বুঝেছ রিমি, বর্ষায় গ্রামে আসার এই এক আনন্দ, শ্বাসের সাথে সাথে মাটির ঘ্রাণও নাকে এসে লাগে।
রাশেদ গাড়ির জানালার গ্লাস অর্ধেক নামিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কথাটা বলে পাশে তাকিয়ে দেখে স্ত্রী রিমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। এই মাত্র যে সে কিছু বলেছে সেটা তার কান পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে মনে হয় না।
গত কয়েক বছর গ্রাম থেকে দূরে থাকলেও আজ জমিজমাসংক্রান্ত একটা কাজে যেহেতু গ্রামে আসতেই হচ্ছে, তাই ভাবলো স্ত্রী আর ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ঘুরে আসা যাক।
রিমি প্রথমে গ্রামে যাওয়ার কথা শুনেই রেগে গিয়েছিল। কিন্তু ছয় বছরের ছোট্ট রাহিকের জেদের কাছে হার মেনে এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে আসতে হলো। যার ফলাফলস্বরূপ এখন মুখ ভার করে বসে আছে।
চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বৃষ্টি দেখায় মন দেয় রাশেদ।
অল্প কিছুক্ষন পরেই গ্রামের শেষ প্রান্তের নীল রঙের লোহার গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামলো।
গেইটের ওপাশে গাছপালার মাঝখান থেকে সাদা একতলা বাড়িটি উঁকি দিচ্ছে।
ড্রাইভারের পাশে বসা ঘুমন্ত রাহিককে জাগিয়ে তুলে গাড়ি থেকে নামতেই গেইটের ডান পাশে চোখ আটকে গেলো রাশেদের।
ধুলোবালির স্তর আর শেওলা জমাট বেধে থাকলে ও কালো কালিতে লেখা “হামিদা ভিলা” নামটা পড়তে তেমন অসুবিধা হয়নি।
নামটার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গেল রাশেদ।
মনে হলো গেইটের ওপাশেই বুঝি রঙচটা মলিন শাড়ি পরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।
এরকম একজনই তো “ছিল”, যে রাশেদের কলেজ জীবনে ছুটি শেষে সে বাড়ি থেকে শহরে যাবার সময় চোখে মুখে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে গেইট ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। “ছিলো” এজন্য বলছে কারন রাশেদ ঠিক জানে না, এই মানুষটা এখন আর আছে কিনা।
২.
– আব্বু দেখো দেখো হাঁস! আমি আমার বইয়ে না হাঁসের ছবি দেখেছিলাম!
রাহিকের উচ্ছ্বসিত আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলো রাশেদ।
ষাটোর্ধ খলিল চাচাও ততক্ষণে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
রাশেদের বাবা মারা যাওয়ার পর ওরা সবাই শহরে পাড়ি জমালে তাদের অনুপস্থিতিতে এ বাড়ি দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়ভার গিয়ে খলিল চাচার উপর পড়ে। যথেষ্ট বিশ্বস্ত বলেই নিশ্চিন্তে উনাকে এই দায়িত্ব দেয়া সম্ভব হয়েছে।
– বাবা আসছ তোমরা? পথে কোনো সমস্যা হয় নাই তো? বৌমা ভালো আছো? এটা কি আমাদের দাদুভাই নাকি! মাশাআল্লাহ, দেখতে একদম ছোটবেলার তোমার মতোই লাগছে!
মুখে হাসি ঝুলিয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বলছিলেন খলিল চাচা।
– তা বাবা, তোমার আম্মা মানে আমাদের বড় ভাবী আসেন নাই?
এতক্ষণ খলিল চাচার কথা শুনতে শুনতে মুচকি হেসে হালকা মাথা নাড়ালেও শেষ কথাটা শুনে রাশেদ আর তার স্ত্রী দু’জনেই হঠাৎ থম মেরে গেল।
-আচ্ছা, চাচা চলুন আমরা বরং ভেতরে যাই। বেশিক্ষম বৃষ্টিতে ভিজলে আবার রাহিকের জ্বর চলে আসবে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে কথা ঘুরিয়ে খলিল চাচাকে কোনো রকম পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে এল তারা। খলিল চাচার এই কথার জবাবে কী বলা উচিত তা তাদের জানা নেই।
৩.
প্রায় অনেকটা সময় ধরে বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে বসে আছে রাশেদ। রাশেদের বাবা খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। এই বাড়িটা বানানোর সময় পুকুর ঘাটটা খুব যত্ন করে বাঁধিয়েছিলেন তিনি।
বাপ-ছেলে মিলে পুকুরের সিঁড়িতে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, কিংবা বৈশাখের মধ্য দুপুরে ছোট্ট রাশেদ কে সাঁতার শিখানোর চেষ্টা–এই পুকুর পাড়কে ঘিরে অতীতে ঘটে যাওয়া এরকম প্রত্যেকটা ঘটনা যেন আজ স্মৃতির পাতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে!
