যাদুস সালেকিন : ইসলাহে নফসের পথ ও পাথেয়

যাদুস সালেকিন : ইসলাহে নফসের পথ ও পাথেয় (পেপারব্যাক)

লেখক : মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান
প্রকাশনী : মাজলিসে দাওয়াতুল হক
বিষয় : আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা
পৃষ্ঠা : 360, কভার : হার্ড কভার
আইএসবিএন : 9789843512451, ভাষা : বাংলা

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের লাখো কোটি শুকরিয়া যে, তিনি দয়া করে আমাদের মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের নির্বোধ কোনো জন্তু বানাতে পারতেন। তাতে আমাদের বলার কিছুই ছিল না। মানুষ থেকে পশুর গুণ ভিন্ন। সৃষ্টিগতভাবেই আল্লাহ পাক মানুষের মধ্যে এই গুণ রেখেছেন, তাকে দেখলেই অন্তরে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি, মায়া মমতা জাগ্রত হবে, কিন্তু পশুর বিষয়টা এর থেকে ভিন্ন। তাকে দেখলেই ভয় লাগে। ছোট্ট একটা পিঁপড়া দেখলেও ভয় লাগে, কামড় দেবে বলে। তার বুদ্ধি নেই। পিঁপীলিকা এত বুদ্ধিহীন, এই সাধারণ বিষয়টিও বোঝে না যে, আমি যাকে কামড় দিচ্ছি সে যদি পা দিয়ে ঘষা দেয় তাহলে আমি শেষ।
সিংহ যদি বুঝতে পারত, আমাকে মানুষে ঘেরাও করে গুলি করে মারতে পারে তাহলে সে কখনো বের হত না। সাপও যদি এ বিষয়টা বুঝত, তাহলে গর্ত থেকে বের হত না। এমনিভাবে সব পশুই নির্বোধ। গরু, মহিষ, বকরি ইত্যাদি গৃহপালিত পশু যদি বুঝত, মানুষের সঙ্গে থাকলে শেষ পরিণতি হবে জবাই, তাহলে কি মানুষের কাছে আসত? মানুষ বোঝে, কে তার শত্রু, কে তার মিত্র; কিন্তু অন্যান্য জন্তু জানোয়ার এসব বুঝে
না। আল্লাহ পাক বলেছেন:
ه ونفس وما سواها فألهمها فجورها وتقواها قد أفلح من زكاها ؟
“শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন—তার। এরপর মানুষকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের বিবেচনা-জ্ঞান দান করেছেন, যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়।”
 [সূরা শামস : ৭-৯]
অর্থাৎ কোন কাজটা তার জন্য কল্যাণের, মানুষ তা অনুধাবন করতে পারে। কোনো মানুষ যদি এমন হয় যে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাখলুক হওয়ার গুণ নেই, পশুর মতো নির্বোধ, তাহলে পশুর ওপর তার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে এসেছে :
و ولقد ذرانا يجهم كثيرا من الجن والإنس لهم قلوب لا يفقهون بها ولهم أعين لا يبصرون بها ولهم أذان لا يسمعون بها أوليك كالأنعام بل هم أصل
أولئك هم الغافلون *
“আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর আছে, তা দ্বারা কিছুই বোঝে না এবং তাদের চোখ আছে, তা দ্বারা কিছুই দেখে না এবং তাদের কান আছে তা দ্বারা কিছুই শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং তারা সেগুলোর চেয়েও অধিক বিপথগামী। তারাই পরিপূর্ণ গাফেল।
জন্তু জানোয়ার তো সৃষ্টিগতভাবেই নির্বোধ। সে বোঝে না যে, তার আসল কল্যাণ কোথায়? কার সঙ্গে সম্পর্ক করলে, কার আনুগত্য করলে দুনিয়ায় তার লাভ হবে— এ জ্ঞান তার নেই। মূলত মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার দেহের গুণে নয়, বরং তার চিন্তা-জ্ঞান ও দর্শনের গুণে। এই বিষয়টিই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে দিয়েছে। সেই মানুষ আজ বড় ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহ বলছেন :
والعضر إن الإنسان لفي خسير إلا الذين آمنوا وعملوا الصالحات وتواصوا
بالحق وتواصوا بالصبر *
“কসম যুগের (সময়ের), নিশ্চয় মানুষ বড় ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে, নেক কাজ করে এবং পরস্পরকে হকের ওসিয়ত করে ও সবরের তাগিদ করে।”
আলোচনা শুরু করছি কুরআনের ছোট্ট একটি সূরা দিয়ে। এটিকে ‘সুরা আসর’ বলা হয়। এটি ছোট সুরা হলেও এর বিষয়বস্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি একটি ব্যাপক অর্থপূর্ণ সূরা। মানবজীবনের ইহকাল এবং পরকালের সঠিক সফলতার জন্য এই সূরায় প্রদত্ত দিকনির্দেশনা মোতাবিক অনুশীলন এবং আমলই যথেষ্ট হতে পারে।
[সূরা আরাফ : ১৭৯]
[সূরা আসর : ১-৩]
[যাদুস সালেকিন]
এজন্যই হযরত ইমাম শাফেয়ি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন :
لو تدبر الناس هذه السورة لوسعتهم
“যদি মানুষ এই সূরাটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করত, তাহলে তার জন্য এ সূরাটিই যথেষ্ট হতো।*
ইমাম শাফেয়ি রাহিমাহুল্লাহ অন্যত্রে বলেছেন, সুরা আসর ব্যতীত অন্য কোনো সুরা যদি অবতীর্ণ না হত, তাহলে মানুষের হিদায়াতের জন্য এটিই যথেষ্ট হতো।

