বইয়ের নামঃ”বিষণ্ণ জোছনা”
লেখকঃ সাঈদ আজাদ
প্রথম প্রকাশঃএকুশে বইমেলা২০২০
ধরণ: উপন্যাস
মূল্যঃ ৬০০ টাকা মাত্র
মোট পৃষ্ঠা:৩৮৪
ভালোবাসার আরেক নাম বিষণ্ন জোছনা। আসলেই কী শুধু ভালোবাসা? নাকি রয়েছে সে জোছনায় এক বিশাল বিষণ্নতার ছাপ।
তরুণ কথা সাহিত্যিক সাঈদ আজাদ স্যারের বিষণ্ণ জোছনা উপন্যাসটি চরম বাস্তবতার নিরিখে সদ্য গ্রামীণ ভাষায় রচিত কয়েকটি পরিবারকে নিয়ে গড়ে উঠেছে। মনে হয় সেই পরিবার গুলো আমাদেরই চারপাশ। হয়ত আমাদের মধ্যে কেউ তৌফিক কেউ জোনাকি আবার কেউ বা সায়রা,আম্বিয়া,সিরাজ,মিরাজ, টুনিটুনি হয়তবা রয়ে গেছে বায়জিদ,জামান,রফিক,আমজাদ,
সোনিয়া,তারাবিবি আমেনা আর রত্মার সমআত্মা।
মাটির লোভে পৃথিবী আজ এক মৃত্যু নেশায় ছুটে চলেছে।
মিরাজ কী তাই সবার মতোই নেশায় পড়েছে বড় ভাই সিরাজের ভাগের মাটির জন্য।মিরাজ কী তার বাবাকে ভুলিয়ে নাকি বাবার মৃত্যুর পর হাতের ছাপ নিয়ে জমিজমা নিজের নামে করলো।নাকি বৌ রত্মা আর দুই শালার প্ররোচনায় এমন নিকৃষ্ট কাজটি করেছে। জানে হয়ত সে আর তার আল্লাহ।
লেখক সাঈদ আজাদ সেটায় তো দেখিয়েছে এ উপন্যাসের প্রথম উপক্রমণিকায়।
সিরাজের দীর্ঘ পরিবার পিঠাপিঠি তিন
মেয়ে এক ছেলে বায়জিদ। বরং মিরাজের তো কোনো সন্তান হয়নি রত্মার গর্ভে।তারা তো দুজন।
তারপরেও কেনো এতো নির্মমতা।আসলেই এটায় কী বর্তমান বাস্তবতা? হয়তো তাই বোঝাতে চেয়েছেন সাঈদ আজাদ।
দুঃখ কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা বলে একটা শব্দ থাকে।থাকে ভালোলাগার একটা বিষয়।তা না হলে মানুষতো আর বাঁচতে পারে না। তাই নয় কী?
যদি ভালোবাসা না থাকতো উপন্যাসের মাঝপথে অনন্ত কয়েকটি চরিত্র বিলিন হয়ে যেতো।
কঠিন হাতে আর ভালোবাসার মেলবন্ধন ঘটিয়ে চরিত্র গুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন বিষণ্ণ জোছনা স্রষ্টা কবি সাঈদ আজাদ।
সিরাজের বড় মেয়ে জোনাকি দেখতে শুনতে ভালোই ছিল।একদিনের দর্শনেই মৃদু ভালোলাগার জন্ম।তারপরে সুদর্শন তৌফিকের প্রবল সাড়াতে মিশেছিল তারা ভালোবাসা আর প্রেমের বন্ধনে।পবিত্রও ছিল তাদের ভালোবাসার মধ্যটা।
জমির নেশায় তো মিরাজ সিরাজের নামে মামলা করেছিল।সালিশিতে বড় গলাই সব জমিন নিজের দাবী করছিল।করবেই না কেনো এখনকি বর্তমানে আর শালিসিতে ন্যায্য বিচার হয়?
