- বই : বাজিকর
- লেখক : নাবিল মুহতাসিম
- প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৭
- দ্বিতীয় সংস্করণ : মার্চ ২০১৮
- প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
- প্রচ্ছদ : নিউটন
- জঁরা : এসপিওনাজ নভেল, রহস্যরোমাঞ্চ, একশন-অ্যাডভেঞ্চার।
- রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
প্রথমত কাহিনির শুরুতে একটা ধাক্কা! একি! সেটা না-হয় বাদ দিলাম। এর পরপর-ই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, আমি কি কোনো ফ্যান্টাসি দুনিয়ায় বাজিকর ইউনিভার্সে ঢুকে পড়েছি? এ-ভাবে হুড়মুড় করে বাজিকরদের আগমনে কোথায় একটু সুস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধাতস্থ হব কিন্তু সেটা লেখক থাকতে দিলে তো! ভেবেছি ৩২০ পৃষ্ঠার বই হয়তো স্লো-বার্ন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে কোথাও; কিন্তু আমার এই ধারণাকে স্রেফ তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো। কীভাবে? এমনিতে শুরু থেকে শেষ—উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গে। নাটকীয় আর কাকতালের মিশেল তো আছেই। এ-সব না থাকলে কি এসপিওনাজ থ্রিলার জমে? ভাগ্য থাকবে, তারা সহায় হবে। বাজিকর-বাজিকার-বাজিগার মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে লড়াই করবে; তবেই না মজা। তবে একপাক্ষিকতা প্রায়শ ভ্রুকুঞ্চন করতে দিলেও—গল্পের পটভূমির কথা মাথায় রেখে সে-দিকটা কম্প্রোমাইজ না-হয় করলাম। আফটার অল—কতটা মজা পেয়েছি সেইটে হচ্ছে আসল কথা।
ট্রিলজির প্রথম বইতে দ্য অক্টোপাসের ষট্-চক্রে আমেরিকা-রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের দোনেৎস্ক শহরে লড়াই হলেও; দ্বিতীয় বইতে হয়েছে বাজিকর টু বাজিকর লড়াই। তা-ও দেশিয় পটভূমিতে। অর্থাৎ বাংলাদেশে। সেয়ানে সেয়ানে বলব না; কারণ এখানেও অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটেছে। স্বাভাবিক ব্রেইন দিয়ে চিন্তা করলে; ভজকট পাকবে। তাই লেখক যে-ভাবে গল্পটি পরিচালনা করেছেন—আমিও সেই অনুযায়ী বাজিকর বাবু-আহাদ আর মাস্টার সিফাতের মতো চুপচাপ মেনে নিয়েছি। নিতে হয়েছে, উপায় নেই। তবে পুরো বইটি দারুণ উপভোগ্য। এই উপভোগের মাত্রা বাড়িয়েছে লেখকের জাদুকরী লেখনশৈলী আর ফাইটিং সিকোয়েন্সের অসাধারণ সব বর্ণনা ভঙ্গি। পুরাই অ্যাকশন প্যাক থ্রিলার।
✱ আখ্যানপত্র—
|
◆ গুডরিডস অথবা কমেন্ট বক্সের প্রথম কমেন্ট চেক করুন।
|
✱ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা —
❛বাজি❜ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া না থাকলেও, প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে—প্রথম বই থেকে কতটা এগিয়ে অথবা পিছিয়ে ট্রিলজির দ্বিতীয় বই? ওয়েল, কিছু আলোচনার পর সেই দিকটি আমি উন্মোচন করছি।
দ্বিতীয় বই হিসেবে প্রথম বইয়ে স্কিপ করা অনেক ছোটো ছোটো ঘটনার খোলাসা এই বইয়ে উপযুক্ত ধারণা দিয়ে বাঁধা হয়েছে। প্রথম বইয়ের মতোই এই বইয়েও ব্যাকস্টোরি আর ফ্ল্যাশব্যাকের কোনো কমতি লেখক রাখেননি। সত্য বলতে, যখনই এই ব্যাকস্টোরি আর ফ্ল্যাশব্যাকের উপস্থিতি হতো—মুগ্ধ হয়ে পড়ে যেতাম।
প্রথম বই থেকেও ‘দ্য অক্টোপাস’-এর কার্যক্রম খুবই ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে দেখানো হলেও একই সাথে রাশিয়াকে হাইডে রেখে আমেরিকা ওপর ফোকাস রাখা হয়েছে বেশি। এ-কারণে হয়তো পৃথিবীর রহস্যময় এক গোপন জায়গা—এড়িয়া ফিফটি ওয়ান নিয়েও একটা তত্ত্ব লেখক দাঁড়া করাতে সক্ষম হয়েছেন। তা-ও মোটামুটি আকৃষ্ট করার মতোই। কাহিনির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ-ছাড়া সিঙ্গেল টাইমলাইনে গল্প চললেও, দেশ অথবা চরিত্র অনুযায়ী পর্ব পরিবর্তন হওয়ায় একই জায়গায় দৃশ্যপট স্থির থাকেনি। সিকোয়েন্স সাজানোর কোনো কমতি অন্তত আমি লক্ষ করেনি। খুবই সাবলীলভাবে গল্প চলেছে নিজ গতিতে, যথাস্থানে মোড় নিয়ে লক্ষ্যের দিকে লাগামছাড়া হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে।
দেশের দিকে তাকালে নরক গুলজার ইতোমধ্যে শুরু হওয়ার পর্যায়ে। অক্টোপাসের মূল হোতার এক তুড়িতে বিভিন্ন দেশের সেরা সব অ্যাজেন্ট পিলপিল করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে; উদ্দেশ্য একটাই—কার্ল এবং সাব্বিরকে যে-কোনো উপায়ে থামানো। অক্টোপাসের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত থাকেনি দ্য এজেন্সিও! কিন্তু সেটা কীভাবে?