সৎ হওয়ার গুরুত্ব

সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয় যে, এই সুরাটিতে দুটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। একটি হচ্ছে, নিজের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা। অপরটি হচ্ছে, অন্যের জন্য আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা। একটি হচ্ছে, ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে স্বয়ং নিজে নেক এবং সৎ হওয়া। আর অপরটি হচ্ছে, অন্যদেরকে ঈমান-আমলের প্রতি অনুপ্রাণিত করা; তাদের পরিশুদ্ধির লক্ষ্যে যথাযথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী এ দুটি মৌলিক কাজ সকলের জন্য করা খুবই জরুরি। যারা এই দুটি কাজ সব সময় পালন করে এবং এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তারা তাদের কর্মজীবনে সফলকাম হয় এবং নিষ্ফলতা ও ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তিলাভে সক্ষম হয়। আর যারা নিজের পরিশুদ্ধির গুরুত্ব অনুধাবন করে না এবং নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে উদাসীন হয় অথবা নিজের বেলায় সচেতন বটে, কিন্তু অন্যদেরকে পরিশুদ্ধির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে না—তাদের এ আচরণ মোটেই ভালো নয়।
এরূপ লোকদের ব্যাপারে এই সুরায় বলা হয়েছে—– সময়ের কসম, নিশ্চয় মানুষ বড় ক্ষতিগ্রস্ত।
এ ধরনের মানুষের বিপর্যয়ের জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে, বিশ্বে সংঘটিত ঘটনাবলি। ফেরাউন, কারূন ও নমরুদদের কৃতকর্ম এবং তাদের শোচনীয় পরিণাম এর অকাট্য প্রমাণ। তাদের নিকট বস্তু-সরঞ্জাম কম ছিল না, বরং যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ ও মাল-দৌলত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা মারাত্মক আজাবে পতিত হয়েছে এবং সমূলে ধ্বংস হয়েছে।
[তাফসির ইবনে কাসির : ১/২০৩]
[ রুহুল মাআনি ]
কারণ এটাই যে, তারা কখনো নিজেদের পরিশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি; সৎ এবং পূণ্যবান হতে চেষ্টা করেনি।