হুম,আমি বলবো হয়না। ঠিক তেমনটাই হয়েছিল ওদিন।ঘুষের টাকায় মেতেছিল গ্রামের মাতব্বররা হয়তো এক আধজন বাদে।তাইতো কেউ কথা বলেনি সিরাজের হয়ে। তাছাড়া বাবার সইও তো ছিল দলিলে।তাই আর কিছুই হয়নি সেদিন।
তৌফিক যাত্রা প্রেমী।সেই বাল্য থেকেই যাত্রার প্রতি তার কেমন জানি একটান।এজন্যই হয়তো যাত্রা করে বেড়ায় এ গ্রাম ও গ্রাম,শহর থেকে শহরের প্রান্তে।
তৌফিক জোনাকিকে ছাড়তে পারে কিন্তু কেনো জানি যাত্রাকে নয়।
দুজনে কতই না ঘুরেছে এক সাথে নদীর ধারে।শুয়ে-বসে গল্প করে কাটিয়েছে বালির উপরে।
তৌফিকের সাথে জোনাকির পরিচয়ের মাধ্যমই তো জোনাকির ছোট ভাই বায়জিদ।সেদিন রাতে যদি যাত্রার সময় বৃষ্টি না হতো তাহলে কি আর আসতো তৌফিক জোনাকিদের বাড়ি। হয়তো এটায় ললাটের লিখন।
বায়জিদ চরিত্রটা আসলেও কেমন জানি।সে পুরুষ মানুষ,কৈশোর থেকে আবছা যৌবনের কাছাকাছিতে পা রেখেছে। কেনো জানি তার সমবয়সী ছেলেদের প্রতি এক দৈহিক আকর্ষণ।মিশে যেতে ইচ্ছে হয় ইমরান আর জামানের সাথে।
ঝুমুর তো পছন্দ করতো বায়জিদকে কিন্তু মেয়েদের প্রতি তার কোন লালসা ছিল না।বিপরীতে ছেলেদের দেখলেই লজ্জাই শিহরিত হতো তার মন আর দেহ।
মিরাজের অত্যাচারে সিরাজ জর্জরিত আর বিষণ্ণতায় ভুগছে সর্বক্ষণ। আপন ভাই হয়ে এমন জুয়াচুরি করলো।ছিঃ ছিঃ !
দুঃখের কী আর শেষ আছে বিধবা আম্বিয়া আর সায়রার।দুজনেই তো ভিটা মাটি বলতে কিছু নেই।আম্বিয়া তো জায়েদের নাতি ঝাটা খেয়েই থাকতো মৃত স্বামীর কুঁড়ে ঘরটায়।
কিন্তু সায়রা তো তাও নাই। ছোট মেয়ে টুনটুনিকে নিয়ে পরের বাড়িতে থাকে। মনে ভয় কখন জানি বাড়ির মালিক এসে নামিয়ে দেয় পথে ঘাটে।
লেখক সমাজ বাস্তবতাই দেখিয়েছে সেই অমর বাণী,
★”শুধু ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাধা যায় না”
কেনো জানি দাঁত থাকতেও দাঁতের মর্ম বুঝেনি তৌফিক। জোনাকি বিয়ের আগেও তো ফোন করে তৌফিককে যাত্রা থেকে ফিরে আসতে বলেছিল।কিন্তু তৌফিক তো ভালোবাসতো জীবনের চেয়ে বেশি।তাহলে কেনো এলো না জানাকির বিয়ের সংবাদটা শুনেও।কেনই বা ওদিন বড় হলো যাত্রার সিন। এটায় কি আমাদের চারপাশ।
মেয়ে জিনিস তো আর যুবতী হলে রাখা যায় না।সেটা আমি আপনি সবাই জানি তাই সিরাজ ভালোই করেছিল বিয়েটা দিয়ে। তবে একবার হলেও মেয়ের পছন্দের কেউ ছিল নাকি জানতেই এমনকিবা সমস্যা ছিল।
অবশেষে রফিকের সাথে বিয়ে হলো জোনাকির।সুখ হয়তো ধরা দিলো জোনাকির জীবনে এমনটাই তো ভাবছিল আমেনা আর সিরাজ।
কিন্তু কে বা জানে ভালোবাসা মানে কোন বাঁধা, মানে না কোন কলঙ্ক।
ঠিক যেমন কলঙ্ক করেছিল বায়জিদ। নিজের পুরুষত্বের পরীক্ষা করতে গিয়েই হত্যা করে ফেলে টুনটুনিকে। পরে নিজেও আত্মহত্যা করলো।
