মানুষের গভীরের অনুরণন শুনতে প্রয়োজন তার ইতিহাসের ইতিবৃত্ত জানা, নৃতত্বের নতুনত্ব খুঁজে বের করা আর সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় কিভাবে তার আর্থ- সামাজিক-নৈতিক-ধার্মিক কলকব্জা গড়ে উঠেছে সেগুলোর বর্ণনা দূরবীন দিয়ে নয়- অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আবিষ্কারের চেষ্ঠায় ব্রত হওয়া।
প্রাগৈতিহাসিক এ বদ্বীপের নদী-নালা পূর্ণ স্যাতেস্যাতে উর্বর মাটিতে সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ছাপিয়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাধিক্যের বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে ১৮৭২ সালে প্রথম আদমশুমারিতে।
সারা ভারতীয় উপমহাদেশে ভৌগোলিক পরিবেশ ও জলবায়ু কাছাকাছি হওয়া সত্বেও বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকগণ নানামত দিয়েছেন এবং প্রত্যেকটি মত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে খারিজ করে দেয়া যায়। তবে মোটামুটি সবাই একমত হয়েছেন এদের সিংহভাগই নিম্নবর্গের হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন। এর কারিগর হলো এদেশে ১৩শ থেকে ১৭শ শতাব্দীতে আসা পীর- দরবেশ-সুফীরা।
সংখ্যাগরিষ্ঠত নিয়ে বেশ কয়েকটি মত পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলায় মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা পাওয়া, ব্রাক্ষণদের অত্যাচারে নিম্নবর্গের বিদ্রোহ করে ধর্মান্তর, হিন্দুদের নির্যাতনে বৌদ্ধদের ধর্মান্তর। আবার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রনিধানযোগ্য হিসেবে উঠে এসেছে, বাংলার মানুষের আধ্যাত্বিক প্রয়োজনীয়তার চেয়ে সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্য পীরদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। অন্যদিকে পীররা যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা কঠিন পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তা হিসেবে একটি গ্রুপকে নিয়ে স্তানান্তর করে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সবাই তার ধর্মের অনুসারী হয়েছে।
যাইহোক সবগুলো কার্য ও কারণের বহুমুখী দুর্বলতা রয়েছে।
প্রথমত এদেশে কখনো গোষ্টী বা গ্রুপ ধরে বড় কোন গণধর্মান্তরের নিদর্শন পাওয়া যায় না এবং এ ধর্মান্তর কোন নির্দিষ্ঠ একশ-দুশো বছরে সম্পন্ন হয়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে শুরু করে মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছে এ প্রক্রিয়া। ইসলামী শাসকরা এ এলাকায় তাদের রাজস্ব কাজের জন্য পূর্ব হতে অভিজ্ঞ সনাতনধর্মীদের উপরই বেশিরভাগ আস্থা রাখত এবং রাষ্ট্রিয়ভাবে কোন পৃষ্ঠপোষকতায় নজির পাওয়া যায় না। এমনকি তাদের রাজধানী এলাকাবলে পরিচিত দিল্লি আগ্রাতেও মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। আবার মধ্যপ্রাচ্য বা ইসলাম প্রধান রাষ্ট্রগুলো হতে অভিবাসীরা এখানে অনেক বেশি এসেছে এটাও ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত না।
প্রথমত এদেশে কখনো গোষ্টী বা গ্রুপ ধরে বড় কোন গণধর্মান্তরের নিদর্শন পাওয়া যায় না এবং এ ধর্মান্তর কোন নির্দিষ্ঠ একশ-দুশো বছরে সম্পন্ন হয়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে শুরু করে মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছে এ প্রক্রিয়া। ইসলামী শাসকরা এ এলাকায় তাদের রাজস্ব কাজের জন্য পূর্ব হতে অভিজ্ঞ সনাতনধর্মীদের উপরই বেশিরভাগ আস্থা রাখত এবং রাষ্ট্রিয়ভাবে কোন পৃষ্ঠপোষকতায় নজির পাওয়া যায় না। এমনকি তাদের রাজধানী এলাকাবলে পরিচিত দিল্লি আগ্রাতেও মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। আবার মধ্যপ্রাচ্য বা ইসলাম প্রধান রাষ্ট্রগুলো হতে অভিবাসীরা এখানে অনেক বেশি এসেছে এটাও ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত না।
