মা মা মা এবং বাবা by arif azad ll Bangla book review ll pdf free download

বইয়ের নামঃ মা, মা, মা এবং বাবা

প্রকাশনীঃ সমকালীন প্রকাশন

ধরনঃ সংকলন, ইসলাম ও পারিবারিক জীবন, আদব।

প্রকাশকালঃ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কলেবরঃ ১৭৫ পৃষ্ঠা (পেপারব্যাক)

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৩৫ টাকা।

পড়তে পারেন_
Sadat Hossain এর আরো কিছু বই।

আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতা’লা আমাদেরকে যেসব অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলেন আমাদের পিতামাতা। তারা শত ঝড়ঝাপ্টায় পরম মমতায় আমাদেরকে আগলে রেখে তিল তিল করে বড় করে তুলেন। পিতামাতার জন্যে সন্তান হচ্ছে চোখের শীতলতা। আর সন্তানের জন্যে পিতামাতা হলেন আকাশের জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, প্রথম বন্ধু, প্রথম শিক্ষক। আমাদের জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম অবলম্বন হলেন আমাদের পিতামাতা। তাইতো নবীজির (ﷺ) হাদিস থেকে জানতে পারি, যে ব্যাক্তি তার পিতা ও মাতা উভয়কেই বৃদ্ধ অবস্থায় পেলো অথচ তাদের সেবা করে জান্নাতে যেতে পারলো না, তার জন্যে ধ্বংস। [1]

.

মানুষের একটি বৈশিষ্ঠ্য হল, সে সহজেই কোন নিয়ামত পেলে তার কদর করেনা। যখন সে জিনিসের অভাব বোধ করে, তখন তার মূল্য বোঝে। অথচ মাতাপিতার মত এত বিশাল নিয়ামতের কদর অনেক মানুষ বোঝেনা। মাতাপিতা মারা যাওয়ার পর তাদের কদর বুঝে সেবা না করার আক্ষেপ নিয়ে সারাজীবন ডুকড়ে কেঁদেছে এমন লোক সমাজে অনেক পাওয়া যাবে। তাই প্রতিনিয়ত মাতাপিতার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে এমন একটি বইয়ের প্রয়োজন ছিল অনেক।

.

বইয়ের কিছু গল্প শায়খ আব্দুল মালেক মুজাহিদের ‘Loving our parents’ বই থেকে নেয়া হয়েছে। কিছু গল্প আরব শায়খদের রচনা থেকে, কিছু গল্প ইন্টারনেট থেকে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে নেয়া হয়েছে। আছে অন্যান্য জায়গা থেকে নেয়া সুন্দর সব গল্পের সমাহারও। 

.

বইটিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশে আছে জীবন থেকে নেয়া বিভিন্ন গল্পের সমাহার। 

.

প্রথম গল্প হচ্ছে এক মায়ের চিঠি। এ যেন প্রত্যেক মায়ের মনের কথা। সন্তান গর্ভে ধারণ থেকে পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠা পর্যন্ত মায়েদের অবদান যে কত বিরাট তা এই লেখাটি পড়ে আরেকবার স্মরণ হবে, চোখ অশ্রুসিক্ত হবে। ইচ্ছে করবে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাতে।

.

এই বইটা শুধুই মায়েদের গল্প নিয়ে নয়, আছে বাবাদের গল্প, সন্তানের গল্প, সফল পরিবারের গল্প, ব্যর্থ পরিবারের গল্প। বইয়ের গল্পগুলো পড়ে আপনার বোধোদয় ঘটবে। উপলব্ধি করবেন কত বড় নিয়ামতকে আপনি অবহেলা করছেন। নিজের পরিবারকে দেখবেন অন্য রকম মমত্ববোধ থেকে। 

.

কিছু গল্প পড়ে আবারও বুঝতে পারবেন, বাবা মায়ের এই ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। আমরা যতই উত্তম আচরণ আর খেদমত করিনা কেন, আমরা আমাদের মায়ের একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদানও দিতে পারবোনা, ঠিক যেমনটি আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) বলেছিলেন (১৭৪ পৃ.)। নেককার সন্তানরাও পিতামাতার জন্যে আশীর্বাদস্বরুপ। সালেম নামক আবিদ সন্তানের কাহিনী পড়েও চোখ মুছতে হতে পারে আপনার।এধরনের অসংখ্য হৃদয়ছোঁয়া গল্পের সমাহার এই বই। 

.

কখনো অনুশোচনার আর আক্ষেপের গল্পগুলো পড়ে চোখ মুছবেন। মনে হবে নিজের পিতামাতার সাথেও তো কত বেয়াদবি, অবহেলা করেছি। কখনো সফল পিতামাতার সন্তানের গল্প পড়বেন। উপলব্ধি করবেন তাদের সেবা করার গুরুত্ব, উপলব্ধি করবেন নিজেদের শিশুদেরও সঠিকভাবে লালনপালনের প্রয়োজনীয়তাও।

.

