বাঙালি মুসলমানের মন PDF : লেখক আহমদ ছফা | Bangali Muolmaner Mon

  • বই : বাঙালি মুসলমানের মন PDF
  • লেখক : আহমদ ছফা
  • ধরন : সমাজ ও সভ্যতা
  • প্রকাশক : হাওলাদার প্রকাশনী
  • পৃষ্ঠা : ১৫৬ টি
  • মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা

বাঙালি মুসলমানের মন’ সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত সমালোচিত একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। এতে নানা সময়ে ছফার লিখা বারোটি প্রবন্ধ থাকলেও নাম প্রবন্ধটি বাঙলা সাহিত্যের একটি অন্যতম বিতর্কিত রচনা।
এ প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের নিম্ন নৈতিকতা, নিম্নরুচি, লোভ, সংকীর্ণতা, নেতৃত্বগূনের অভাব ইত্যাদি ইতিহাসের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। 

তিনি মনে করেন উচ্চবর্ন হিন্দুদের অত্যাচারে নিম্নবর্নের হিন্দু ও গোড়া হিন্দুদের চাপে নির্যাতিত বৌদ্ধরা ইসলামগ্রহণ করেন। আব্বাসীয় খিলাফতের দ্বারা বাগদাদ, উমাইয়াদের দ্বারা স্পেনে ও ফাতেমিয়দের দ্বারা উত্তর আফ্রিকায় ইসলামী সভ্যতার আলো ও যে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা এসেছিল তা বাংলা এলাকায় আসতে পারে নি। বরংচ, ৬০০-৭০০ সালের প্রকৃত ইসলামের পরিবর্তে একটু পরিবর্তিত ইসলাম এখানে এসেছে পীর ফকিরদের দ্বারা। দীর্ঘ সময় ভারতবর্ষে ইসলামী শাসন থাকলেও বাংলার মুসলমানরা রাজকার্য অংশগ্রহণে ছিল ব্রাত্য। নিম্নবর্ণজাত হওয়ার কারণে শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে ছিল, রাজকার্যে তাদের চেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই প্রাধান্য পেত। 
যেসব মুসলমানদের কোন কারণে সরকারী কাজে অংশগ্রহণ করে উপরে উঠার সুযোগ ছিল তারা নিম্নবর্গের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। উচ্চবর্নের হিন্দুদের দূরবর্তী হওয়ায় ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরে আর্য সংস্কৃতির বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর ছোয়াও তারা পায় নি। উপরন্তু তাদের রুচি ও চাহিদার প্রেক্ষিতে মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণবসাহিত্যের সমান্তরাল পুথি সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে। এসব সাহিত্যে দেব দেবতার চরিত্রের মত বীরত্বব্যাঞ্জনা দিতে গিয়ে আমির হামজা, মোহাম্মদ হানিফা ইত্যাদি চরিত্র তৈরি করে তাদের অহেতুক সেক্সি ও যুদ্ধবীর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, ইতিহাসের সাথে যার কোন সংশ্রব নেই।
অধিকন্তু এসব মুসলমানদের মধ্যে তাদের ব্যাবহার্য ভাষা যথা আরবি, ফার্সি, উর্দু, বাংলা ইত্যাদি নিয়ে নানা দোদুল্যমানতা কাজ করেছে। বাঙ্গালি মুসলমানরা আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দুর্দশা হতে রক্ষাকবচ হিসেবে ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলামে এসে থিতু হলেও তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় নি। বাঙালি মুসলমানের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে ইংরেজদের একপেশে দোষারোপ ছফা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এর অনেক আগে থেকেই তারা পিছিয়ে এবং এ থেকে কখনো বের হতে পারে নি।
 
নানাপ্রেক্ষাপটের মধ্যে তীতুমিরের অনুসারীদের মধ্যে ওহাবী আন্দোলন ও দুদুমিয়ার ফারায়েজী আন্দোলনের বাইরে তারা তেমন শক্তিশালী গণজাগরণ ঘটাতে পারেনি। এসব আন্দোলনেও আশরাফ শ্রেণির মুসলমানদের খুব বেশি সংশ্রব ছিল না। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের যে সামাজিক নৈতিক দৈন্যদশা তা বাঙালি বা মুসলমান হওয়ার কারণে ঘটে নি, এটি সংঘটিত হয়েছে ইতিহাসের একটি প্রকৃয়ার মাধ্যমে।
 
