বাবু জেগে উঠেছে। সাড়ে চার বছর পর কোমা থেকে তাকে জাগিয়ে তুলা হয়েছে। কারণ একটাই। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপদ ধেয়ে আসছে। “দ্য এজেন্সি” এর বাজিকর এখন সে-ই। বাজিকর ট্রিলজির প্রথম পর্বে তাকে জাগানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়। বাবু ছাড়া ইউক্রেন মিশনে শেষ হয়ে যায় বোমার থেকেও ভয়ানক মানুষ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানটির সেরা এজেন্টরা।
“দ্য অক্টোপাস” তাঁর অগণিত শুঁড় পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঐ নারকীয় গুপ্তসঙ্ঘের প্রধান যেন নিটসের উবারম্যান। বিবেক তাঁর কাছে ফালতু বিষয়। বিশ্বের সকল রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে একক নতুন বিন্যাসের পথে হাঁটছেন তিনি। বাজিকর কাহিনীতে এই জিনিয়াসের ছকে রাশিয়া বনাম আমেরিকা যুদ্ধ প্রায় বেঁধেই গিয়েছিল। এবার এই খ্যাতিমান তরুন উদ্দ্যোক্তার গলায় কাঁটা লেগেছে।
এই গলার কাঁটারা হলেন কার্ল এবং সাব্বির। এই দু’জন ইন্টারনেটে সুকৌশলে অক্টোপাসের সকল তথ্য ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা এমন গলার কাঁটা যে বাজিকর উপন্যাসে তাদের বিপরীতে বন্দিবিনিময় হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রির কন্যাকে পর্যন্ত হোস্টেজ বানিয়ে রাখা হয়েছিল। কার্ল এবং সাব্বিরকে অক্টোপাসের প্রধানের জ্যান্ত দরকার।
গলার কাঁটা নামানোর জন্য একের পর এক বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ এসপিওনাজ এজেন্ট বা বাজিকরদের পাঠানো শুরু হয় বাংলাদেশে। চীনের এমএসএস, ভারতের “র”, পাকিস্তানের আইএসআই, ইজ্রাইলের মোসাদ সহ সকল শক্তিশালি সিক্রেট সার্ভিসের বাজিকরদের লাইন লেগে যায় বাংলাদেশ অভিমুখে।
এই সকল বাজিকরদের সামনে একটি-ই মিশন। কার্ল এবং সাব্বিরকে জীবিত পাকড়াও করা। তাদের সামনে একটিই দেয়াল। বড় শক্ত দেয়াল এটি। বাজিকর বাবু। কোমা থেকে জাগানো বাবুকে নির্দেশনা দিচ্ছেন দু’শর বেশি আইকিউ সম্পন্ন মাস্টার সিফাত। তবে ঘাড়ত্যাড়া বাবুর সাথে নতুন এই স্ট্রাটেজিস্টের বোঝাপড়া খুব করুণ। তাছাড়া একের পর এক বাজিকরেরা কিভাবে বাবুকে খুঁজে পাচ্ছেন? মাস্টার সিফাতের নির্দেশনায় ইউক্রেন অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। শারীরিকভাবে পঙ্গু এই মাস্টারমাইন্ডের লক্ষ্য কি?
সিআইএর সেরা এজেন্ট ট্রাভিস আরভাইন গত অভিযানের পর গা ঢাকা দিয়েছেন কেন? বাংলাদেশের মিশনে যেতে কেন তাঁর অনীহা? লুনাটিক এই এজেন্ট, যে কিনা এককালে সেরা দেশপ্রেমিক ছিল, এখন কেন একদম তাঁর মার্কিন মুলুকের বিরোধীতা করছেন? “দ্য এজেন্সি” এর মত সিআইএর মধ্যেও কি ঘাপটি মেরে আছেন অক্টোপাসের অসংখ্যা শুঁড়?
রাশিয়ার এক অদ্ভুত শহর। যেখানে বিলি সিম্পসন, একজন ছদ্মবেশি সিআইএ এজেন্ট কাজ করছেন। কিন্তু এই শহরের সকল বাড়ি-ঘর একরকম। ভুবনমোহিনী রূপ, ভালোবাসা এবং গুনের অধিকারি স্ত্রীসহ আন্ডারকাভার বিলির মনে বাস করতে শুরু করেছে এক সন্দেহ। যে সন্দেহ তাঁর অস্তিত্বের উপর পর্যন্ত হাত দিয়ে দেয়। হচ্ছেটা কি রাশিয়ার স্ট্রেঞ্জ এই শহরে?
