মাদারিজুস সালিকীন (আল্লাহর পানে যাত্রা) : লেখক : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ | Madarijus Salikin (Allahor Pothe Jatra)

  • বই : মাদারিজুস সালিকীন (আল্লাহর পানে যাত্রা)
  • লেখক : আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ
  • প্রকাশনী : ওয়াফি পাবলিকেশন
  • বিষয় : আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা
  • অনুবাদক : মাওলানা নাঈম আবু বকর
  • সম্পাদক : মুফতি মাহমুদুল হক
  • পৃষ্ঠা : 208, কভার : হার্ড কভার, সংস্করণ : 1st edition
  • ভাষা : বাংলা

ইমাম ইবনুল-কাইয়্যিম (রহ.)। মহান এই ইমামকে নতুন করে পরিচয় করে দেবার কিছু নেই। তিনি নিজেই বিশাল এক মহীরুহ। যার প্রতিটি ডালপালা আকায়িদ, তাফসীর, ফিকহ, আখলাক ইত্যাদি শাস্ত্র-গুণে গুণান্বিত। মূলত আত্মশুদ্ধি জগতে যেসকল সালাফ ও খালাফের খেদমত অনস্বীকার্য, তাদের ভিতর তিনি অন্যতম। কুরআন-সুন্নাহকে শতভাগ প্রাধান্য দিয়ে যে দর্শন জ্ঞান রেখে গেছেন, তা অনবদ্য।
তাঁর বিখ্যাত ‘মাদারিজুস সালিকীন’ গ্রন্থের নাম শোনে নি, ইসলামি অঙ্গনে এমন পাঠক মেলা ভার। বরং বছরের পর বছর ধরে আমরা অনেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনছি, এই মহান গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ কবে প্রকাশিত হবে। মাদারিজুস সালিকীন গ্রন্থটি মূলত একটি আয়াতের ওপর রচিত। সূরা ফাতিহার আয়াত ৫ নং আয়াত। মুমিনের আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে যে সকল গুণ অর্জন আবশ্যক, সেগুলো নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন এই আয়াতের আলোকে। তাকওয়া, ইখলাস, আশা, সবর, তাওয়াক্কুল, ভালোবাসা, মোট কথা অন্তরের যাবতীয় আমল এতে একীভূত করা হয়েছে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। গ্রন্থটির বিভিন্ন আলোচনা এত গভীর, এত তাৎপর্যপূর্ণ যে, একটি প্যারাগ্রাফ অবলম্বন করে পূর্ণ একটি প্রবন্ধ রচনা করা সম্ভব, সম্ভব ঘন্টাখানেক বক্তৃতা করাও।
মাদারিজুস সালিকীনের মতো দার্শনিক কিতাব সহজবোধ্য সাবলীল গদ্যে অনুবাদ করা দুরূহ। বিশেষ করে এর ভাষাশৈলী এত উন্নত যে, আরব পাঠকরাও সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে হিমসিম খান। আলহামদুলিল্লাহ, হাজার পৃষ্ঠার মাদারিজুস সালিকীন বইটির সংক্ষিপ্তসার নিয়ে এসেছে ওয়াফি পাবলিকেশন। সংক্ষিপ্ত হলেও প্রতিটি অধ্যায়ের শিক্ষা এতে উঠে এসেছে ইবনুল কাইয়্যিমের ভাষায়।