কিছু গল্প পড়ে হয়ত আপনি থেমে যাবেন, সামনে এগুতে পারবেন না। ‘অনুশোচনার গল্পঃ হারিয়ে ফেলার পরে’  গল্পটি ছিল আমার জন্যে তেমনই একটি গল্প।  ‘বাবা-মায়ের স্মৃতি’ লেখাটাও অসাধারণ ছিল, লেখক নিজের জীবন থেকে আমাদের বাস্তব উপদেশ দিয়ে গেলেন কীভাবে বাবা মায়ের সাথে সদাচার করতে হবে। ‘সিলাহ রেহমী’ লেখাটি তো দিকনির্দেশনামূলক উপদেশে রচিত এমন রচনা যে বারবার পড়া উচিত। বইয়ের কিছু গল্পে অবাধ্য সন্তান, অবাধ্য ছেলের বউ আর দুঃখ অনুশোচনার কাহিনী পড়ে সেসব থেকে শিক্ষা নেয়ার খোরাক যেমন আছে, তেমনি বাধ্য সন্তান, লক্ষী ছেলের বউদের গল্পও আছে যেগুলো পড়ে অনুপ্রাণিত হবেন। মোটকথা, এতদূর পড়ে মনে হবে, বইটি কমপ্লিট প্যাকেজ, শুধু কুরআন হাদীসের কিছু গল্প জুড়ে দিলেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যেতো।

.

আর সেজন্যেই হয়ত ২য় অংশে আছে কোরআন-হাদিস থেকে নেয়া কিছু রচনার সংকলন, সালাফদের মাতাপিতার প্রতি ভক্তির কিছু সুন্দর গল্প, হাদীস থেকে নেয়া ঘটনা এবং পিতার সাথে ইব্রাহীম (আ) এর ঘটনা। সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ বইটি পরিণত হয়েছে সংগ্রহে রাখার মত একটি অনবদ্য রচনাসম্ভারে।

.

বইটি প্রকাশনীর ড্রিম প্রজেক্ট ছিল। তারা ভালো একটি কাজ উপহার দিতে চেস্টার কমতি করেনি। নজরকাঁড়া প্রচ্ছদ, সুন্দর পৃষ্ঠাসজ্জা, পাঠোপযোগী সুন্দর ও শ্রুতিমধুর লেখনী সবকিছুতেই ছিল যত্নের ছোঁয়া। বানান বিভ্রাট প্রায় চোখেই পড়েনি (৯৭ পৃষ্ঠায় ‘স্বঃপ্ন’ বানানটি ছাড়া)। 

.

তবু তারপরেও আমরা যেহেতু মানুষ, ক্রুটিবিচ্যুতিবিহীন কিছু প্রকাশের দাবী আমরা করতে পারিনা। আমার এ বইতে দুটি বড় রকমের অসংগতি নজরে এসেছে। এখন বলব সেগুলো নিয়ে। প্রথমে বলে রাখি, অসঙ্গগতিগুলো ফতওয়ার অসম্পূর্ণতা নিয়ে, ভুল নয়। ফুটনোটে সম্পূর্ণ ফতওয়া সংক্ষেপে উল্লেখ করলেই সেগুলো আর অসঙ্গগতি হিসেব থাকবেনা ইনশাআল্লাহ।

.

প্রথম অসংগতিঃ ‘জুরাইজের ঘটনা’ গল্পে বনু ইসরাঈলর এক অত্যন্ত আবেদ ব্যক্তি জুরাইজ এর ঘটনা আলোচিত হয়। জুরাইজ নফল সালাতে থাকা অবস্থায় মায়ের ডাকে সাড়া না দিলে তাঁর মা তাঁকে অভিশাপ দেন। ফলস্বরুপ নানা পরীক্ষার মধ্যে তাঁকে পড়তে হয়। এ ঘটনার শিক্ষাতে বলা হয় যে, নফল সালাতের চেয়ে মায়ের অধিকারের গুরুত্ব বেশি। এতদূর পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তাঁর পরের লাইনে আরেকটি শিক্ষা উল্লেখিত হয়। লেখা হয়ঃ তেমনিভাবে হিজরতের চেয়েও মায়ের হুকুমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। (১৬০পৃ.)। অথচ এখানে সম্পূর্ণ ফতওয়া উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল, নতুবা অনেকে ভুল মেসেজ পাবে।

.

হিজরতের ব্যপারে আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা বলেন, ‘যারা নিজের অনিষ্ট করে, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান।‘ 

.

কাফির দেশ থেকে হিজরতের ব্যপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি সেসব মুসলিমদের থেকে (দায়িত্ব)মুক্ত যারা মুশরিকদের মাঝে বসবাস করে। এক দলের আগুন যেন অন্য দল দেখতে না পায়। 

উপরোক্ত দলিল থেকে আলেমগণের এ ব্যপারে ইজমা আছে যে, অমুসলিমদের দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা জায়িয নয়। হিজরত করতে হবে। অনেক আলেমগণ মনে করেন, হিজরতের বিধান বিচার দিবসের আগে পর্যন্ত বহাল থাকবে।

.