সেবার যখন কলেজের গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এলো বাবা তখন পুকুর থেকে একটা বড় কাতলা মাছ ধরেছিল।খেতে বসে রাশেদের প্লেটে বড় লেজের অংশটা তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘নে বাবা, এটা তুই খা। বড় মাছের লেজ খাওয়ার মজাই আলাদা।’
রাশেদ একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই হয়তো বাবার হাসিহাসি মুখের ওপাশে একটু কষ্টও দেখতে পেত।
আজ এ সময়ে সে এসে নিজেকে প্রশ্ন করে, বাবার কি তখন একবারের জন্যেও বড় মাছের লেজ খেয়ে মজা পেতে ইচ্ছা করতো না?
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই মনে উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে।
রাশেদ পুকুর পাড় থেকে এসে বাড়ির ভিতর ঢুকল।
আজ পাঁচ বছর পর এসেছে এ বাড়িতে।
শেষবার মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে এসেছিল। বলতে গেলে ইচ্ছার বিরূদ্ধে এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিয়ে যেতে হয়েছিল।
স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রী বাড়িতে একা আছেন, আর তাদের একমাত্র ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে শহরে থাকে, গ্রামে সামাজিক ভাবে বিষয়টা খুব “প্রশ্নবিদ্ধ” হয়ে উঠেছিল।
আত্নীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের উপহাস কিংবা ফোনের ওপাশ থেকে হামিদা বানুর কান্না মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ–এগুলোর কোনোটাই উপেক্ষা করতে পারল না রাশেদ।
বলতে গেলে এক প্রকার সামাজিক দায়ভার এড়ানোর জন্যই পাঁচ বছর আগে মাকে গ্রাম থেকে ইস্কাটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল।
সেদিন মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা আগে থেকে রিমিকে বলার সাহস হয়নি তার। বাসায় যাওয়ার পর রিমির অগ্নিমূর্তি দেখেই বুঝে গিয়েছিলো না জানিয়ে মাকে নিয়ে এসে সে বোধহয় অনেক বড় “অন্যায়” করে ফেলেছে।
৪.
যোহরের আগেই গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ আরো কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে রাশেদ জমির কাজটা সেরে ফেলে।
খলিল চাচার স্ত্রী অল্প সময়ের মধ্যে সাধ্যমতো বেশ ভালোই দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছে।
রাশেদের বাবার আমলের পুরোনো সেই ডাইনিং টেবিলটাতেই খাবার পরিবেশন করা হয়েছে।
ডাইনিং টেবিল বলতে কালো রঙের ভার্নিশ করা চারপায়া একটি টেবিল, আর চারপাশে চারটে চেয়ার। সেগুলোও কালো ভার্নিশ করা।
এই ডাইনিং টেবিলটাই এক সময় তাদের পারিবারিক সংসদ ছিলো।
বন্ধুদের সাথে ঐ পাড়ায় ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে যাবে কিংবা কলেজের বনভোজনের জন্য কিছু টাকা লাগবে–খেতে বসে প্লেটের ভাতগুলো নাড়তে নাড়তে নিচুস্বরে এরকম হাজারো আবদার বাবার কাছে করেছে।
আর এসব ব্যাপারে মা বরাবরের মতোই “তোর বাবা অনুমতি দিলে আমার কিছু বলার নাই”–এরকম টাইপের মতামত দিতেন।
এ বাড়িতে আসার পর সকাল থেকে রাশেদ যতই আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলো না কেন, খাবার টেবিলে বসার পর মনে হচ্ছে ও আর সহ্য করতে পারছে না।
এ বাড়িতে আজ প্রথমবার মাকে ছাড়া খেতে বসেছে।
বাবা মারা গিয়েছে এই সত্যিটা তো সে খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু মা বেঁচে আছে কিনা সেই খবরটা গত কয়েক বছরে একবারের জন্যও সে এটা জানতে চায়নি।
বাবা-মাকে ঘিরে পুরোনো স্মৃতিগুলো রাশেদের ভেতরটা যখন দুমড়ে-মুচড়ে ফেলছে, ঠিক তখনই টেবিলের অপর পাশে পৃথিবীর আরেকজন মা তার সন্তানকে পরম আদরে খাইয়ে দিচ্ছে।
ইস্কাটনের ১৫ তলা এপার্টমেন্টের সামনে যখন গাড়ি এসে থামলো চারপাশে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
রাশেদ বেশ গম্ভীর অথচ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো, ‘রিমি তুমি রাহিককে নিয়ে বাসায় যাও।
আমি আসছি। আর ড্রাইভার সাহেব গাড়ির চাবিটা আমাকে দিয়ে আজকের মতো আপনি যেতে পারেন।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ড্রাইভিং সিটে বসে রাশেদ সিটবেল্ট বাঁধতে লাগলো। পাশ থেকে রিমি কিছু বলে উঠতে চাইলেও রাশেদের থমথমে চেহারা দেখে আর কিছু বলার সাহস হলো না তার।
৫.