অনুবাদকের কথা

সকল প্রশংসা আল্লাহর। রাসুলুল্লাহ ও তাঁর আল-আসহাবের উপর হোক অগণিত
দরুদ ও সালাম। অতঃপর— আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ.-এর যথার্থ পরিচয় দেয়ার সাধ্য অধমের নেই। তিনি বিশাল মহীরুহ। আকায়েদ, তাফসির, ফেকাহ, আখলাক ইত্যাদি শাস্ত্রে তার অবাধ পাণ্ডিত্য সুবিদিত। এতকিছুর সঙ্গে তিনি ছিলেন যথার্থ এক দার্শনিক। সাধারণত দর্শনে নিজস্ব চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায়, কুরআন-হাদিস ও অন্যান্য বর্ণিত জ্ঞান হয়ে পড়ে অবহেলিত। ইবনুল কায়্যিম রহ. এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নুসুসকে শতভাগ প্রাধান্য দিয়ে ও তার মর্মের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেও যে দর্শনচর্চা করা যায়, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয় তার লেখায়। সচেতন পাঠকমাত্র স্বীকার করবেন—ইবনুল কায়্যিম রহ. একই সঙ্গে সুফী ও আসারী (নুসুসের সাধারণ মর্মের অনুসারী)। প্রকৃত সুফিবাদ ও আসার অনুসরণে যে কোনো সংঘর্ষ নেই, ইবনুল কায়্যিম তার প্রমাণ।
মাদারিজুল সালিকীন ইবনুল কায়্যিম রহ. এর বিখ্যাত এক গ্রন্থ, যাতে তিনি মুমিনের আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে যে সকল গুণ অর্জন আবশ্যক, সেগুলো নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটির বিভিন্ন আলোচনা এত গভীর, এত তাৎপর্যপূর্ণ যে, একটি প্যারাগ্রাফ অবলম্বন করে পূর্ণ একটি প্রবন্ধ রচনা করা সম্ভব, সম্ভব ঘন্টাখানেক বক্তৃতা করাও। আমি নিজেও জুমার বয়ানে ইবনুল কায়্যিম রহ.-এর কোনো পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ বয়ান উপস্থাপন করেছি একাধিকবার। গ্রন্থটি তাই সর্বশ্রেণীর পাঠকের খোরাক যোগাবে বলেই বিশ্বাস করি। উল্লেখ্য, বক্ষ্যমাণ অনুবাদ মাদারিজুস সালিকীনের চয়িতাংশের, যা সৌদি আরবের কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আহমদ বিন উসমান আলমাযীদ-কর্তৃক চয়িত।
গ্রন্থটি অনুবাদ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। অধমের আগ্রহ প্রধানত মৌলিক রচনায় হলেও, লেখক, বিষয়বস্তু ও ব্যক্তিগত কিছু বিষয় বিবেচনায় কাজটি গ্রহণ করেছি। আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসায় কাজ শুরু করার পর একমাত্র তাঁর তাওফিকেই তা সমাপ্ত হল।
মাদারিজুস সালিকীনের মতো দার্শনিক কিতাব সহজবোধ্য সাবলীল গদ্যে অনুবাদ করা দুরূহ। কাজেই অনুবাদে যথষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। যথাসাধ্য বাংলা আদর্শ গদ্যরীতি বজায় রেখেছি। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শব্দচয়ন করেছি। চটুল ও সংলাপসুলভ শব্দ পরিহার করেছি। জানামতে কোথাও মূলগ্রন্থের মর্ম বিকৃত করিনি। ইনশাআল্লাহ, পাঠকবৃন্দ গ্রন্থটি স্বাচ্ছন্দ্যে পাঠ ও অনুধাবনে সক্ষম হবেন। সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার, যিনি তাওফিক দিয়েছেন। বিশেষ কৃতজ্ঞতা ভাই মুফতি মাহমুদুল হকের প্রতি, যিনি কাজটি অধমের নিকট অর্পণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা গ্রন্থটির মূল লেখক, সংক্ষেপক, অনুবাদক, নিরীক্ষক, প্রকাশক, মূদ্রক সবার পরিশ্রম কবুল করুন। গ্রন্থটি মুসলমান ভাই-বোনদের জন্য যথার্থ উপকারী বানিয়ে দিন। এই দুঃসময়ে যারা ইসলামি বই পড়েন, তাদের সকলের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম।