ইবনে কুদামাহ (রহ) বলেন, হিজরত তিন প্রকারঃ

ক) তারা কাফিরদের দেশে বাস করে ও মুক্তভাবে দ্বীন পালন করতে পারেনা। নির্যাতনের শিকার হন। তাদের জন্য নিজের দ্বীনের হিফাজত করার জন্যে হিজরত ওয়াজিব। এমন অবস্থায় পিতামাতার অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। 

খ) তারা কাফির দেশে বাস করে ও মুক্তভাবে দ্বীনের বেসিক আহকাম পালন করতে পারে। তাদের জন্যে হিজরত ওয়াজিব নয়, তবু তাদের উচিত কাফিরদের দেশ পরিত্যাগ করে হিজরত করা, এটি তাদের জন্যে উত্তম। এমন অবস্থায় তাদের পিতামাতা যদি অনুমতি না দেন, তবে তারা যেন হিজরত না করে। 

গ) যারা অসুস্থতা, দুর্বলতা বা অন্য কারণে হিজরত করতে পারবেনা, তাদের উপর হিজরতের বাধ্যবাধকতা নেই।

.

ফুটনোটে সংক্ষেপে লিখে দেয়া উল্লেখ ছিল, কোন ধরনের হিজরতের ক্ষেত্রে পিতামাতার অনুমতি আবশ্যক আর কোন ধরনের হিজরতের ক্ষেত্রে তা আবশ্যক নয়। 

.

দ্বিতীয় অসংগতিঃ ‘উমার এর কান্না’ অধ্যায়ে উমার (রা) এর শাসনকালে কিলাব নামক এক লোক এর কাহিনী বর্ণিত আছে। কিলাব মুজাহিদদের সাথে জিহাদে যোগ দেন যদিও কিলাবের বাবা মায়ের তাতে মত ছিলনা। পরবর্তীতে একসময় তাদের পিতামাতার দুঃখকস্ট দেখে উমার (রা) কিলাবকে জিহাদ থেকে  ফিরিয়ে আনেন এবং বলেন, ‘যতদিন তোমার বাবা মা জীবিত আছেন, তাদের সেবাযত্ন করার মাধ্যমে জিহাদ করো। তারা মারা গেলে তখন নিজেকে নিয়ে চিন্তা করো।’ (১৬৪পৃ.)

.

উল্লেখ্য, জিহাদ দুই প্রকারঃ ক)আক্রমণাত্মক জিহাদ খ) রক্ষণাত্মক জিহাদ। উমার (রা) এর খিলাফতকালে ইসলাম ছিল শক্তিশালী, সুরক্ষিত। উমার (রা) ইরাকে আক্রমণাত্মক জিহাদে সৈনিক পাঠালে কিলাব তাতে শামিল হন। আক্রমণাত্মক জিহাদে শামিল হওয়া ফারদ্বে কিফায়া। এমন জিহাদে পিতামাতার অমত থাকায় উমার (রা) কিলাবকে ফিরিয়ে আনেন। একই ধরনের ঘটনা হাদীস থেকেও পাওয়া যায়। কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তা ছিল আক্রমণাত্মক জিহাদের ক্ষেত্রে।

অপরপক্ষে রক্ষণাত্মক জিহাদের সময় তাতে যোগ দেয়া ফারদ্বুল আইন হয়ে যায়। এমন অবস্থায় পিতামাতার অনুমতি দূরের কথা, জানিয়ে যাওয়ারও বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ উম্মাহর প্রত্যেকের জন্য তখন জিহাদ বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। যখন শত্রুপক্ষ মুসলিমদের ভূমি দখল করে নেয়, মুসলিমরা আক্রমণের শিকার হয়, তখন দ্বীন রক্ষার্থে রক্ষণাত্মক জিহাদ সবার উপরে ফারদ্বুল আইন হয়ে যায়। 

.

.

আমি লেখার নিচে রেফারেন্স উল্লেখ করে দিয়েছি, যাচাই করতে পারেন।অপরিচিত কারো নয় বরং, ইসলামকিউএ সহ মেইনস্ট্রিম আলেমদের ফতওয়া উল্লেখ করেছি। এখন জিহাদ ফারদ্বুল আইন কিনা এধরনের বিতর্কে জড়াবোনা। প্রকাশনীকে অনুরোধ করব, যেহেতু একটি ব্যপারে ফতওয়া উল্লেখ করেছেন, মেহেরবানী করে, সম্পূর্ণ ফতওয়াটা ফুটনোটে উল্লেখ করলে অনেক উপকার হত। আমার আশা, আপনারা তা করবেন, ইনশাআল্লাহ। কারণ, এটিই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র মত।

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?