ভার্চুয়া অর্থাৎ ফেসবুকের ‘বাজিকর’ ভার্সন নিয়ে ভালোই আলাপ-আলোচনা রয়েছে। আছে ইমোশনাল অনেক সিন। চরিত্রায়নও হয়েছে পোক্ত। সব মিলিয়ে উপভোগ্য।
● সূত্রপাত —
প্রথম বইয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার ছয় মাস পরের কাহিনি। জাগানো হলো দ্য এজেন্সির সাড়ে চার বছর কোমায় থাকা বাজিকর বাবুকে। থামাতে হবে অক্টোপাসের ইশারায় দেশে ঢুকতে থাকা বিভিন্ন দেশের সব বাজিকরকে! কারণ একটাই; যে-কোনো উপায়ে বাঁচাতে হবে কার্ল সেভার্স ও কম্পিউটার মাস্টার সাব্বিরকে। দেশের স্বার্থে-বিশ্বের সুরক্ষাতে।
ওইদিকে খুন হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট! করল কে এ-কাজ! রহস্যের সমাধান খুঁজতে প্রয়োজন ট্রাভিস আরভাইন কে! কিন্তু কোথায় সে?
আহাদ কোথায়? ইউক্রেনের মিশনের পর তার কোনো হদিস নেই কেন? কী হয়েছে ওর? বেঁচে আছে তো?
প্রশ্ন অনেক—উত্তর খুঁজে পেতে চাইলে ট্রিলজির প্রথম বই পড়তে হবে আগে। এর পরে দ্বিতীয় বই ❛বাজি❜। টানটান উত্তেজনা পূর্ণ একটি রোমহষর্ক থ্রিলার।
● গল্প বুনট » লিখনপদ্ধতি » বর্ণনা শৈলী —
বারবার যদি বইটি আমাকে পড়তে বলা হয়; নির্দ্বিধায় সেই আদেশ মেনে নিতে আমি বাধ্য। কারণ বইটি লেখা হয়েছে—বারবার পড়ার মতো করে। হয়তো পুরো ট্রিলজিটি লেখক সেই ভেবে লিখেছেন। যাকে বলে, মনের মাধুরী মিশিয়ে। প্রথম বই কম ভালো, দ্বিতীয় বই বেশি ভালো—এই টাইপ কোনো কথা আমি বলতে রাজি নই। দুটো বই-ই নিজ জায়গা থেকে স্বতন্ত্র।
লেখকের গল্প বুননের দক্ষতার কথা নতুন করে বলার নেই। বাছাই করা শব্দ আর তা দিয়ে বাক্য গড়নের মুনশিয়ানা পরপর বইগুলোয় খুব কমই দেখা যায়। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ধীর লয়ে সাজিয়েছেন গল্পের প্রতিটি স্তর। আমাকে টানতে হয়নি; গল্প আমাকে আপন গতিতে টেনে নিয়েছে শেষ পর্যন্ত।
নিখুঁত শব্দ চয়ন। গালিগালাজ আর আঞ্চলিকতা সংলাপ থাকলেও প্রত্যকটি চরিত্রের আলাদা স্বকীয়তা ঠিকই বজায় থেকেছে। পারিপার্শ্বিক বর্ণনা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলতে চাই না। চরিত্রদের মনোভাব এই উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। নিদারুণ সব বর্ণনা। একেবারে জলজ্যান্ত।
আর ফাইটিং সিকোয়েন্স? এই বইয়ের রাশিয়ান, চাইনিজ, পাকিস্তানি, ব্রিটেন, ইজরায়েলের ফাইটিং স্কিলগুলো অনুসরণ করে সেগুলো উপন্যাসে ব্যবহার করা হয়েছে। পড়লেই টের পাবেন। প্রত্যকটি দক্ষতার নামকরণ ও প্রয়োগ বলে দেওয়া আছে। বেশ উপভোগ্য আর সাবলীল বর্ণনা। মনে হবে, আপনি স্বয়ং সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে লড়ছেন। এটাই ম্যাজিক।
গল্প পোক্ত হয়েছে উপরিউক্ত কারণগুলোর জন্য। যত ভাবে বিল্ডাপ দেওয়ার সুযোগ এসেছে—লেখক হাতছাড়া করেননি একটিও। একেবারে মহাভারতে দুর্যোধনের বলা—বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদনী টাইপ। এ-রকম ‘এস্টার এগ’ অথবা উক্তি যথারীতি গল্পে আরও আছে।