বাম হাতটা উল্টিয়ে একবার সময় দেখে নিল রাশেদ, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি।
প্রায় দশ মিনিট ধরে গাড়ি থামিয়ে বসে আছে রাশেদ। কেন যেন বাড়ির ভিতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না ।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্টভাবেই বাড়ির নামটা দেখা যাচ্ছে। “বৃদ্ধানিবাস”।
হ্যাঁ, “হামিদা ভিলা”র সেই হামিদা বানু আজ চার বছর যাবৎ এখানেই আছেন।
গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার পর স্ত্রী রিমির তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে ও মাকে কোনো রকম ছয় মাস তাদের সাথে রাখতে পেরেছিল।
বাচ্চা-সংসার সামলে বাসায় রেখে মা কে
সঠিক যত্ন করা যাচ্ছে না, বরং ওল্ডহোমেই মা ভালো থাকবেন। এরকম একটা চিন্তা রাশেদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর মেরুদন্ডহীন রাশেদও সেটাকে সত্যি ভেবে চার বছর আগে কোনো এক বিকেলে মাকে এখানে রেখে গিয়েছিল।
প্রথম কয়েক মাস যোগাযোগ রাখলেও রিমির চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত সেটাও বন্ধ করে দিতে হলো। বছরের শুরুতে ১২ মাসের বিল একত্রে পরিশোধ করেই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যেত।
– প্লিজ নামটা আরেকবার বলবেন?
রিসিপশন টেবিলের ওপাশে থাকা ভদ্রলোক রেজিস্ট্রেশন খাতা চেক করতে করতে রাশেদকে জিজ্ঞেস করলো।
– জ্বী, হামিদা বানু। এড্রেস হচ্ছে ইস্কাটন, রোড…।
– আপনি উনার কে হন?
কথা শেষ করার আগেই ওপাশের মানুষটি খাতা থেকে চোখ সরিয়ে বেশ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
– ছেলে, আমি উনার ছেলে হই।
ভদ্রলোক তখনও তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিন্তু এবার উনার দৃষ্টিতে শুধু ঘৃণা ছিলো।
খুব স্থির কন্ঠে বললেন, ‘উনি গত মাসের ৭ তারিখ মারা গিয়েছেন।’
ধপ করে রিসিপশনে রাখা চেয়ারে বসে গেলো রাশেদ। পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছে সে।
তৎক্ষণাৎ হিসেব মিলিয়ে দেখলো গত মাসের ৫-১০ তারিখ সে পরিবারসহ ব্যাংকক ট্যুরে ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর এরা নিশ্চয়ই যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু ঐ সময়টায় সে দেশের বাইরে থাকায় সেটাও সম্ভব হয়নি।
– দাফন কোথায় হয়েছে?
নিজেকে সামলে নিয়ে কোনো রকম কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল রাশেদ।
– আমাদের এখানে কারো মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আজিমপুর নিয়ে দাফন করা হয়।
ভদ্রলোক আগের মতোই ঘৃণামাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিলেন।
একটু পর ভেতর থেকে একজন মহিলা কিছু জিনিস নিয়ে এসে বললেন, ‘এগুলো আপনার মায়ের ব্যবহার্য জিনিস। প্রয়োজন মনে করলে নিয়ে যেতে পারেন।’
রাশেদ তাড়াহুড়ো করে ভদ্রমহিলার হাত থেকে জিনিসগুলো নিল। মলিন কয়েকটা শাড়ির সাথে একটা ছেঁড়া জায়নামাজ, আর সবার ওপরে গিলাফবাঁধা কোরআন শরীফ।
এই মহিলাকে সে কিভাবে বুঝাবে আজ তো শুধু জিনিসগুলো নয়, বরং এই জিনিসগুলোর মালিককে তার বড্ড প্রয়োজন।
সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো রাশেদ।
ইতোমধ্যে বাইরে মেঘের গর্জনসহ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তার এই কান্নার শব্দ বেশি দূর যাচ্ছিল না।
কিন্তু সকালের মতো এখনও জানালার গ্লাস অর্ধেক নামিয়ে রাখায় কোত্থেকে যেন ভেজা মাটির ঘ্রাণ ঠিকই নাকে এসে লাগলো।
রাশেদ অনুভব করল, ভেজা মাটির ঘ্রাণ সবসময় সুখকর হয় না।
ভেজা মাটির ঘ্রাণ
সুমাইয়া জহির
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?