এদেশের হানাফি মাজহাব এর প্রাধান্য দ্বারা বোঝায় যে আরব বণিকদের তেমন কোন ধর্মীয় কার্যক্রম ছিল না ভারতীয় উপমহাদেশ এলাকায়। মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় বা পূর্ব আফ্রিকায় সালাফিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্দেশ করে এ এলাকাগুলোয় ইসলাম এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের বণিকদের হাত ধরে ও প্রবল গণধর্মান্তরের মাধ্যমে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায়।
মূলত সনাতন ধর্মের কাঠামোগত কারণে ধর্মত্যাগ বা অন্যধর্মের সংস্পর্শে আশা সারা উপমহাদেশেই কঠিন ছিল। যদিও সারা উপমহাদেশেই অনেক পীর দরবেশরা এসেছেন কিন্তু বাংলা এলাকার মত সুবিধা করতে পারে নি। উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিম্নবর্গ ধর্মান্তরিত হলে সারাভারতেই একইভাবে হত কেননা সবখানেই কার্যকর বর্ণপ্রথা ছিল। আসলে সে সময় উচ্চবর্ণের শোষনকে তেমন খারাপভাবে না দেখে এটাকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হত। শোষনহীন সমাজ এ ধারণাই অনেক নতুন, মূলত ইউরোপীয় এনলাইটনমেন্ট এর আইডিয়া হতে জারিত।
অন্যদিকে বৌদ্ধরা হিন্দুদের ভয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে এটাও অতিরঞ্জিত। পাল শাসন আমলেও এখানে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে, দিনে দিনে এ দুটি ধর্ম কাছাকাছি চলে এসেছিল এবং তাদের ধর্মের স্পিরিচুয়ালিটিগুলো ব্লেন্ডেড হয়ে গিয়েছিল। পাল রাজারাও ব্রাক্ষণকন্যাদের বিয়ে করে ঘর সংসার করতেন।
মিঃ আকবর আলি খান ” বাংলায় ইসলাম প্রচারে সফল্য-একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ” বইতে এ সকল চিন্তাকে খারিজ করে দিয়ে নতুন একটি মত দিয়েছেন যা নৃতত্ব, জলবায়ু, আর্থিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিকতা দ্বারা সমর্থিত পাশাপাশি অনেক বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক। এখানকার গ্রামীন সমাজের কাঠামোকেই তিনি পীর দরবেশদের আধ্যাত্মিকতা ও আচার ব্যাবহার দ্বারা ধীরে ধীরে নিম্নবর্গের সনাতনদের ধর্মান্তরের কারণ হিসেবে প্রপোজ করেছেন। তার মতে, সারাদুনিয়ায় গ্রামীন সমাজ ৩ প্রকারঃ সংঘবদ্ধ বা কর্পোরেট ক্লাস্টার্ড সমাজ, বিচ্ছিন্ন সারিবিদ্ধ লিনিয়ার সমাজ ও পাহাড়ি ক্ষুদ্র গুচ্ছবদ্ধ সমাজ। এ এলাকার ভিন্নতর আবহাওয়া, প্রকৃতিক পরিবেশ, জলাভূমি, মাটির উর্বরতা ইত্যাদি কারণে বাইরের দুনিয়া বা ভারতে অন্যান্য অংশের মত সংঘবদ্ধ কর্পোরেট ক্লাস্টার বাসস্থান গড়ে উঠে নি। সংঘবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠে একটি বহিঃ বা অন্তঃ কেন্দকে ঘিরে। সেখানে থাকবে সুপেয় পানি সহ নানা সামাজিক সুবিধা। থাকবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বহিঃশত্রু, বন্যপশু, ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে কেউ ধর্ম বা সমাজ ত্যাগ করে অন্য ধর্ম বা সমাজে যাওয়ার মুল্য অনেক বেশি।
অন্যদিকে আদিকাল হতে গড়ে উঠা বাংলার গ্রামগুলো খাল বা নদীর পাড়ে গড়ে উঠা সারিবদ্ধ কেন্দ্রবিহীন ও কতক বিচ্ছিন্ন। গ্রামগুলো সাইজে ছোট, ১৬শ-১৭শ শতকেও এক গ্রামে ১০/১২ টি খানা। খানাগুলো আলাদা আলাদা টিবির উপর, গাছ- মাছ, ফল-সবজীতে মোটমুটি স্বাধীন।ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতা প্রবল, কেন্দ্রিয় আন্তঃসং্যোগ দুর্বল। ফলে আধ্যাত্মিকতায় আকৃষ্ট হয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলেও খুব বেশি মুল্য দেয়ার কিছু নেই। হয়ত অল্প দূরে কম উর্বর জমিতে নতুন খানা স্থাপনের সুযোগ।
বাংলা এলাকায় সমাজচ্যুত হওয়ার ফলে বিপদে আশংকা কম ছিল। বরংচ এ এলাকায় ধর্মান্তর করে যে বিপদে পড়তে হত, উত্তর ভারত সহ অন্যান্য এলাকায় অন্য ধর্মের বা বর্ণের সাথে মেলামেশা বা সামাজিক সম্পর্ক করা বেশি বিপদজনক ছিল। তাই এলাকায় পীর দরবেশদের কাছে আসার সুযোগ হয় যা অন্য এলাকায় ছিল কম। আর এএলাকায় জীবিত পীর দরবেশদের চেয়ে মৃতদের মাজার দরগা নানা ফোক মিথলজির মাধ্যমে দিনে দিনে বেশি শক্তি অর্জন করে এবং মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবেই ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে শুরু হয়ে ইংরেজ শাসন আমল পর্যন্ত ধীরে ধীরে ইসলামাইজেশন ঘটে এবং প্রধানতম ধর্ম হিসেবে আবির্ভুত হয়। – Towheed Elahi
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?