-নাঈম আবু বকর
৯৫/২, শেখদী আইডিয়াল রোড, ধনিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর, যিনি সকল জগতের প্রতিপালক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রসূল।
হায়, আসমানি ওহি ও নববী ইলম থেকে বিমুখ লোকেরা বড়ই দুর্ভাগা! তাদের অন্তর নিষ্প্রাণ, তাদের অন্তর্দৃষ্টি নিষ্প্রভ। মহাগ্রন্থ কুরআনকে দূরে ঠেলে তারা মানবরচিত – দ্বিধাবিভক্ত ও অন্তঃসারশূন্য—মত-মতান্তরের পেছনে ছুটছে!
তারা কি ভেবেছে কুরআন-সুন্নাহর পরিবর্তে মনগড়া মতবাদ ও শাস্ত্রীয় যুক্তিতর্ক তাদের মুক্তি দেবে, আল্লাহ থেকে এবং তাঁর পাকড়াও থেকে? কখনোই নয়। এ অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
মুক্তি তো নিহিত কেবল আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত অনুসরণে, তাকওয়া অনুশীলনে এবং সীরাতে মুস্তাকিম অবলম্বনে। মানুষের পূর্ণতায় প্রয়োজন প্রকৃত ইলম ও বিশুদ্ধ আমল; এবং অন্যের প্রতি এই দুই বিষয়ের আহ্বান। আল্লাহ তাআলা বলেন,
والعصر * إن الإنسان لفي خسر * إلا الذين آمنوا وعملوا الصالحات وتواصوا بالحق وتواصوا بالصبر
(মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়,
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পর সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্যের উপদেশ দেয়।
(সূরা আসর: ১-৩)
এ সুরায় আল্লাহ তাআলা কসম খেয়ে বলেছেন যে, প্রত্যেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, তবে সে ব্যতীত, যে ঈমান দ্বারা জ্ঞানকে ও নেক আমল দ্বারা কর্মকে পূর্ণাঙ্গ করে; এবং অন্যকেও সত্য ও তার পথে ধৈর্যের তালিম দেয়। একমাত্র হক হচ্ছে ঈমান ও আমল, আর ঈমান-আমলের পূর্ণতায় প্রয়োজন সবর ও পরস্পর দাওয়াত।
সুতরাং মানুষের উচিত জীবনের মুহূর্তগুলো কাজে লাগানো; মহাসৌভাগ্য অর্জন ও মহাবিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষায় জীবনকে ব্যবহার করা। আর এ জন্য প্রয়োজন কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন, তাকে হৃদয়ঙ্গম ও তার মর্ম অনুধাবন। কারণ, কুরআনই মানুষের ইহ-পারলৌকিক মুক্তি মন্ত্র, তার গন্তব্যের পথনির্দেশ। কুরআন হতেই উৎসারিত হয় সকল বিশুদ্ধ হাকিকত-তরিকত ও ব্যক্তিগত চিন্তা-গবেষণা।
উপর্যুক্ত বিষয়ে আলোকপাত করতে আমি এ গ্রন্থে সুরা ফাতেহা ও তার মর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেছি। গ্রন্থটিতে পাঠক লক্ষ করবেন—সুরা ফাতেহায় কীভাবে আবেদ ও আরেফগণের মাকামসমূহ আলোচিত হয়েছে, কীভাবে ভ্রান্ত ও বিদআতি গোষ্ঠীগুলোকে নাকচ করা হয়েছে এবং কেন সুরা ফাতেহা তাওরাত, ইঞ্জিল, এমনকি স্বয়ং কুরআনে কারীমেও নজিরবিহীন! আল্লাহই সহায় এবং তাঁর ওপরই ভরসা।

