৈরির চেষ্টা আর আরেকদিকে ভাষার প্রশ্নে দেশের রাজনীতির পটপরিবর্তন – এই দুইকে সামনে রেখেই এগিয়ে চলে বইয়ের কাহিনী।

ঐতিহাসিক উপন্যাস আমার সবসময়ই ভালো লাগে কেননা এতে ইতিহাসের খটমটে বিষয়গুলো জানা যায় অতি সহজে। কিন্তু এজন্য লেখকের কাছে দাবি থাকে লেখক তাঁর সৃষ্ট চরিত্র/চরিত্রগুলোকে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের সাথে এমনভাবে মিশিয়ে দেবেন যাতে ইতিহাস আর ফিকশনকে আলাদা না করা যায়। কাজটা বেশ জটিল একটা কাজ, তাইতো মাঝে মাঝেই হতাশ হতে হয় এই জনরায়।

‘যাপিত জীবন’ তেমনই একটা হতাশার নাম। লেখিকা প্লটটা বেছে নিয়েছিলেন চমৎকারভাবে ; সীমান্ত পার হওয়া এক পরিবারের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনকে ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তিনি যে দুইটা জায়গায় ব্যর্থ হয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে সেটা হলো প্রথমত তিনি সোহরাব আলির পরিবার বা জাফর-আঞ্জুমের প্রেমে বড্ড বেশি সময় ব্যয় করেছেন যা মূল প্লটটাকেই সাবপ্লট বানিয়ে ফেলেছে আর দ্বিতীয়ত তিনি যেটুকু ইতিহাস বলেছেন সেটুকুও এতটা পরোক্ষভাবে বলেছেন যে তার সাথে কানেক্ট করতেই সমস্যা হয় অর্থাৎ ইতিহাসের পটপরিবর্তনগুলোতে তিনি জাফরকে সক্রিয় করতে পারেন নি। ফলে একটা ঐতিহাসিক উপন্যাসের পরিবর্তে বইটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জাফরদের পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর মাঝে মাঝে একটু-আধটু ইতিহাস

আরেকটা বড় ধরনের সমস্যা লক্ষ্য করেছি সংলাপের জায়গাগুলোতে লেখিকার ভাষার ব্যবহারে। সংলাপগুলো মাঝে মাঝে খুবই দার্শনিক হয়ে দাঁড়িয়েছে আবার মাঝে মাঝে তা এত মেকি আর ন্যাকা মনে হয়েছে যে বিরক্তি সৃষ্টি করেছে। জাফর-আঞ্জুমের প্রতিটা সংলাপ এতটা মেকি, বিরক্তিকর আর একই প্যাটার্নের যে অবাক হতে হয়। এক ‘ এই মুহূর্তে আমি তোমার কি’ জাফরের এই প্রশ্নটাই আছে দশ-পনেরো বার। আর প্রতিবার আঞ্জুমের উত্তরগুলোও ছিল ন্যাকামিতে ভরপুর ; চকখড়ি থেকে শুরু করে টুনটুনি, শীতের বেলা, রোদের বিকেল, ফুলের বন, মধুমাস, চোখের জল, কৃষ্ণচূড়া থেকে মিছিল পর্যন্ত। 

চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে কিছু কিছু সংলাপ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বলেও অনেক জায়গায় মনে হয়েছে। ১৯৪৭ এ সীমান্ত পাড় হওয়ার পরপরই সোহরাব আলির মুখ দিয়ে আরেকবার দেশের আমূল পরিবর্তনের কথা বলানো বা সাতচল্লিশেই জাফরের ভাষা আন্দোলন নিয়ে ঠিক ঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করানো চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কি! মোটকথা চরিত্রগুলো রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠতে পারে নি, মেকি মেকি ভাব রয়ে গিয়েছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। শুরু থেকেই জাফরের ‘ প্রয়োজনে প্রাণ দেব’ বুলি মুখস্তের মতো আওড়ানোও বেশ বিরক্তিকর লেগেছে।

এছাড়া ধীরেন্দ্রনাথ চরিত্রটাকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া, কিছু জায়গায় ইংরেজি সংলাপগুলো বাংলায় লেখা, কিছু তথ্যগত অসঙ্গতি তো রয়েছেই।

মোটের উপর বলতে গেলে বইটা হতাশ করেছে। চরিত্রগুলোর ইতিহাসের সাথে মিশে যেতে না পারা, চাপিয়ে দেওয়া কিছু চিন্তা, ন্যাকামো মার্কা কিছু সংলাপ ইত্যাদিকে কারন বলা যেতে পারে। কিন্তু এসবের পরেও বইটার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক ঘটনাগুলো জানা যায় – যা বইটার একটা পজিটিভ দিক।

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?