মোহিনী : বিদিশা মন্ডল | Mohini By Bidisha Mondol

দীপ্রর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে জয়ন্তী। ওর সারা গা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে। দীপ্রটা আসলেই মারা গেলো? তাও এমন ভাবে? বিশ্বাস হলোনা জয়ন্তীর। একটু আগেই না ও বলছিল “আমিও মরলে বেশ হয়!” সত্যি মারা গেল? সত্যিই ও আর কোনো দিন কথা বলবেনা? আর “হাঁউ মাঁউ খাঁউ, পেঁত্নীর গঁন্ধ পাঁউ” বলে পিছন থেকে এসে চমকে দেবেনা জয়ন্তীকে?
পর্ব – ১
“নূপুরটা সুন্দর তো! কোথায় পেলি?”
“গড গিফটেড। “
“মানে? “
“মানে চিতা থেকে উঠে এভাবেই নিজেকে আবিষ্কার করেছি। হা হা….যদিও লুকটা পছন্দ হয়েছে আমার। মানায় না আমাকে?
দীপ্র কে স্বীকার করতেই হল যে মানায়।
জয়ন্তী আবার প্রশ্ন করে, ” কি রে পড়াশোনা নেই তোর? সারাদিন আমার কাছে বসে থাকলে পড়িস কখন?”
“নাহ। মরেও পাল্টালিনা তুই। এখনও পড়া। আমিও মরলে বেশ হয়। আর পড়া লাগেনা। তোর সাথে ঘুরবো। কী মজা!”
“ঠাটিয়ে চড় লাগাবো একটা। তুমি মর আর লোকে বলুক জয়ন্তীই নির্ঘাত দীপ্রকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে গেছে। দূর হ’ এখান থেকে!”
 দীপ্র বেশ একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। নাহ্, জয়ন্তী এখনো পাল্টায়নি। এখনো ভাবে “লোকে কি বলবে”। দীপ্র হাসতে হাসতে চলে গেলো। 
জয়ন্তী ডালের উপর পা দু’খান ঝুলিয়ে বসেই রইলো। মাথার খোলা চুলে, পরনের সাদা শাড়ির আঁচলে বাতাসে দোলা দিচ্ছে। বছরের এই সময়ের আবওহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা। চারদিকে অখন্ড নিস্তব্ধতা। সুদূর অন্ধকার আকাশের পূর্ণ শশীর মায়াভরা বদনের দিকে সবাই যেন চুপটি করে চেয়ে আছে। ভূত-প্রেতের বিচরণের যথার্থ সময়। শহরের এই দিকটাও বড্ড নিরিবিলি। উপশহর গুলোর এই এক সুবিধা। বড় বড় শহরে নিরিবিলি জায়গা পাওয়া বেশ কঠিন।
জয়ন্তী পা দুলিয়ে দুলিয়ে দীপ্রকে নিয়ে ভাবতে থাকে। জিনিসটা ভালো করছেনা দীপ্র। ঐ রাতের পর থেকেই ওদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায়। যে রাতে জয়ন্তী পৃথিবীকে পর করে দিয়েছিল। পৃথিবীর মা-বাবা, বন্ধু কাউকে সেদিন ওর আপন মনে হয়নি। কেউ সেদিন ওকে আপন করে নেয়নি। ওকে রাস্তার জঞ্জালের মতো অবজ্ঞা করেছে। অপবিত্র ভেবেছে। মারা যাওয়ার পর যখন দূর থেকে দেখল ওরা ওর জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছে, হাসি পেয়েছিল ওর। পেট চেপে হেসেছিল সেদিন ও। ও যেদিন মুখ বুঁজে কেঁদেছিল সবার সামনে, কই কেউতো এগিয়ে আসেনি। 
সবাই বলেছিল ওর আর সম্মান বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। কেন নেই? শরীরটাই কি সব? সেখানেই সম্মান? যে রাতে ওই মানুষটা ওর শরীরকে খুবলে খেয়েছিল, তার থেকেও ভয়ঙ্কর রাততো এরপরে ছিলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ও দেখল ও এখন আর ওই সমাজের একজন না। ওই মানুষটার তো কিচ্ছু হয়নি। লোকে ওকেই আলাদা করে দিয়েছিল। নিজেদের আর ওর মাঝে একটা বিশ্রী কালো দেয়াল তুলে দিয়েছিল। এক রাতে অপরে ওর শরীরটাকে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়, আরেক রাতে ও নিজেই নিজের শরীর থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। 
