বালিশের গল্প : বিদিশা

আমি একটা কার্পাস তুলোর নরম বালিশ। যাদের বাড়িতে আমি থাকি, তারা অনেক বড় লোক। একটা নরম সাদা চাদর পাতা বিছানার উপর তারা আমায় রাখে। আমার গায়েও একটা ধবধবে সাদা কাভার। যত্নে রাখে ওরা আমায়। কিন্তু আমার ওদের খুব আহামরি ভাল্লাগেনা। খারাপও লাগেনা আবার। মানুষ যে ওরা। মানুষকে কি এক কথায় বিশেষায়িত করা যায়? যায়না। ভালো খারাপ মিলিয়েই যে ওরা মানুষ। 

মাঝে মাঝে ওরা আমায় ছাদে নিয়ে গিয়ে রোদ্দুরে দেয়। তখন আমার কি যে ভাল্লাগে! গা টা কেমন গরম হয়ে যায়! ওদের ছাদটা অনেএএক বড়। ছাদে নিয়ে গেলে মাঝে মাঝে সেখানে বাচ্চাদের খেলতে দেখি। মাঝে মাঝে বিল্ডিংয়ের মধ্য বয়স্ক মহিলারা গল্প করেন মাদুর পেতে। এনাদের সীমানা খুব সীমিত। খুব বেশী হলে বাচ্চাদের স্কুল পর্যন্ত। বাচ্চারা একটু বড় হলে তাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন রান্না ঘরের থেকে বেরিয়ে এসে এই ছাদটাই তাদেরকে একটু খানি মুক্তির স্বাদ দিতে পারে। যদিও এমন না ছাদে বসে সব সময় তারা খুব উচ্চ মার্গীয় আলোচনায় মত্ত থাকেন। সংসারের নুন-মরিচের আলোচনা শেষ হলে বেশীরভাগ সময়ই সেখানে পরনিন্দা ঢুকে পড়ে। কার মেয়ের চরিত্র কেমন, কার ছেলে গাঁজাখোর ইত্যাদি ইত্যাদি। সে যাক গে, মাঝে মাঝে আবার ছাদে উঠে আসতো অরুণা। অরুণার ঘরের বালিশটাই কিন্তু আমি। আমার কোলের ‘পরে মাথা রেখেই অরুণা ঘুমাতো সেই ছোট্ট বেলা থেকে। ছাদে উঠে ও রেলিং ধরে দূরে তাকিয়ে থাকতো মাঝে মাঝে। কি ভাবতো কে জানে!
 সেবার ও কলেজে উঠেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে। কিন্তু ভারি বুদ্ধিমতী। পড়াশোনায়ও ভালো। কি যে ভালো নাচ করতো! গানের তালে তালে ঘুঙুরের শব্দে ঘর মেতে উঠতো। আমারও বড্ড ভালো লাগতো ওর নাচ। তবে অরুণাটার কিসের যে দুঃখ কি জানি। মাঝে মাঝে আমায় খুব জোরে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকতো। আমার কাভারটা ওর চোখের নোনা জলে ভেসে যেতো। ঘন্টার পর ঘন্টা এমন করে পার করে দিতো। তারপর ভালো করে চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো। আমি একলা ঘরে পড়ে থাকতাম বিছানার উপর। ধীরে ধীরে সেই ফোঁটা ফোঁটা জল বাষ্প হয়ে উড়ে যেতো। কেউ আর তাকে দেখতে পেতোনা। 
আমার দুনিয়ার পুরোটাই বলতে গেলে অরুণাকে নিয়েই। সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমায় ছাড়া ও ঘুমাতে পারতোনা। আমার উপর বই রেখে, আমায় কোলের উপর রেখে পড়তো। উপুড় হয়ে আমার উপর শুয়ে পড়তো মাঝে মাঝে। মনে আছে, প্রথম যেদিন ও প্রেমে পড়েছিল, আমার উপর ফোনটাকে রেখে বহু সময় ধরে ফোনের ভিতরের সেই মানুষটার ছবির দিকে চেয়ে থাকতো। হয়তো তাকে অরুণার “ভালোবাসি” বলা হয়ে ওঠেনি। হলে আমি জানতাম। কিন্তু তবু ঐ ছবিটা দেখার সময় ওর ঠোঁটের কোণে যে মিষ্টি হাসিটা দেখতাম, তাকে ভোলার মতো না। মাঝে মাঝে কি নিয়ে দুশ্চিন্তায় মেয়েটা ঘুমাতে পারতনা। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিতো। বড়লোকের মেয়ে। তবু কিসের যেনো অভাব, কিসের যেনো অভাব। পাশের কোল বালিশটাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতো। আবার মাঝে মাঝে রাতের বেলা আমায় কোলে নিয়ে জানালার পাশে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকতো। কাঁদতো, ভাবতো। আবার আলো জ্বালিয়ে পড়তো। নাচের মধ্যে কী অদ্ভুত আবেগ ছিল ওর! তারানার সাথে সাথে যখন নাচতো, মনে হতো স্বয়ং রুদ্র যেনো সরস্বতীর বীণার তালে নেচে চলেছে। তবুও ঘুঙুরের সেই ঝিনিঝিনি আওয়াজের ভেতর কোথায় একটা চাপা কান্না বাজতো যেনো। কেউ শুনতে পেতোনা তা। অগোছালো একটা সময় কাটিয়েছে মেয়েটা। মাঝে মাঝে ভয় হতো আমার। না জানি কি করে ফেলে কখন! 
নাহ্, কিছু করেনি অরুণা। ইন্টার পাশ করে বিদেশে চলে যায়। আমার দিন কাটতোনা প্রথম প্রথম। ফাঁকা ফাঁকা লাগতো বড্ড। কেউ যে নেই আমায় সঙ্গ দিতে। তখন হঠাৎ বুঝে ফেলি। হ্যাঁ, ঠিক এই জিনিসটারই অভাব ছিলো অরুণার। ওর মন খারাপের সময় ওকে জড়িয়ে রাখার জন্য কেউ ছিলোনা। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য কেউ ছিলোনা। ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে কেউ ছিলোনা। বাইরের শত শত মানুষ হয়তো ওর প্রশংসা করতো কিন্তু ওর কাছের কেউ ওকে “সাবাশ” বলার জন্য ছিলোনা। এই বাড়ির কেউ কারো কাছে আসেনা। এলেও সেখানে দায়িত্বের বন্ধন যতোটা থাকে, ভালোবাসার ছোঁয়া থাকেনা ততোটা। এ বাড়ির সবাই যে বড় একা! আমি যদি মানুষ হতাম, তবে এদের সবাইকে একবার করে জড়িয়ে ধরে বলতাম, “দেখো, আমি তোমার পাশে আছি।” কিন্তু আমি মানুষ হতে চাইনা। কখখনো না।
আমায় এখন অরুণার ছোটো ভাইটার ঘরে রাখা হয়। প্রায় অরুণারই বয়সী। ডাগর চোখ দুটো জন-মানুষের আড়ালে আসতেই, সেখানে শ্রাবণের বান নেমে আসে যেনো। আবার আমায় জাপটে ধরে হু হু করে কান্না। আবার আমার সাদা কাভারটা ভিজে যাওয়া। আবার সেই চোখ মুছে “স্বাভাবিক” হয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া। এ কি কোনো চক্র? দুনিয়ার সব বালিশ গুলোর গল্পই কি এক? 
➤ বালিশের গল্প
➤ বিদিশা 
ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার 
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?