ঈমান এবং আমল

নেক ও সৎ হওয়ার জন্য যেমন ঈমানের প্রয়োজন, তেমনি আমলের গুরুত্বও অপরিসীম। কেননা মানবদেহের দুটি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। যেমন, হাত, পা, চক্ষু ও কান—এগুলো হচ্ছে বাহ্যিক দেহের অংশ বিশেষ। আর অপরটি হচ্ছে অন্তর। অন্তর দেহের ভেতরে থাকে। বস্তুত, উভয়টিরই পরিশুদ্ধি আবশ্যক। উভয়টিকেই শরিয়তের বিধি-নিষেধ মোতাবিক গড়ে তোলা জরুরি। উভয়টির পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই একজন মানুষ নেক ও সৎ হতে পারে।

অন্তরের ওপর নিয়ন্ত্রণ

মানুষের শরীরকে যদি একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে শরীরের রাজধানী হচ্ছে অন্তর, যা আয়ত্তে চলে আসলে বাকি অঙ্গসমূহ আপনাআপনি আয়ত্তে চলে আসে। যেমন, কোনো রাষ্ট্র দখল করার জন্য সে রাষ্ট্রের রাজধানী দখলে আনতে পারলেই বাকি অঞ্চলসমূহ নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয় না। এ সম্পর্কিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসটি আমাদের সবার কাছে খুবই প্রসিদ্ধ। হাদিসটি হচ্ছে :
ألا وإن في الجسد مضغة إذا صلحت صلح الجسد كله وإذا فسدت فسد
الجسد كله ألا وهي القلب .
“শরীরের মধ্যে একখণ্ড মাংসপিণ্ড আছে। সেটি পরিশুদ্ধ হলে সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সেটি নষ্ট হলে সমস্ত শরীরই নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেই মাংসপিণ্ডটি হচ্ছে হৃৎপিণ্ড।”
সবার মন রক্ষা করে চলা কঠিন, একজনকে সন্তুষ্ট করলে অন্যজন নারাজ হয়। তবে যদি এমন একজনকে সন্তুষ্ট রাখা যায়, যার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে সমস্ত লোকের সন্তুষ্টি, তাকে সন্তুষ্ট করাই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। যদি আল্লাহ পাককে রাজি-খুশি রাখা যায়, তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই তার কিছু করতে পারবে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ পাক কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে পৃথিবীর কোনো শক্তির সহায়তা তাকে রক্ষা করতে পারবে না। পৃথিবীর সবার সন্তুষ্টি আপনি অর্জন করলেন; কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করলেন না, তাহলে এ সন্তুষ্টির কোনো মূল্য নেই। অন্তর পরিশুদ্ধির ব্যাপারটাও ঠিক এমনই।[বুখারি ও মুসলিম]
মানুষের শরীরে যেমন হাত রয়েছে, পা রয়েছে, চোখ-মুখ-কানসহ অনেক অঙ্গ রয়েছে। এসব অঙ্গকে একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রায় অসম্ভব। একটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অন্যটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যেমন ধরুন, মুখে গীবত করব না, মিথ্যে বলব না বলে চেষ্টা করছি; কিন্তু মনের অজান্তে চোখের মাধ্যমে কোনো গোনাহর কাজ হয়ে গেল বা কানে কোনো গোনাহর কথা শোনা হয়ে গেল। তাই বলা যায় যে, সব অঙ্গকে একত্রে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্যই বটে।
পক্ষান্তরে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূল কেন্দ্র হচ্ছে অন্তর। তাই অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহজেই নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। অন্তর শুদ্ধ হলে কোনো অঙ্গই গোনাহর কাজে ব্যবহৃত হতে পারবে না। অন্তর তার ইচ্ছেমতো সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পারবে। তাই অন্তরের পেছনে মেহনত করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
এ কারণে হাদিসে অন্তর পরিশুদ্ধ করার প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বুখারি শরিফের প্রথম হাদিস হচ্ছে, ‘আমলের প্রতিদান হবে নিয়ত অনুযায়ী।” এ হাদিসের দ্বারা বুঝা যায়, নিয়ত শুদ্ধ হলেই কেবল সেই আমলের দ্বারা প্রতিদানের আশা করা যাবে। আর নিয়ত পরিশুদ্ধ হবে তখনই যখন অন্তর পরিশুদ্ধ হবে। কারণ নিয়তের স্থান হচ্ছে অন্তর।

