বাইশ বছর পরে : মুর্তজা সাদ | Baish Bosor Pore By Murtoja Shad

বই: বাইশ বছর পরে (দ্বিতীয় মুদ্রণ)
লেখক: মুর্তজা সাদ
প্রচ্ছদ: মুর্তজা সাদ ও তাহমিদ রহমান
বাঁধাই: প্রিমিয়াম-পেপারব্যাক (স্ট্যান্ডার্ড সাইজ)
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৭৬
মুদ্রিত মূল্য: ১৬৫/-
আজ থেকে বাইশ বছর পরে
যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, 
কী সম্বোধন হবে আমাদের? 
– প্রসেনজিৎ রায়
বাইশ বছর পরে ব‌ইটি নব্ব‌ই এর দশকের স্মৃতিবিজড়িত একটি উপন্যাস। এখানে মঞ্জুকে দিয়ে গল্প শুরু হয়। গল্পে মঞ্জু যখন প্রিয়ন্তিকে দেখে তখন সে ছিল নীল শাড়িতে। তাই এখানে প্রচ্ছদে সেই মিল রেখে শাড়ির রঙ নীল। স্মৃতির পাতায় হারানোর সময়ের মতো বাইশ বছর পরে ব‌ইয়ের চারপাশের ফ্রেম। তাই বলা যায়, পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার মতো চমৎকার একটি প্রচ্ছদ।
আর চমৎকার প্রচ্ছদটি করেছেন মুর্তজা সাদ এবং তাহমিদ রহমান।

রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,

                     ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
                         লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
           আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
         দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মঞ্জুর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অব্যক্ত প্রেম সিনিয়র আপা প্রিয়ন্তি। পরিবহন ধর্মঘটের ফ্যাসাদে পরে বাস কাউন্টারে আটকা পড়েছে মঞ্জু। হঠাৎ চোখ পড়ল এক মহিলার দিকে। আর তাতেই হিম হয়ে গেল মঞ্জুর শরীর। কারণ সে আর কেউ নয়, ক্যাম্পাস জীবনের ভালোবাসা প্রিয়ন্তি। দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেলো। ঠিক বাইশটা বছর পর পরিবহন ধর্মঘটের সুবাদে দেখা ওদের। প্রায় দুই যুগ পর দেখা হওয়ায় মঞ্জু বারবার ফিরে গেলো ফেলে আসা সেই অতীতে, যা এত বছরে তার মনে পড়েনি। মূহুর্তেই যেন ফ্ল্যাশব্যাক আসতে শুরু করলো বাইশ বছর আগের ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম দিন।
গণরুমে ওঠা, আনিস নামের প্রথম বন্ধু, সিনিয়রদের অত্যাচার, সেমিস্টার পেরিয়ে দুই বন্ধু থেকে চার বন্ধুর দলে পরিণত হওয়া সব যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে মঞ্জুর। মঞ্জু-আনিস-বাবলু-রুবি হয়ে গেলো একটা গ্রুপ। পরম বন্ধু। সেই নব্বইয়ের দশকে ছেলেমেয়ের অবাধে চলাফেরা ছিল একরকম চোখ বড়ো করে দেখার মতো বিষয়। সেই সময়ে এক অসাধারণ বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এরা। বাবলু গান ভালো গায়, আনিস টিউশনি করে আর মিতু নামক ক্লাস সেভেনে পড়া ছাত্রীর সাথে প্রেম করে, মঞ্জু লেখাপড়া নিয়ে থাকে। এই তাদের জীবন। এক বৃষ্টির দিনে মঞ্জুর হৃদয় ভাসিয়ে দেয় নীল শাড়ি পরা বৃষ্টিভেজা এক তরুণী। নাম প্রিয়ন্তি। ক্যাম্পাসের দুই বছর সিনিয়র। লুকিয়ে চুকিয়ে প্রিয়ন্তিকে দেখতে থাকে মঞ্জু আর এগিয়ে যেতে থাকে সময়। একদিন কথাও হয় তার সাথে।
গাঢ় হতে থাকে চার বন্ধুর সম্পর্ক। আর মনে মনে মঞ্জু ধারণ করে বেড়ায় প্রিয়ন্তিকে। প্রিয়ন্তিও কি তাই?
রুবির বিয়ে হয়ে যায়। কোথাও ঢিলে হয়ে যায় তাদের সাথে বাঁধন। শুধু ঠিক থাকে ক্লাসের শক্ত শিডিউল, পরীক্ষা আর ল্যাবগুলো। মাঝে দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে আনিসের অসুস্থতা। মঞ্জু-বাবলু প্রাণপণ চেষ্টা করে আনিসের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত?
সময় চলে সময়ের গতিতে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মঞ্জু ফিরে আসে বর্তমানের ধর্মঘটে। অপেক্ষা করে আর ভাবে এইতো ধর্মঘট শেষেই বাস ছেড়ে দিবে আর যে যার গন্তব্যে। আবারো হারিয়ে যাবে প্রিয়ন্তি। আর হয়তো দেখা হবে না। কিন্তু বিধাতা কী চায়?
সময়ের স্রোতে মঞ্জু-আনিস-বাবলু-রুবি-প্রিয়ন্তি-মিতুদের কী ঘটেছিল? বর্তমানে সবাই কি সুখী নিজস্ব ভুবনে? অসম বয়সী ভালোবাসা কি কখনোই পরিণতি পায় না?