শহরে বিষ পাওয়া যে এতো সোজা জানতোনা ও। একটা ছোট্ট শিশি খুব আরাম করে বসে বসে সাবাড় করেছিল। গলাটা জ্বলছিল প্রচন্ড। ধীরে ধীরে সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল। তাতে কী? যে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতো, সেই মাই যখন আর ওকে নিজের কাছে ঘেঁসতে দেয়না, বাবা যখন আর আগের মত কথা বলেনা। পাড়া প্রতিবেশী আর আগের মত আপন করে ডাকেনা, বন্ধুরাও যখন দূরে সরে যায়, কি থাকে তখন জীবনে? ও জানতো ওর জন্য কেউ থেমে থাকবেনা। কিন্তু ভুল হলো ওর হিসাবে। দীপ্রটা থেমে গেল। ঐ এতো কিছু যখন হলো তখন দীপ্র শহরের বাইরে ছিল। জয়ন্তীর ফোন কাছে থাকতোনা। তাই ওই সময়ে ওর সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলনা। হতে হতে বহু দেরী হয়ে যায়। তখন আর জয়ন্তী মানুষ না। মোহিনী।
 এই গাধাটাযে কেন বোঝেনা ওরা দুজন এখন আর এক নয়। কেন যে বোঝেনা দীপ্রর জগৎটা জয়ন্তীর জন্য হয়তো তেমন ক্ষতিকর কোন জায়গা নয় কিন্তু জয়ন্তীর জগৎটা যে ভয়ানক খারাপ জায়গা দীপ্রর জন্য তা জয়ন্তী আজও ভেবে পায়না। ওর সাথে কথা বলার সময় বিপদ যে ওঁত পেতে থাকে, দীপ্র তা জানে। তবু আসে ওর কাছে। আরে পাগলেও তো নিজের ভালো বোঝে। এই ছেলে কেন বোঝেনা। সত্যি বলতে জয়ন্তী জানে কেন বোঝেনা। দীপ্র নিঃসঙ্গ। একা। কিন্তু জয়ন্তী এটা বোঝেনা যে দীপ্র ওকে দেখতে পায় কি করে। ওর ঠিক পাশে জয়ন্তীর মতোনই অন্য কোনো মোহিনী কিংবা লোক ভাষার ডাইনি-পেত্নী দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে তো দীপ্র দেখতে পায়না। তখন ওর হাত দুটো ধরে রেখে ওদের সবার থেকে বাঁচায় ওকে জয়ন্তী। যেন কেউ ওকে ছুঁতে না পারে। কিন্তু তেমন শক্তিধারীনি কেউ এলে তার কাছ থেকে কি বাঁচাতে পারবে ওকে? এপারের লোকে মানুষের গন্ধ পায়। ওপারের মানুষের তো এপারের লোকের গন্ধ পাওয়ার কথা না। দীপ্র পায়। জয়ন্তী যেখানেই থাকুক দীপ্র ওকে খঁুজে বের করেই ছাড়ে। “হাঁউ মাঁউ খাঁউ পেত্নীর গন্ধ পাঁউ” ছড়া কাটে ও। 
কটু একটা গন্ধ আসছে। কে আসছে এদিকে? জয়ন্তী ইতি উতি চেয়ে দেখে। ওহ। রাত্রি। কার ঘাড় মটকে রক্ত খেয়ে এলো কে জানে। একটা উৎকট গন্ধ আছে ওর গায়ে। রাত্রির একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ও কোনো কিছুর ঠিক অবিকল প্রতিরূপ বানিয়ে ফেলতে পারে। তেমনি কারো গায়ের রক্ত শুষে নিলে তার প্রতিরূপ রক্ত আবার সেই আসল রক্তের জায়গায় চলে আসে। এতে মানুষটাও দিব্যি বেঁচে থাকে। কিন্তু আজ পূর্নিমা। এই রাতে মোহিনীদের প্রায় সব ক্ষমতাই চলে যায়। আজ রাতে কারো রক্ত নিলে তার প্রতিরূপ বানাতে পারবেনা রাত্রি। কাজেই রাত্রি পাশে এসে বসলে বেশ আগ্রহের সাথেই জয়ন্তী জানতে চাইলো যে কার সাধের জীবন খানি শ্রীমতী উদরস্থ করে এসেছেন। 