এমন হাজারও বায়জিদ আছে বর্তমান সমাজে একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পায়।আসলেই লেখাটাই তো বর্তমানকে ঘিরে।তা না হলে তো আমেনা তার ন্যায্য সম্পদ পেয়েই যেতো।
অনেক মানুষ দেখি অন্যের দুঃখকে নিজের করে নেই।যদিও বাংলাদেশের ষোল কোটির মধ্যে হয়ত এক,দু কোটিই এমন।
জামান মেয়ে মরা দুঃখী সায়রাকে বিয়ে করে। সায়রাকে সুখে রাখতে চায়।কিন্তু সুখ যে ছিল না জামানের কাছে।কোনদিনও বাবা হতে পারবে না জামান দিনের পুরুষ রাতের তো নয়। সায়রা শরীরের সুখ না পেলেও জামানকে কেনো জানি ভালোবেসেছে মন প্রাণ দিয়েই। এজন্য হয়ত এটা ভালোবাসার গল্প।
বিয়ের পরেও জোনাকি আর রফিক এক সাথে থাকলেও জোনাকি তৃপ্তি পায় না। রিরংসায় আনতে চায় তৌফিককে।কেনো জানি রফিককে তার মানতে কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কি আর কিছু ভালো লাগতে পারে। না পারে না।সব কিছু এলোমেলো লাগে।
বিয়ের পরেও ভাবতে ভালোলাগে সেই সূদুর অতীত।ভালো লাগে সেই পাশাপাশি হাঁটাচলা।
উপন্যাসটি পড়েই যে আমিও ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে ছিলাম সেই আমার অষ্টম শ্রেনির সে দিনটিতে।
আসলেই ভুলে থাকা যায়না প্রথম ভালোলাগা, প্রথম ভালোবাসা।
সেই কারণেই তৌফিকের মৃত্যু হয়ত জোনাকির সিন্দুকের ভিতর।ভালোবাসার মানুষটিকে মৃত্যুর আগে শেষ দেখা হয়ত ভালোবাসার পরিপূর্ণতা।
উপন্যাসটিতে ছোটখাটো কয়েকটি ভুল ছাড়া তেমন কিছুই ভুল পেলাম না। শুধু কয়েকটা চরিত্র এলো গেলো গতি পেলো না এমন ভাব আরকি।প্রকৃত পাঠক হলে বইটি পড়তে তেমন কোন সমস্যা হবে না আমি মনে করি।
আর সমকামিতা তো আছেই সমাজে ভূরিভূরি।আসলে এটাকে ভুল না বললেও মন্দ হয় না। তাই ভুলটাকে এড়িয়ে যাচ্ছি।
চরম বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে উপন্যাসটির জুড়ি নেই।
বিষণ্ণ জোছনা উপন্যাসটি যেনো কজন অসুখী মানুষের গল্প।ভালোবাসা প্রত্যাশী কজন মানব- মানবীর প্রতিক্ষার গল্প।
১) সকল পূর্ণিমা এক নয়।কোন পূর্নিমায় মানুষ সব হারায়।কোন পূর্ণিমায় মানুষ সব পায়।চাঁদের তাতে কিছু আসে যায় না।সে নিরাসক্ত থেকে নিজেকে নিঃশেষ করতে থাকে।পূর্ণিমা থেকে চলে যায় অমাতে।
২)ভালোবাসা! কী এক অদ্ভুত শব্দ! যে বাসেনি, তাকে এই শব্দের মানে যেনো ঠিক বোঝানো যাবে না।
৩)পৃথিবীতে মানুষ হওয়ার বড় একটা কষ্ট হলো মানুষ হলে চোখের জল ফেলতে হয়।
৪)মানুষের মন বড় বেয়ারা! বড় বেহায়া! মানুষ মনে মনে যা করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে,সময় গেলে সে প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গার জন্য অস্থির হয়ে যায়।
৫) মানুষ যাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুলতে চায়,তাকে যে আরো বেশি মনে পড়ে।
ব্যক্তিগত রেটিং:৯/১০
Leave a comment