অন্তরের প্রকারভেদ

কুরআনে কারিমের ভাষ্যমতে, দুনিয়ায় মানুষের অন্তর হচ্ছে তিন ধরনের। প্রথমে হচ্ছে, নফসে মুতমায়িন্না বা প্রশান্ত অন্তর। দ্বিতীয় হচ্ছে, নফসে লাওয়ামা বা কৃত অপরাধে অনুতপ্ত অন্তর, আর তৃতীয়টি হচ্ছে, নফসে আম্মারা বা কুমন্ত্রণাদাতা অন্তর। এ তিন ধরনের অন্তরের মধ্য থেকে আল্লাহর দরবারে সর্বোৎকৃষ্ট অন্তর হচ্ছে, যে অন্তর প্রশান্ত।
নফসে মুতমায়িন্না বা প্রশান্ত আত্মা হচ্ছে, আল্লাহর নাম শুনলে যে অন্তর তৃপ্তি পায়। আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কিছুতে মিষ্ট অনুভব হয় না; সবকিছু শুধু তেতো লাগে। এমন অন্তরই হচ্ছে প্রশান্ত ও পরিতৃপ্ত।
কুরআনে কারিমের ৩০তম পারায় সূরা ফজরে এ নফসে মুতমায়িন্না সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, (ভাবার্থ) রোজ হাশরের ময়দানে প্রশান্ত আত্মাকে বলা হবে, ‘ওহে আল্লাহ-নামে উৎসর্গিত আত্মা! তুমি তো পৃথিবীতে প্রকৃত প্রেমাষ্পদের সঙ্গে সুনিবিড় সম্পর্ক রাখতে। এখন তাঁরই একান্ত সান্নিধ্যে এসো। তিনি তোমার
প্রতি সন্তুষ্ট আর তুমিও সন্তুষ্ট তাঁর প্রতি। আর দেরি কেন, যাও! বিশেষ বান্দাদের কাতারভুক্ত হও আর সদলবলে জান্নাতে প্রবেশ করো।”
নফসে লাওয়ামা বা কৃত অপরাধে অনুতপ্ত অন্তরের ব্যাপারে কুরআনে কারিমের অন্য এক আয়াতে এসেছে :
ولا أقسم بيوم القيامة ولا أقسم بالنفس اللوامة .
‘আমি কসম করছি কেয়ামত দিবসের। আরও কসম করছি (সেই অন্তরের, যে নিজেকে তিরস্কার করে থাকে) নফসে লাওয়ামার।”
অর্থাৎ তিরস্কারকারী অন্তরই হচ্ছে নফসে লাওয়ামা। নফসে লাওয়ামা মূলত নফসে আম্মারার পতনকে বলে। অর্থাৎ এ অবস্থায় নফসে আম্মারার প্রলোভনে যদিও হঠাৎ গোনাহর কাজ করেও ফেলে, তখন সেই অন্তরের অনুতাপের অন্ত থাকে না। আর এ ধরনের অনুতাপের নাম হচ্ছে তওবাতুন নাসুহা, শুদ্ধ-সরল অন্তঃকরণের তওবা বা অনুতাপ। এ অনুতাপ হচ্ছে প্রবৃত্তির সঙ্গে অন্তরের অভ্যন্তরীণ লড়াই।
অতএব, প্রবৃত্তির সাথে অন্তরের যুদ্ধ-জিহাদ করে উত্তীর্ণ হতে পারলে নফসে লাওয়ামা পরবর্তী স্তরে পৌঁছে যায়। যাকে বলা হয় নফসে মুতমায়িন্না। নফসে আম্মারা বা কুমন্ত্রণাদাতা অন্তরের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
নিশ্চয় নফসে আম্মারা বদ কাজ করায়, তবে আল্লাহ যাদের ওপর রহমত বর্ষণ
করেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”
নফসে আম্মারাই মানুষকে কুকাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে, কুমন্ত্রণা জোগায়। তাই ইবাদতকামী ব্যক্তির জন্য নফসে আম্মারা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। কেননা এটা সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক শত্রু। এ শত্রু থেকে যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, তা খুবই মারাত্মক। এর প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন। এবং নফসে আম্মারার রোগেরও শেষ নেই আর রোগগুলোর চিকিৎসাও খুব কষ্টসাধ্য।
সুতরাং অন্তরের পরিশুদ্ধির আলামত হচ্ছে, তাতে আল্লাহ পাকের প্রতি ঈমান ও দৃঢ়বিশ্বাস বিদ্যমান থাকা, অন্তরে আল্লাহ পাকের মহব্বত, মারেফত এবং ভয়-ভীতি পয়দা হওয়া। আর বস্তু বা দেহের পরিশুদ্ধির আলামত হচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে ভালো কর্মকাণ্ড প্রকাশ পাওয়া, আমলসমূহ সুন্নত মোতাবিক হওয়া, আল্লাহপাকের নাফরমানি এবং গোনাহ সংঘটিত না হওয়া।
মোটকথা, মানুষের দেহের দুটি অংশ রয়েছে। আর এর পরিশুদ্ধির জন্যও রয়েছে দুইটি জিনিস—একটি হচ্ছে ঈমান। আর অপরটি হচ্ছে নেক আমল।

