মানুষের দেহের সব অংশ খাওয়া গেলেও একটা অংশ খাওয়া উচিত না!

“মানুষের দেহের সব অংশ খাওয়া গেলেও একটা অংশ খাওয়া উচিত না, আর তা হলো মানব মস্তিষ্ক”- পুনর্জন্ম ৩ এ এই ধরনের ডায়ালগ আর দৃশ্য দেখে একটু গা গুলিয়ে গেলো। এমনিতেই মানুষ আবার মানুষের মাংস খাবে এটা ভাবতেই  ঘৃণা লাগে। কিন্তু স্পেসিফিকভাবে মানুষের মস্তিষ্কে কি সমস্যা?! 

ক্যানিবালিজম বহুকাল আগে থেকেই এই পৃথিবীতে চর্চা হয়ে আসছে। তাই ব্যাপারটা কারও কাছে অজানা বা অপরিচিত নয়। আগেকার দিনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় রীতিনুযায়ী অনেকে নিজের আপনজন এর দেহ ভক্ষণ করতো। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, শত্রুর মাংস ভক্ষণ করতো যাতে তাদের দেহের শক্তি নিজেদের দেহে সঞ্চয় হয়। ইউরোপে বারো শতক থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত  মানুষের হাড়, রক্ত, চর্বি বাজারে ঔষধ হিসেবে বেচাকেনা হতো। 
পাপুয়া নিউগিনির মানুষদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের কিছু রিচ্যুয়াল ছিলো- আত্মীয় বা নিকটজনের দেহ ভক্ষণ করার। কিন্তু  মাংস ভক্ষণ করার মতো নিরাপদ নয় ব্রেইন ভক্ষণ করা।  মানুষের  ব্রেইন ভক্ষণ করার ফলে দেখা দেয় কুরু (Kuru) র মতো বিরল রোগ। পাপুয়া নিউগিনির মানুষদের ক্ষেত্রে বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে কুরুর মহামারী দেখা দিয়েছিলো। ১৯৫০ এর সময়ে  মহিলাদের মৃত্যুর জন্য এই কুরু প্রধানত দায়ী ছিলো। প্রথম দিকে মোট মৃত্যুর  ২% ই ছিলো কুরু-র প্রভাবে। এটা মূলত মহিলা এবং শিশুদের বেশি আক্রমণ করেছিলো। লিঙ্গভেদে এই বৈষম্যের কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত সেই এলাকার পুরুষদের ধারণা ছিলো হয়তো মানুষের মাংস খাওয়ার ফলে হয়ত তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই মহিলা ও শিশুরা মৃতদেহ ভক্ষণ করতো। আবার  মৃতদেহ ধোয়া মোছার কাজেও নারীরা থাকতো, সেইখানেই ক্ষত থেকে ইনফেকশন হওয়ার চান্স থেকে যায়।
কুরু (Kuru)-মারাত্মক ট্রান্সমিসিবল স্পঞ্জিফর্ম এনসেফালোপ্যাথি (TSE), যা  মস্তিষ্কের অবক্ষয়জনিত বিরল ব্যাধি বা প্রিয়ন রোগ। এটারই আরো একটি ধরন হলো বোভাইন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফালোপ্যাথি (BSE), যা “ম্যাড কাউ”  ডিজিজ নামে পরিচিত। TSE  মূলত আক্রমণ করে মানুষের ব্রেইনের সেরিবেলাম এ- যেই অংশ আমাদের শরীরের অনুভুতি ও ব্যালেন্স রক্ষার কাজ করে। প্রিয়ন ডিজিজ মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক গ্লাইকোপ্রোটিন জমা করতে থাকে- যাকে বলা হয় প্রিয়ন প্রোটিন(PrP).
প্রিয়ন প্রোটিন ন্যাচারালি  নার্ভাস সিস্টেমে তৈরি হয়। আমাদের দেহ ফাংশনে প্রিয়ন প্রোটিনের কী ভুমিকা তা আজও সায়েন্টিস্টরা বের করতে পারেনি। কিন্তু এটা যে আলঝেইমার সহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যান্য রোগগুলোর মতো কুরুর ক্ষেত্রে কোনো ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া কাজ করছে না, বরং এর পিছনে রয়েছে এই প্রিয়ন এর কারসাজি। প্রিয়ন প্রোটিন হলো নির্জীব, অকার্যকর প্রোটিন যা মস্তিষ্কে সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং ক্লম্প তৈরি করে, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।Creutzfeldt-Jakob, Gerstmann-Sträussler-Scheinker ডিজিজ  এগুলোও প্রিয়ন প্রোটিন দ্বারা সৃষ্ট আরেক ধরনের ডিজেনারেটিভ ডিজিজ। এই স্পঞ্জিফর্ম রোগগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায়, মস্তিষ্কে স্পঞ্জ এর মতো হোল ব্যাপকভাবে তৈরি হতে থাকে।
কুরুর ক্ষেত্রে দীর্ঘ ইনকিউবেশন পিরিয়ড দেখা দেয় যেখানে লক্ষণ প্রকাশ পায় না৷এই উপসর্গহীন সময়কাল সাধারণত ৫-২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৫০ বছরও অতিক্রম করে। 
উপসর্গ প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনটি স্টেজ দেখা যায়।
অ্যাম্বুলেন্ট স্টেজঃ 
১. মাথাব্যথা
২. জয়েন্ট পেইন
৩. কাপুনি 
৪. ভারসাম্যহীনতা
৫. কথা বলার ক্ষমতা হ্রাস
৬. পেশিতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা 
সেডেন্টারি স্টেজঃ 
১. সাপোর্ট ছাড়া হাঁটতে অক্ষম 
২.মাংসপেশিতে অনুভুতি না থাকা
৩. তীব্র কাঁপুনি 
৪. মানসিক অস্থিরতা, 
টার্মিনাল স্টেজঃ 
১. কথা বলতে অক্ষমতা 
২. কোনো কিছু খেতে অক্ষম হওয়া 
৩. আশেপাশের পরিবেশে প্রতিক্রিয়া করতে না পারা 
৪. পুজ,  নেক্রোসিস সহ আলসারেশন, টিস্যু ডেথ।
সাধারণত, আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম টার্মিনাল পর্যায়ের লক্ষণ দেখা দেওয়ার 3 মাস থেকে 2 বছরের মধ্যে মারা যায়।
কুরু হলে ট্রিটমেন্ট কী? 
অত্যন্ত সুখকর খবর এই যে কুরু-র নির্দিষ্ট কোনো ট্রিটমেন্ট নেই। কুরু রোগের ক্ষেত্রে দায়ী যে প্রিয়ন- তা সহজে ধ্বংসও করা যায় না। প্রিয়নযুক্ত ব্রেইন ফরমালডিহাইড বছরের পর বছর রাখার পরও তা সংক্রামক থাকে।
কুরু-র নির্দিষ্ট কোনো ট্রিটমেন্ট নেই। এবং বিভিন্ন দেশের সরকার বহু আগেই এই ক্যানিবালিজম চর্চায় নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে কুরু-র কোনো রোগী নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এবং গবেষকদের মতে ২০০৫ সালে কুরুর সর্বশেষ রোগী মারা যায়। 
লেখায় – মিথিলা ফারজানা মেলোডি।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?