“আরে তোর কাছেই আসছিলাম। বেশ খিদে পেয়েছিল। রাস্তায় একটা ছেলেকে দেখলাম। বেশ তরতাজা। ওরই…..” সর্বনাশ। কার কথা বলছে ও। জয়ন্তী ভয় পেয়ে গেলো। দীপ্র না তো। ওই তো কেবল এ পথ দিয়ে গেলো।…… 
চলবে…

পর্ব – ২ শুরু – 
“কে ছেলেটা জয়?” অপরাধীর মত এতোক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রাত্রী। আর চুপ করে থাকতে না পেরে কথা বলেই ফেলল। 
ধীর কন্ঠে জয়ন্তী বললো, “ওর নাম দীপ্র। আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু। কোনো একভাবে আমি মারা যাওয়ার পরও আমায় দেখতে পেত। আমার কাছে আসতো। গল্প করতো আমার সাথে। আর বোধ হয় কোনোদিন করবেনা।” জয়ন্তীর চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু রাত্রী হু হু করে কেঁদে ফেলল। 
“আমায় ক্ষমা করে দে জয়। আমি বুঝিনিরে। হায় হায়! একি করলাম না বুঝে। এ ছেলেটা হয়তো সাধারণ কেউ ছিলো না। কোনো সাধারণ মানুষের অসম্ভব কোনো মোহিনীকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া। একি করলাম….”
“আহ্, রাত্রী। চুপ কর বলছি। টুঁ শব্দটি করবিনে।” জয়ন্তীর শোকের প্রথম ধাক্কাটুকু কেটে গেছে। দূর থেকে শ্মশান কালী মন্দিরের ঘন্টা শুনতে পেলো। আজ পূর্ণিমা। অরুণা মা বরাবরের মতো আজও হয়তো মন্দিরে পূজোর জন্য এসেছেন। ইনি আদি মোহিনী। তাঁর কাছে যাওয়াটা প্রয়োজন। এক হাতে দীপ্রকে কাঁধে তুলে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে  রাত্রীকে ধরে নিয়ে প্রায় টানতে টানতেই মন্দিরে এলো। 
অরুণা মা এক হাতে দেবীর আরতি করছেন আর অন্য হাত দিয়ে ঘন্টা বাজাচ্ছেন। তারই আওয়াজে চারদিক মুখরিত। যদিও সাধারণ মানুষ এই আওয়াজ শুনতে পায়না। শুধু মোহিনীরাই পায়। জয়ন্তী মা বলে ডাকার আগেই তিনি বলে উঠলেন “দেহটাকে ওখানেই রেখে দিয়ে ভিতরে আয়, জয়। আন্দাজ করছিলাম এমন কিছু হবে। এতো শীঘ্রই যে হবে তা বুঝিনি। তুই ভিতরে এসে বোস। আমি পূজোটা শেষ করে যা বলার বলছি।” 
আরো কিছু সময় বাদে পূজো শেষ করে মা জয়ন্তীর কাছে এলেন। “বল এখন জয়, কি চাস?”
“মা, ওকে কি বাঁচানো যায় কোনো ভাবে?”
“একটা শর্ত যদি মানিস তবে যাবে।”
জয়ন্তী একবার ওনার দিকে তাকালেন। ওনার বয়স কত তা কেউ জানেনা। পৃথিবীর প্রথম মোহনী ইনি। ওঁনার জটা বাঁধা কালো রুক্ষ চুল প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই। কপালে সিঁদূরের লাল টিপ। পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। হাতে, গলায় রুদ্রাক্ষমালা। মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে এক অপার্থিব তেজ।
“কি শর্ত মা?”
”সেটা ওকে বাঁচাতে পারলে তবে বলবো। আগে শোন, ওই যে সামনে মায়ের প্রতিমা দেখছিস?”