ইসলামি শিক্ষার মৌলিকতা

ঈমানের অর্থ হচ্ছে বাস্তবমুখী বিশ্বাস। যে বিষয়কে যেভাবে গ্রহণের প্রয়োজন সে বিষয়কে সেভাবে মানা এবং গ্রহণ করা। ইসলামি শিক্ষা তথা তালিম-তরবিয়ত অত্যন্ত বাস্তবমুখী এবং মৌলিক, অন্যান্য ধর্মের মতো অবাস্তব ও মনগড়া নয়। ইসলামে বাস্তবতাকে অস্বীকার করার মোটেই অবকাশ নেই। প্রবৃত্তির তাড়নায় স্বেচ্ছাচারিতার অবকাশ ইসলামে নেই।
অন্যান্য ধর্মে অনেক ধরনের ভিত্তিহীন ও অবাস্তব বিষয় রয়েছে। যেমন, ইহুদিরা হযরত উযায়ের আলাইহিস সালামকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে বিশ্বাস করে। আর খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে :
وقالت اليهود عزيز ابن الله وقالت النصارى المسيح ابن الله *
‘ইহুদিরা বলে উযায়ের আল্লাহর পুত্র।” এবং খ্রিস্টানরা বলে মসীহ আল্লাহর পুত্র। `
ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের এই বিশ্বাস মোটেই সঠিক নয়। এ কারণেই এই আয়াতের পরের অংশে এর কঠোর প্রতিবাদ করা হয়েছে এই বলে যে,
و ذلك قولهم بأفواههم .
“এসব এদের (বানোয়াট) মুখের কথা। **
১১ ইমাম কুরতুবি রহ. ও ইমাম শাওকানি রহ. এই আয়াতের তাফসির করেছেন এভাবে, আলোচ্য আয়াতে সকল ইহুদি সম্পর্কে এটা বলা হয়নি যে, তারা উষাইরকে আল্লাহর পুত্র দাবি করে। বর্তমান কালে ইহুদি ফিরকাগুলোর মধ্যে এমন বিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে আরবের ইহুদিরা [যারা ছিল ইয়ামেনি] উয়াইরকে আল্লাহর পুত্র বলে অভিহিত করত। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় আলোচ্য আয়াতটির শানে নুযুল দেখলে। আয়াতের শানে নুযুল হলো, সাল্লাম ইবন মিশকাম, নু’মান ইবন আওফা শাস ইবন কায়স ও মালেক ইবনুস সাইফ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমরা কীভাবে আপনার অনুসরণ করতে পারি, অথচ আপনি আমাদের কিবলা ত্যাগ করেছেন, আপনি উয়াইরকে আল্লাহর পুত্র বলে মেনে নেন না? তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেন। সুতরাং আমরা ঐতিহাসিক বিবরণ পাচ্ছি যে, আগেকার ইহুদিরা হযরত উযাইর আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র বলত। [তাবারী, সিরাত ইবনে হিশাম 
১/৫৭০]
আল্লাহ পাক এসব থেকে সম্পূর্ণ পূতঃপবিত্র। না আছে তার পুত্র, না তিনি কারোর পুত্র। এটাই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। ইসলামে এ ধরনের বাস্তবতাবিরোধী, ভিত্তিহীন ও মনগড়া আকিদা-বিশ্বাসের স্থান নেই। আল্লাহর পুত্র থাকা একটা অবাস্তব কথা।
সুতরাং ‘ঈমান স্থাপন করো’–এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ পাককে মানার মতো মানো, তার মহত্ব ও বড়ত্ব অনুপাতে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। আর এই মানা এবং বিশ্বাস স্থাপনের পর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, আমল করা ও সৎকর্ম সম্পাদন করা।