যদিও ছফা কোন রেফারেন্স দেন নি, তবে রচনাটি পড়ে মনে হয়েছে, এ এলাকায় ইসলাম ধর্ম বিকাশের ব্যাখ্যার জন্য তিনি দীনেশ চন্দ্র সেনের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এর বাইরের অন্যান্য মতামত তার কাছে অজানা ছিল বা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। এ অঞ্চলে ধর্মীয় ও সামাজিক বিকাশ নিয়ে অসীম রায়, রিচার্ড ইটন, ডঃ মোহর আলী, ডঃ রহীম, ডঃ এনামুল হক কিংবা অধুনাকালের ডঃ আকবর আলী খানের প্রস্তাবিত মতামত ছফার জ্ঞানের বাইরে ছিল। ফলে তিনি একপেশে হতাশাবাদী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যা অনেককে আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে।
 
তবে এ রচনার সময়কাল ও প্রেক্ষাপটটি পড়লেই এ যুক্তিগুলোর ব্যাখ্যা করা যায়। এ রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে, ১৫ আগস্ট পরবর্তী নানা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। অনেক বড় বড় নেতা ও বুদ্ধিজীবিদের নৈতিক ডিগবাজি, সামান্য লাভের জন্য রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন তাকে আহত করেছিল। বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, মন্ত্রী পদ পাওয়ার লোভে বামপন্থী মুক্তবুদ্ধিবাদী হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আবুল ফজলের মত লোকের রাতারাতি সাংঘাতিক ধার্মিক বনে যাওয়া।
অর্থাৎ ৭১/৭২ সালে ছফা রচিত নানা প্রবন্ধগুলোতে তিনি ( এ বইতেই আছে) যে আশার বানী শুনিয়েছেন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন তা এ প্রবন্ধে এসে মিইয়ে গেছে। পরবর্তীকালেও বেশ কিছু রচনায় তিনি আবার ভিন্নসুর দিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেছেন।
পাঠক হিসেবে আমিও কিছুটা হতাশ হয়েছি তবে সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার করে ‘ বাঙালি মুসলমানের মন’ রচনাটিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও ইতিহাসের ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে।
“যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না, অথবা সেগুলােকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়। যে নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভাল-মন্দ নিরুপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ এবং শােনা কথায় যার সমস্ত কাজ-কারবার চলে, তাকে খােলা থেকে আগুনে, কিংবা আগুন থেকে খােলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়।”

“বাঙালি মুসলমানের মন” দিয়েই #আহমদ_ছফা’র সাথে পরিচয়। সেই বইটির পাতা বাঁধাইয়ের গোলযোগে উল্টাপাল্টা হওয়া সত্ত্বেও গোগ্রাসে গিলতে হয়েছে বলা যায়- এমনই উত্তেজক, সুখপাঠ্য আর ভাবনায় তোলপাড় লাগিয়ে দেয়া ছিলো এর বিষয়বস্তু। এরপর “যদ্যপি আমার গুরু” পড়ে বিস্ময়াভিভূত! অতঃপর “শতবর্ষের ফেরারি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ দিয়ে যে ঘোর লাগিয়ে দিলেন, তার সূতো ধরে ক্রমেই ছফাসমগ্র ‘অবশ্য পাঠ্য’ তালিকায় উঠে গেলো।