পাঠ প্রতিক্রিয়া:
গল্পটা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মঞ্জুর, গল্পটা আনিসের, বাবলুর, শেষ বর্ষে থাকা প্রিয়ন্তির, রুবির আবার মিতুরও। উপন্যাসের শুরুতেই ধর্মঘটের কারণে বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় আটকে যাওয়া মঞ্জুকে দেখা যায়। যার সাথে বাইশ বছর পর দেখা হয় ক্যাম্পাসের সিনিয়র প্রিয়ন্তির সাথে। এরই মাঝে বাইশ বছর আগের খন্ড খন্ড ঘটনা আর বর্তমানের দোলাচলে এগোতে থাকে।
সমকালীন বই পড়তে পছন্দ করি কিন্তু প্রেমের বই আমি খুব বেশি ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাই। কারণ হিসেবে এখনের প্রেমের মধ্যে ❝বাবু খাইসো, রগরগে বর্ণনা, লুতুপুতু জাতীয় কথাবার্তা❞ এর আধিক্য প্রধান। এই বইটা শুরু করার আগে ভাবছিলাম রোমান্টিক জনরা যেহেতু এইসবের ছিটেফোঁটা হলেও থাকবে। বইটা উপহার দিয়েছিল একজন বড়লোক বইক্রেতা। তার ব্যক্তিগত বিশেষ পছন্দের বই এটি তাই। উপহার দিয়ে কয়েকদিন পরপরই টোকা মারতো বইটা পড়বেন কবে? আমি যথারীতি উত্তর দিতাম, ❝বাইশ বছর পরে❞। বাইশ বছর পার না হলেও ২০২২ সালেই পড়ে নিলাম।
যা বলছিলাম, রোমান্টিক হলেও বইতে লুতুপুতু জাতীয় বর্ণনা একেবারেই ছিল না। মানব-মানবীর প্রেমের পবিত্র অংশেই লেখক বেশি ফোকাস করেছেন। আমার সবথেকে ভালো লেগেছে যে ব্যাপারটা সেটা হলো অতীতের ক্যাম্পাস জীবনের বর্ণনা। আমাকে বারবার আমার ফেলে আসা ক্যাম্পাস জীবনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। একবিংশ শতাব্দির মতো ছেলে-মেয়ে অবাধে চলাফেরা ছিল না নব্বইয়ের দশকে। বিশবিদ্যালয় পর্যন্ত একজন মেয়ের পড়াই ছিল বিশাল একটা ব্যাপার। সেখানে রুবির সাথে মঞ্জু-আনিস-বাবলুর বন্ধুত্বটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। বর্তমান যুগের ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট জাতীয় সম্পর্ক না। দারুণ বোঝাপোড়ার একটা সম্পর্ক, লোকদেখানো নয়। সে সময় থেকেই ক্যাম্পাসে সিনিয়রদের র‍্যাগ দেয়ার ব্যাপার, রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে সুবিধা নেয়া, মারামারির কারণে ক্লাস বন্ধ সবকিছুই সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। 
দুঃখের বর্ণনাগুলো পড়তে আসলেই খুব খারাপ লেগেছে। বিশেষ করে আনিসের পরিণতি। প্রিয়ন্তি-মঞ্জুর না বলা ভালোবাসা, বিয়ের পর রুবির ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আসা সবকিছুই একদম চিরাচরিত ঘটনা। আমাদের আশেপাশেই ঘটে যাচ্ছে এরকম কত কিছু। শেষের দিকের বিস্বাদ লাগা একটা অবস্থা আর ধর্মঘট শেষ হয়ে বাইশ বছর পরের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই মোলাকাতের ইতি টেনে লেখকও বইয়ের সমাপ্তি করেছেন আর পাঠকদের রেখেছেন আপনি ভেবে নিন শেষটা কী চান।
বইতে কিছু সুন্দর উক্তি দিয়েছেন লেখক সেগুলো পড়তে খুব ভালো লেগেছে।
গল্প প্লট, বর্ণনাভঙ্গি সবকিছু ভালো থাকার পরেও কিছু অসংগতি আমার কাছে লেগেছে। সেগুলো তুলে ধরছি,
প্রিয়ন্তি-মঞ্জু চটপটি খেতে গেছে তখন চটপটি খাবার বর্ণনা লেখক দিয়েছেন এভাবে, ❝প্রিয়ন্তি চামচ দিয়ে চটপটি খাওয়া শুরু করলো❞, বইতে যে কয়বার এই চটপটি খাবার কথা এসেছে প্রতিবারেই চামচ দিয়ে খাওয়ার কথাটা বলা হয়েছে। আমার জানামতে চটপটি আমরা চামচ দিয়েই খাই, ছুরি দিয়ে না! প্রতিবার এই একই কথা পড়তে আমার ভালো লাগেনি।
রিকশা থেকে নেমে আরেকজনের যাওয়া দেখতে থাকা যতক্ষণ সে মিলিয়ে না যায় এই একই কথাও বার কয়েক উল্লেখ ছিল। আর স্বাভাবিকভাবেই পড়তে আরাম লাগেনি। 
বর্তমানে বাবলুকে একেবারেই না আনায় বা তার কথা বর্তমানে উল্লেখ না করায় আমার কাছে পুরো বইটা পূর্ণতা পায়নি। স্মৃতিরোমন্থন যেহেতু করা হয়েছে সেটা ষোলো আনা আনলেই বেশি ভালো লাগতো।
প্রেমের লুতুপুতু না থাকলেও আবেগ ছিল শতভাগ আর আবেগী কম হওয়ায় বেশিরভাগ আবেগী লাইন পড়তে আমার স্বাচ্ছন্দ কম লেগেছে। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত হিসেবেই বলছি লেখকের লেখার কমতি হিসেবে বলিনি।
সব মিলিয়ে একবার পড়েই ফেলা যায় বইটি।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?