“দেখছি।”
“তোর হাতে সময় আছে দুই দিন। মায়ের প্রতিমার তলায় আছে একটা গুপ্ত কুঠুরি। এর মধ্যে আছে সময় চক্র আর এই চক্রকে ঘুরালে এটা তোকে তোর কাঙ্খিত সময়ে পৌঁছে দেবে। কিন্তু ঐ চক্রকে পাহারা দিচ্ছে দুই কাল নাগ। ওরা তোদের মারতে তো পারবেনা কিন্তু তোরা যেই শক্তিই ওদের উপর প্রয়োগ করবি তাই শুষে নেবে। আর সেই শক্তি ব্যবহার করতে পারবিনা। মায়ের মন্ত্রপুতো তলোয়ার দেবো। তা দিয়ে ওদের মারতে পারবিনা বটে কিন্তু কিছু সময়ের জন্য অজ্ঞান করে রাখতে পারবি। এরমধ্যে সময়ের চাকাকে না ঘুরাতে পারলে ওরা তোদের ধরে ফেলবে। আর এইবার ধরে ফেললে তোদের চিরদিনের মতো ওদের বিষ দঁাত দিয়ে কাঁমড়ে পাথরের মূর্তি বানিয়ে রেখে দেবে।”
 “সবই তো বুঝলাম মা। কিন্তু কোন সময়ে যাবো? কেনই বা যাবো? ”
” ওহ হো দেখছিস? বয়স হয়ে যাচ্ছে তো….সব ভুলে যাই। হা হা….”এই কথায় জয়ন্তীও হেসে ফেলে। মোহিনীদের যে বয়স বাড়েনা কখনো। দেহটাই তো ওদের পোশাকের মত। চাইলেই নতুন দেহ নিতে পারে ওরা। রূপ বদলাতে পারে। শরীর থাকলে তবে তো তার বয়স বাড়বে। 
“তো যা বলছিলাম। মূলত তোর মৃত্যুর ঠিক ৩ মাস আগে তুই যখন হাসপাতালে ছিলি তখন দীপ্র কয়েকদিনের জন্য তোদের ওই শহরে ফিরে আসে। তোর জন্যই আসে। অনেক রক্তপাত হয়েছিল তোর। তোর মায়ের অ্যানিমিয়া আছে। সে চাইলেও রক্ত দিতে পারতোনা। বাবার সাথে গ্রুপ মেলেনি। আর কারো সাথেই মেলেনি আসলে। দীপ্রটা না এলে তুই ওই হাসপাতালেই মরতিস। যদিও এসেও খুব আহামরি লাভ হয়নি। কয় মাস পর এমনিতেই চিতায় চড়েছিলি….হাহা। 
মানুষ বড় অদ্ভুত। বেঁচে থাকতে চাইলেই আসলে বেঁচে থাকতে পারতিস। মানুষ চাইলে কি না পারে! কিন্তু চাসনি। তোর জায়গা থেকে ভাবলে দাঁড়ানোটা বেশ কঠিন ছিল। তবু মানুষকে দাঁড়াতে হয়। নিজের জন্যই দঁাড়ানো লাগে। মৃত্যুকে আসলে কোনো সমাধান মনে হয়না আমার। পালিয়ে আসা মনে হয়। কাপুরুষতা। তবুও কেন তুই মোহিনী হলি ঈশ্বর জানে। আমি জানতে পারলে বলবো। তবে একারণেই দীপ্র তোকে দেখতে পেতো। ওর রক্ত তোর শরীরে ছিল। তোর জ্ঞান আসার আগেই ওকে চলে আসতে হয় যদিও। বেঁচে থাকতে আর দেখা হয়নি তোদের তা তো তুইও জানিস। তবে জানিস কি? ও এমনকি তোর গন্ধও পেতো? মানুষের মতো মোহিনীদের গায়েও গন্ধ থাকে। ঠিক গায়ের না, মনের…..। 
জয়ন্তী চুপটি করে সব শুনছিলো। তারপর প্রশ্ন করলো, ” সময় চক্রকে ঘুরিয়ে কোন সময়ে নেবো মা?”
“ঠিক তোর আত্মহত্যার পূর্ব মুহূর্তে। ” 
চলবে…
মোহিনী (২য় অংশ)
⇨আর্টিকেলটি লিখেছেন : বিদিশা মন্ডল
  ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?