● চরিত্রায়ন —
চরিত্রের শেষ নেই। তবে সাজানো হয়েছে সুন্দরভাবে। বিশেষ করে চরিত্রের উপস্থিতি; যাকে আমরা সিনেমায় ‘এন্ট্রি’ বলে সম্বোধন করি। একেবারে সিনেম্যাটিক স্টাইলে। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে। প্রত্যক চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড আলাদাভাবে নজর কাড়ে।
তবে এই উপন্যাসে বাজিকর বাবু এবং মাস্টার সিফাতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গল্পের নির্দিষ্ট একটি অংশ পর্যন্ত—সেই রেওয়াজ বজায় ছিল। শেষটা তো আরও চমকানো। ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট তো আছেই। বাদ রাখেনি কোনো কিছু।
● অবসান —
বড়োসড়ো এক টুইস্টের অপেক্ষায় আছেন? একেবারে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হবে। এমনিতে উপন্যাসের আগে-পিছে অনেক টুইস্ট আছে; কিন্তু শেষ টুইস্ট পালটে দিয়েছে পুরো গল্পের গতি। আপনার পছন্দের শব্দ-গালি-বাক্যটি তখনই মুখ দিয়ে হালকা বের হয়ে আসতে চাইবে; কেউ না শোনে মতো—চেপে রেখে সেটা বলতে হবে।
শুরু এবং শেষ দুটোই আনন্দদায়ক। পুরোটা সময়টা উপভোগ করেছি বইয়ের গল্প-চরিত্র এবং ঘটনাপ্রবাহের সাথে।
◆
◆⚊◆
◆ খুচরা আলাপ —
❛বাজি❜ উপন্যাস লেখকের সফল একটি উপন্যাস বটে। স্ট্যান্ড অ্যালোন হিসেবে বিবেচনা করলেও। গল্পের সূত্র ধরে দেশি-বিদেশি অনেক ঘটনার চিত্রপট এবং এ-সব প্রতিকার নিয়ে ভালোই আলোচনা রয়েছে বইতে। ভবিষ্যৎ নিয়ে ধরতে গেলে ছোটোখাটো ভবিষ্যদ্বাণী করে দিলেন। যা গল্প হলেও সত্য।
◆
◆⚊◆
◆ লেখক নিয়ে কিছু কথা —
টানা ভাইয়ের লেখা পড়ছি। বোরিং তো দূতে থাক; বলতে গেলে দিনকে দিন আকৃষ্ট হচ্ছি আরও। স্টোরিটেলিং-এ নাবিল ভাই—অনবদ্য। বাজিকরের রেশ তিনি ❛বাজি❜ উপন্যাসেও ধরে রেখেছেন। এখন বাজিমাত পড়ার অপেক্ষায়। ট্রিলজির শেষ পেরেক কীভাবে গেঁথেছে তা দেখার অপেক্ষায়। আশাবাদী; জানি তিনি হতাশ করবেন না।
● সম্পাদনা ও বানান—
সম্পাদনায় আরেকটু সতর্ক হওয়ার দরকার ছিল। না ধরা যায় মতো কয়েকটি অসংগতি থাকলেও থোড়াই কেয়ারের মতো। যাহোক, ওইভাবে মার্ক করিনি। তবে নাম বিভ্রাট আর টাইপো ভালোই প্যারা দিয়েছে। বানানেও অনেক ভুল আছে।
● প্রচ্ছদ—
ভালো লাগেনি। প্রথম বইয়ের তুলনায় ম্যাড়মেড়ে।
● মলাট » বাঁধাই » পৃষ্ঠা—
আউট প্রোডাকশন ভালোই। মলাট শক্তপোক্ত, কড়া বাঁধাই। পৃষ্ঠা গতানুগতিক। দাম অনুযায়ী ঠিকঠাক।
- বই : বাজি (বাজিকর ট্রিলজি #২) • নাবিল মুহতাসিম
- জনরা : এসপিওনাজ থ্রিলার
- প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
- প্রচ্ছদ : ডিলান
- প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
- মুদ্রিত মূল্য : ৩৪০ টাকা মাত্র
- পৃষ্ঠা : ৩২০
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?