ফাতেহায় আলোচিত দীনের মৌলিক বিষয়াবলি

সুরা ফাতেহায় অঙ্গীভূত হয়েছে দীনের মৌলিক বিষয়াবলির সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ আলোচনা। যথা:
মাবুদের পরিচয়:
সুরা ফাতেহায় আল্লাহ তাআলার এমন তিনটি নাম উল্লেখ হয়েছে, যা সমগ্র আসমায়ে হুসনার কেন্দ্রবিন্দু— আল্লাহ, রব ও রহমান। ইলাহিয়্যাত (উপাস্যতা), রবুবিয়্যাত (প্রতিপালকত্ব) ও রহমত এই তিন সিফাতের ওপরই সুরা ফাতেহার ভিত্তি। ‘গূঢ়! ‘—অর্থাৎ আল্লাহ ইবাদতের যোগ্য হওয়া তাঁর ‘উপাস্য’ হওয়ার ভিত্তিতে। • ‘—অর্থাৎ শুধু তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা তাঁর ‘প্রতিপালকত্ব’-এর ভিত্তিতে। আর ‘—অর্থাৎ তাঁর সকাশে সরল পথের দিশা চাওয়া তাঁর ‘দয়া ও করুণা’-এর ভিত্তিতে। এমনিভাবে ‘হামদ’ (আল্লাহর প্রশংসা) এর মধ্যেও এ তিনটি বিষয় নিহিত রয়েছে; অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রশংসিত তাঁর ইলাহিয়্যাত, রবুবিয়্যাত ও রহমতের ভিত্তিতে। সহজ কথায়— উপাস্যতা, প্রতিপালকত্ব ও দয়ার ভিত্তিতে।
আখিরাতের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা:
সুরা ফাতেহার আয়াত (যিনি বিচার-দিবসের মালিক ৯-এ নিহিত রয়েছে পরকাল, হিসাব-নিকাশ ও নেয়ামত আযাবের ঘোষণা; ইঙ্গিত রয়েছে—আল্লাহ তাআলাই হবেন সেদিনের একচ্ছত্র বিচারক এবং তাঁর বিচার হবে সর্বোচ্চ ইনসাফপূর্ণ।
নবুয়তের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা:
সুরা ফাতেহায় নবুয়তের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বেশ কয়েকটি পন্থায়; যথা:
১। আল্লাহ তাআলার ‘রব্বুল আলামীন’ হওয়া। কারণ, রব্বুল আলামীন বান্দাদের উদ্দেশ্যহীন ছেড়ে দিতে পারেন না। নিশ্চয় তিনি তাদের ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথে পরিচালিত করবেন। আর তার জন্য প্রয়োজন নবী-রসূল।
২। ‘আল্লাহ’ নামের উল্লেখ। কারণ, ‘আল্লাহ’ অর্থ হচ্ছে মাবুদ বা উপাস্য। আর ইবাদতের পথ-পন্থা নবী ছাড়া জানা সম্ভব নয়।
৩। আল্লাহ তাআলার ‘রহমান’ নামের উল্লেখ। কারণ, রহমতের দাবি বান্দাদের পথপ্রদর্শন করা।
৪। ‘বিচার দিবস’-এর উল্লেখ। কারণ, বিচার দিবসে বান্দার আমলের হিসেব নেওয়া হবে এবং ভালো কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের শাস্তি দেওয়া হবে। অথচ আল্লাহ তাআলা যথাযথ অপরাধ ছাড়া কাউকে শাস্তি দেবেন না এবং সে অপরাধ প্রতিষ্ঠিত হবে নবী-রসূলগণের দাওয়াত অমান্যের মাধ্যমে। সুতরাং বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে নবুয়তের ওপর নির্ভরশীল।
৫। ( আমরা আপনারই ইবাদত করি; আয়াতটি। কারণ, নবী-রসূলগণ ছাড়া আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় ইবাদতের পদ্ধতি জানা সম্ভব নয়।
৬। আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করুন আয়াতটি। কারণ, হিদায়াত বা পথপ্রদর্শন নবী-রসূলগণ ছাড়া সম্ভব নয়।