বাজিকর বাবু। একের পর এক মুখোমুখি হয়ে পড়ছেন বিভিন্ন দেশের বাজিকরদের সাথে। কোমা থেকে যতবার উঠে আসেন বাবু ঠিক ততবার মায়ের মৃত্যু এবং অন্যান্য দুঃখজনক স্মৃতি মনে পড়ে যায় তাঁর। এবারের বার আরো ট্র্যাজিক পরিস্থিতি চলে আসলো তাঁর সামনে। কৃত্রিমভাবে কোমায় রাখার কারণে শারীরিক কিছু অসুবিধা এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় ভুগতে হয় তাকে। ক্যান্সারের ঝুঁকির পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আবার কোমায় ফিরে যেতে হবে তাকে।
প্রায় সব হারানো বাবুর এখন আর হারানোর কিছু নেই। অত্যন্ত শক্তিশালি এই চরিত্র সকল দূর্দশাকে বুকে জড়িয়ে “দ্য এজেন্সি” ধরা মূল বাজিতে পরিণত হন। এমনকি তাকে মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হয় তাঁরই গুরু ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের কিংবদন্তি এমআইসিক্সের সাথে। ভয়ানক সুদর্শন এবং স্টাইলিশ এই ব্রিটিশ লিজেন্ড কি জানেন যে অন্যান্য বাজিকরদের মত তিনিও অক্টোপাসের টেন্টাকলে বন্দী একজন?
শারীরিক এবং মানসিক প্রচন্ড চাপের মুখে বাবুকে যেন কোন অসম্ভব অভিযানকে সম্ভবে পরিণত করতে হবে। ইউক্রেন মিশনে কি সবাই মারা পড়েছিলো। নাকি কেউ ফিরে আসবে? বাবুর প্রচন্ড শক্তি, একরোখামি এবং স্কিলের দেখা পাওয়া যায় এই অভিযানে। যার হারানোর কিছু নেই সে-ই হয়তো হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে ভয়ানক। এদিকে প্রধানমন্ত্রির উপর অবধারিতভাবে হিট আসছে। অক্টোপাসের কাছে দেশের এই নির্বাহী প্রধান মাথা নত করবার ব্যক্তি নন। বাবু যেন ছুটে চলেছেন সময় এবং স্রোতের ঠিক বিপরীতে। এমন সময় এবং স্রোত যেখানে কে কোনদিক বেছে নিয়েছেন বলা খুব কঠিন। পার্কুর মত আখ্যান এগুতে থাকে এদিক থেকে ওদিকে।
নাবিল মুহতাসিমের “বাজি” এসপিওনাজ নভেলের চেয়ে থ্রিলার আখ্যান বেশি মনে হয়েছে আমার কাছে। গল্পকথনে নিজস্ব আকার-ইঙ্গিত এবং ভঙ্গিমায় তিনি দুর্দান্ত এক আখ্যান রচনা করেছেন। রহস্যরোমাঞ্চ এবং একশনে ভর্তি এই উপন্যাস অত্যন্ত ফাস্ট রিড। যে পরিমাণ ইন্টেনসিটি গল্পের শেষ পর্যায় পর্যন্ত লেখক ধরে রেখেছেন তা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে একশন দৃশ্যগুলোর চিত্রায়ণ এক কথায় অসাধারণ। এছাড়া বাবুসহ বিভিন্ন বাজিকরের সুদক্ষতার পাশাপাশি একধরণের মানসিক বিপন্নতাও ফুটিয়ে তুলেছেন নাবিল। যা হয়তো পাঠককে খানিকটা বিষন্ন করে তুলতে পারে, অথবা বিপন্ন। নাবিল মুহতাসিমের “বাজি” আমি বহুদিন মনে রাখবো, হয়তো প্রায় সারাজীবন।
অনেকের মতে জীবন যেন এক জুয়া খেলা। এই খেলায় বাজি ধরতে হয়। অনেকসময় বাজি ধরতে হয় নিজের উপর। নিজ পরাণের গহীন ভিতরের সুপ্ত ব্যক্তিসত্ত্বার তীব্র জাগরণের মাধ্যমে কেউ কেউ হয়তো পরিণত হন বাজিকরে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
বাজি
লেখক : নাবিল মুহতাসিম
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : ডিলান
জনরা : থ্রিলার, এসপিওনাজ নভেল
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
Leave a comment