আল্লাহর ভয় মানুষকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে

হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভি রাহিমাহুল্লাহ এক বুজুর্গের ঘটনা নকল করেছেন যে, জনৈক ব্যক্তি তার বাগানের দারোয়ানের স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় এবং কৌশল করে দারোয়ানকে দূরে কোথাও কাজের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তারপর দারোয়ানের বাসার ভেতরে প্রবেশ করে তার স্ত্রীকে বলে, সব দরজা-জানালা বন্ধ করে এসো, কাজ আছে। দারোয়ানের স্ত্রী মালিকের মতলব বুঝে ফেলল।
যাই হোক, দারোয়ানের স্ত্রী দরজা-জানালা বন্ধ করে এসে হাজির হলো। মালিক জিজ্ঞেস করল, সব দরজা বন্ধ করছ? সে বলল, হ্যাঁ, একটি দরজা ছাড়া সব বন্ধ করেছি। মালিক বলল, সেটাও বন্ধ করে এসো। দারোয়ানের স্ত্রী বলল, সেটা বন্ধ করতে পারি না। মালিক বলল, সে আবার কোন দরজা? দারোয়ানের স্ত্রী বলল, যে দরজা দিয়ে আল্লাহ পাক তাকিয়ে আছেন সে দরজা বন্ধ করতে পারি না। মহিলার কথা শুনে মালিকের মনে ভয়ের ঝড় বয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি ও তওবা করতে শুরু করে দিলো। এ ধরনের হাজারো ঘটনা রয়েছে। এখান থেকে বুঝে আসে, আল্লাহর ভয় মানুষকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে।

নামাযের পরিশুদ্ধি প্রসঙ্গ

আমাদের বুঝে আসে না যে, আমরা নামাজ পড়ি, অন্যান্য নেক আমলও করি, সঙ্গে সঙ্গে গোনাহও করি কেন? হযরত সাহাবায়ে কেরাম নামায পড়তেন আমরাও নামায পড়ি। সাহাবায়ে কেরামের নামাযকে আল্লাহ পাক আমাদের জন্য মাপকাঠি বানিয়েছেন। এখন বলুন, আমাদের নামায কি তাদের নামাযের মতো হয়?
না হওয়ার একটি কারণ বলা যায়, আমরা চেষ্টা করেও তাদের মতো পারি না। তখন
আল্লাহর ফয়সালা হলো, চেষ্টা করেও যখন তোমরা সক্ষম না হও, তখন আমি :- |আরো পড়তে অথবা দেখতে অনুগ্রহ করে “যাদুস সালেকিন : ইসলাহে নফসের পথ ও পাথেয়” অরিজিনাল কপি সংগ্রহ করুন।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?