ফাতেহায় সিরাতে মুস্তাকিমের আলোচনা

সুরা ফাতেহায় সিরাতে মুস্তাকিমের উল্লেখ হয়েছে একবচন ও নির্দিষ্টরূপে, যা ইঙ্গিত করে—সিরাতে মুস্তাকিম একটি এবং তা সুনির্দিষ্ট। অন্যদিকে ভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের পথ বহুবিধ। এ কারণেই কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা সঠিক পথকে একবচনে ও ভ্রান্ত পথকে বহুবচনে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وأن لهذا صراطئ مستقيماً فاتبعوه ولا تتبعوا الشبل فتفرق بكم عن سبيله
(এবং এই পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ
করবে না, করলে তা তোমাদের তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে।)
(সূরা আনআম: ১৫৩)
দেখুন, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘আমার পথ’ ও ‘তাঁর পথ’ তথা সিরাতে মুস্তাকিমকে একবচনে উল্লেখ করেছেন; অন্যদিকে ভ্রান্ত পথগুলোকে উল্লেখ করেছেন ‘বিভিন্ন পথ’ বলে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, ‘রসূল আমাদের সম্মুখে একটি রেখা টানলেন এবং বললেন, ‘এটি আল্লাহর পথ।’ অতঃপর প্রথম রেখাটির ডানে ও বামে আরও কিছু রেখা টেনে বললেন, ‘এগুলো বিভিন্ন পথ, যার প্রতিটিতে একটি করে শয়তান দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করছে।’ তারপর তিনি তিলাওয়াত করলেন—
وأن هذا صراطی مستقيماً فاتبعوه ولا تتبعوا الشبل فتفرق بكم عن سبيله ذلكم وصاكم به لعلكم تتقون ادا
আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার পথ কেবলই একটি। সে পথের দিশা দিতেই আল্লাহ তাআলা রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন। এ ব্যতীত অন্য কোনো পথে আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব নয়। সিরাতে মুস্তাকিম আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত এবং আল্লাহ পর্যন্ত সুগম। এ পথ ছাড়া অন্য যে পথেই মানুষ অগ্রসর হোক, দেখবে পথ বন্ধুর; যে দুয়ারেই করাঘাত করুক, দেখবে দুয়ার রুদ্ধ।
সিরাতে মুস্তাকিম স্বয়ং আল্লাহর পথ
সিরাতে মুস্তাকিম হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ তাআলার পথ। আল্লাহ তাআলা এ পথের সঙ্গে তাঁর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন—
১। সিরাতে মুস্তাকিম তাঁর প্রতি সম্পৃক্ত, অর্থাৎ তাঁর নিকট পৌঁছে দেয়; ২। তিনি সিরাতে মুস্তাকিমের প্রতি সম্পৃক্ত, অর্থাৎ তাঁর সকল কথা ও কর্ম সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তথা সঠিক ও নির্ভুল।
প্রথমটির দৃষ্টান্ত
আল্লাহ বললেন, এটি আমা-পর্যন্ত সরল পথ।) (সূরা হিজর: ৪১)
দ্বিতীয়টির দৃষ্টান্ত—
ما من دابة إلا هو أخذ بناصيتها إن ربي على صراط مستقیم
( এমন কোনো জীবজন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়; নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক আছেন সরল পথে।
(সূরা হুদ: ৫৬)
বস্তুত সিরাতে মুস্তাকিম অবলম্বনের অভিধা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সর্বাধিক মানানসই। কারণ, যেমন তাঁর কথামালা সত্য ও নির্ভুল, প্রজ্ঞা ও ইনসাফে পূর্ণ; তেমনি তাঁর কার্যাবলিও সংগত ও প্রজ্ঞাময়, দয়া ও কল্যাণে ভাস্কর। তাঁর কথা ও কাজে কোনো মন্দ বা অকল্যাণের স্থান নেই। কারণ, সকল অকল্যাণ সিরাতে মুস্তাকিম-বহির্ভূত। যিনি সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত, তার কথা কাজে কীভাবে অকল্যাণ প্রবেশ করতে পারে!

সিরাতে মুস্তাকিমের সহযাত্রী

সিরাতে মুস্তাকিমের পথিক প্রাথমিক দৃষ্টিতে নিঃসঙ্গতায় ভুগতে পারে। কারণ, তার লক্ষ্য ও গন্তব্য পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছেই মূল্যহীন। মানুষ নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে না; বরং তা ভয় করে। তাই এ পথের পথিকের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতেহায় ঘোষণা দিয়েছেন—সিরাতে মুস্তাকিম হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের পথ। কুরআনে কারীমে অন্যত্র ‘নেয়ামতপ্রাপ্তদের’ বিবরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে—
فأولنيك مع الذين أنعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين وحسن أولئك رفيقاً
(সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ—যাদের প্রতি
আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন—তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী!
(সূরা নিসা: ৬৯)
অর্থাৎ, সিরাতে মুস্তাকিমের পথিকের ভয় নেই। আশপাশের মানুষের বিরোধিতায় তার মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কারণ নেই। তার সঙ্গী তো নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও দুনিয়ার সকল নেককারগণ। সিরাতে মুস্তাকিমের ‘বিরোধীরা’ সংখ্যায় বেশি হতে পারে, কিন্তু মর্যাদায় এ পথের পথিকদের ধারেকাছেও নেই।

সিরাতে মুস্তাকিমের হিদায়াত-প্রার্থনার পদ্ধতি

যেহেতু সিরাতে মুস্তাকিমের হিদায়াত প্রার্থনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং তা অর্জন করতে পারাও মহা-সৌভাগ্য, তাই আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতেহায় সিরাতে মুস্তাকিমের হিদায়াত-প্রার্থনার পদ্ধতি বিশেষভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রথমে এনেছেন আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণকীর্তন, এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বান্দার দাসত্ব ও তাওহিদের বয়ান। দুটিই আল্লাহর কাছে প্রার্থনার বিশেষ ওসিলা—একটি আল্লাহ তাআলার নাম ও সিফাতের ওসিলা, অপরটি নিজের দাসত্ব ও ইবাদতের ওসিলা। এই দুই ওসিলায় দুআ করলে সাধারণত দুআ নামঞ্জুর হয় না।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?