মুফতি রফি উসমানি এক প্রলম্বিত ছায়াবীথির তিরোধান

একটি মতাদর্শ সাধারণত টিকে থাকে দুটি বিষয়ের সমন্বয়ে—জ্ঞানতাত্ত্বিক সৌকর্য ও বাহুবলের সৌন্দর্য।

 

এ দুয়ের সমন্বয় না থাকলে নিজেদের বিস্তার করা ও টিকে থাকা মুশকিল। শুধু বাহুবল দিয়ে সীমানা করায়ত্ত করা যায়; কিন্তু সভ্যতা নির্মাণ, সাংস্কৃতিক সৌধ তৈরি করা যায় না এবং এগুলো ছাড়া মতাদর্শ টিকতেও পারে না।
ইসলাম শুরু থেকেই জ্ঞানতত্ত্বকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে এবং ইলমের মাধ্যমে পৃথিবীর বিন্যাস সুশৃঙ্খল রাখছে। হাদিস শরিফে আছে, কিয়ামতের আগে পৃথিবী থেকে জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং জাহালত ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। নবীজি ব্যাখ্যা করে বললেন, কারও থেকে ইলম ছিনিয়ে নেওয়া হবে না; বরং জ্ঞানীদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আল্লাহ ইলম আকাশে তুলে নেবেন। এজন্যই বলা হয়—মাউতুল আলিমি, মাউতুল আলামি—আলিমের মৃত্যুবরণ মানে জগৎসমূহের মৃত্যু হয়ে যাওয়া।
গত এক দশক ধরে আমরা বারবার এই নির্মম সত্যের সম্মুখীন হচ্ছি। এ সময়টিতে দুনিয়াজুড়ে ন্যায় ও সত্যের আলো ছড়ানো ইলমের বাহকদের মৃত্যুর বহর দেখা গেছে। পৃথিবীর কোনো একটি কোণে একজন আলিমের মৃত্যু ঘটেছে এবং সারা দুনিয়া মৃত্যুযন্ত্রণায় মুষড়ে পড়েছে।
সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হলো বিখ্যাত মারেফুল কুরআনের লেখক মুফতি শফি রাহ.-এর সুযোগ্য বড় সাহেবজাদা, মুফতি রফি উসমানি রাহ.-এর নাম।
মুফতি রফি উসমানি রাহ.-এর সহোদর মুফতি তাকি উসমানি দা.বা.। দুই ভাইয়ের মধ্যে একটি বিষয়ের কারণে আমি রফি উসমানি সাহেবকে কিছুটা এগিয়ে রাখব। অনেক দিন আগে তাকি উসমানি সাহেবের একটা লেখা পড়েছিলাম, সেখানে তিনি লিখেছেন,  ইলমি এবং সফর-সেমিনার কেন্দ্রিক ব্যস্ততার কারণে সাংসারিক বিষয়াদি সম্বন্ধে আমার তেমন জ্ঞান নেই। কখন কী লাগবে, কোন জিনিশ কোথায় ভালো পাওয়া যায় ইত্যাদি আমি তেমন একটা জানি না। আমার পরিবারের এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ দেখভাল করেন বড় ভাই রফি উসমানি। এমনকি আমার স্ত্রীর জামা-কাপড়ও কেনাকাটার ঝামেলা তিনি পোহান। সাংসারিক সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার ইলম অর্জনের পথটি যথাসাধ্য সুগম রেখেছেন।
এই আলোচনা থেকে প্রথমত স্পষ্ট, একজন তাকি উসমানি হয়ে ওঠার পেছনে বাবার পরে বড় ভাইয়ের কতটা ছায়া মাথার ওপর বিস্তার করে ছিল। দ্বিতীয়ত, একজন সেরা ও ব্যস্ত আলিমে দ্বিন কতটা জ্ঞানপ্রিয়  হলে ইলমের খাতিরে নিজের ব্যস্ততা এক পাশে রেখে ছোট ভাইয়ের সংসার পর্যন্ত সামলেছেন এবং দুনিয়াবি ঝামেলায় তার ইলমপিপাসু ভাইটিকে জড়াতে দেননি! 
এই দয়ালু বড় ভাইটিও ছিলেন ইলমের আকাশে  উজ্জ্বল নক্ষত্র। পাকিস্তানের প্রথমসারির ইসলামি আইনবিদদের একজন এবং গ্র্যান্ড মুফতি। ফতোয়া ও আহকাম বিষয়ক তার সুবিস্তর অধ্যয়ন ও গবেষণাপত্র আমাদের সামনে বই আকারে মলাটবদ্ধ আছে। আরবি উর্দু ভাষায় প্রায় সাতাশটি কিতাব তিনি উম্মাহ সমীপে রচনা করে গেছেন। একই সঙ্গে মুসলিমবিশ্বে তিনি একজন অভিভাবকতুল্য মুরুব্বি ছিলেন, ছিলেন অনেকগুলো শরইয়া বোর্ডের নির্বাহী, উপদেষ্টা, সদস্য। পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ইলমি কানন দারুল উলুম করাচির মুহতামিম। এই মহর্ষি ব্যক্তিটির নাম মুহাম্মাদ রফি—রেখেছিলেন হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলি থানবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
ইলমে আমলে ব্যক্তিত্বে এক অসাধারণ দ্যুতিময় জীবন পাড়ি দিয়ে রফি উসমানি চলে গেছেন পৃথিবীর ওপারে। এমন প্রাজ্ঞ আলিমের মৃত্যুতে আরও একবার পৃথিবীর মৃত্যু হয়ে গেল। পৃথিবী হয়ে পড়ছে ইলমশূন্য। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই দাঈ বান্দার সমস্ত গুনাহ-ত্রুটি ক্ষমা করে দিন, ভালো ও দ্বিনি কাজগুলো কবুল করুন। উম্মাহকে তার রেখে যাওয়া ইলমি ওয়ারাসাত থেকে ইস্তিফাদার তাওফিক দিন। তার শূন্যস্থানে এমন কাউকে যোগ্য করে তুলুন, যিনি শক্ত হাতে উম্মাহর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন। আমাদের সবাইকে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে কবুল করুন, আমিন।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?