 
ছফা এদেশের ৯০ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশের পাঠরুচি, ভাবা প্র‍্যাক্টিস করা ও ভিন্নভাবে ভাবতে শেখা এবং মনোজগতের গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলেছেন তাঁর লেখনীর শক্তিমত্তায়।
সাহিত্যে ছফার বহুমুখী ও বিপুল কাজ থাকলেও খুবই স্বাদু গদ্যে লেখা “বাঙালি মুসলমানের মন” নামের প্রবন্ধটিই পাঠকের মনে তাঁর খ্যাতির আইকনিক কাজ হয়ে আছে। এদেশের সমাজ, সারস্বত ও রাষ্ট্রচিন্তা থেকে শুরু করে রাজনীতি আর ক্ষমতাকাঠামোর কতো গভীরে যে, “বাঙালি মুসলমানের মন” এর প্রভাব প্রোথিত হয়ে গেছে সেটা গত ২৫/৩০ বছরের রাজনীতিকে খুঁটিয়ে পাঠ করলে কিছুটা উপলব্ধিতে আসবে। 
এই প্রভাবের মাত্রাও নানামুখী। কিছুটা সরাসরি, কিছুটা এর বিপরীত, আবার দুই দিকেই কিছুকিছু সুইং, রিভার্স সুইং দেখা যাবে। কিন্তু, মোটামুটিভাবে- বাঙালি মুসলমান একটা সমস্যা, একে ঠিক করতে হবে- ছফা’র এমন প্রতিপাদ্যকেই মেনে নেয়া হয়েছে। ফলতঃ এই বিমারের সুচিকিৎসার নানান ফন্দিফিকির, থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিস আর ট্রায়াল এন্ড এরর পদ্ধতিতে এসবের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও “বাঙালি মুসলমানের মন” এর আমার মতো মুগ্ধভক্তেরও এখন একে বোকাবোকা আর খুবই অগভীর কথামালার স্তূপের মতো লাগে! এই দীর্ঘ প্রবন্ধটাকে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক Subho Basu ‘intuitive” নিবন্ধ বলে যে তকমা দিয়েছেন একটি অনলাইন বক্তৃতায়, তার সাথে আমিও শতভাগ একমত হয়েই যোগ করতে চাই যে, এটা ছফা’র বড্ড নড়বড়ে পাটাতনে দাঁড়িয়ে ভুলচুক তথ্য-উপাত্ত-তত্ত্বের জগাখিচুড়িময় খুবই “কাণ্ডজ্ঞানহীন intuitive নিবন্ধ”।
 
বাঙালি মুসলমানকে তিনি ১৯ শতকের কথিত “বেঙ্গল রেনেসাঁ”র ঠুলি পরে দেখেছেন। না হলে, যে বাঙালি মুসলমান মাত্র এক প্রজন্মকাল (২৪ বছর) এর মধ্যেই দু’দুবার নিজেদের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে পরপর দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছে- এই বুঝ ছফা’র বোধে আসতে পারলো না কেনো? অপিচ, ১ম রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার অচিরকালের মধ্যেই যখন বুঝতে পারলো যে, এই নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি তাদের জন্য “যথেষ্ট রাষ্ট্র” নয়, তারা সেটি ভেঙে দিয়ে নূতন আরেকটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে কালবিলম্ব করেনি বাঙালি মুসলমান। সবচে’ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- এই ২য় রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়াটা স্বচক্ষেই অবলোকন করার ভাগ্য পেয়েছিলেন ছফা। তদুপরি, এই নির্মাণদফায় কোনো না কোনোভাবে নিজেও জড়িত ছিলেন। তবুও, বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান, পরিপক্বতা ও শক্তিমত্তা বুঝতে না পারার এহেন ব্যর্থতা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতাকে নিদারুণভাবেই খাটো করে। ছফা’র ঈদৃশ বালখিল্যতা নিয়ে অচিরেই হাসাহাসি শুরু হতে বাধ্য।
 
কিন্তু, একটি অসামান্য গদ্যশৈলী ও অদম্য সাহস নিয়ে সৃষ্টিশীল গদ্যে রসের যে ভিয়েন তিনি বসিয়ে গেছেন, তার বদনাম করে, কোন সে বকলম?
২০০১ সালের এই দিনে তাঁর প্রয়াণ ছফামুগ্ধ আমাকে বিহ্বল আর বেদনার্ত করে তুলেছিলো। আজ আরেকটি প্রয়াণ দিবসে এসে ছফা আর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে না পারলেও সৃজনশীল গদ্য দিয়ে ঠিকই মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন।
সেলাম, সৃষ্টিশীল ছফা। – Millat Hossain
“বাঙালি মুসলমানের মন PDF যে এখনও আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তাঁর মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তাঁর বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে।”

বাঙালি মুসলমানের মন PDF

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?