|| বাংলায় আরবি শব্দের বানান: যত মুনি তত মত ||
বাংলা ভাষার উৎস ভাষা কী? এই প্রশ্নে মতভিন্নতা আছে। কিন্তু এই ভাষার মৌলিক শব্দভান্ডার খুব বেশি না এই কথায় সবাই সহমত। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ আত্মীকরণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ভাষা। এখনো গ্রহণ করছে নানা ধরনের শব্দ। এই ভাষা সবচেয়ে বেশি শব্দ গ্রহণ করেছে সংস্কৃত থেকে। বর্তমান বাংলার প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ থেকে প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার শব্দ তৎসম। মানে খাঁটি সংস্কৃত শব্দ। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় বাংলা ভাষার দেশি শব্দ মাত্র দুই থেকে আড়াই শ’র মতো।
ভাষা গবেষকদের মতে বাংলা ভাষায় তৎসম, অর্ধ তৎসম ও তদ্ভব শব্দ ছাড়াও আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, ওলন্দাজ, তুর্কি, চিনা, জাপানি, বার্মিজ, রুশ, অস্ট্রেলীয়, হিন্দি, গুজরাটি, তামিল মারাঠি, পাঞ্জাবি ও তিব্বতি শব্দ আত্মীকৃত হয়েছে। বিদেশি শব্দের মধ্যে আরবি-ফার্সি শব্দের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।
অন্যান্য শব্দ ধীরে ধীরে যেভাবেই বাংলায় প্রবেশ করুক; আরবি-ফার্সি শব্দ ইসলাম আগমনের পরেই বাংলায় প্রবেশ করতে শুরু করে। প্রথমে আরব বণিকদের মাধ্যমে শুরু হলেও শেষাবধি ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন এবং বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষায় আরবি শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। ধীরে ধীরে সেইসব শব্দ ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দে পরিণত হয়।
যেহেতু বাংলা ভাষাভাষী মানুষজনের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাই সিংহভাগ, তাই এখনো পর্যন্ত নতুন নতুন আরবি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলায়। এর অন্যতম কারণ, ইসলাম ও মুসলমাদের বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও চৈতন্য মূলত আরবি টেক্সট ও গবেষণার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। বাংলায় ইসলাম সম্পর্কিত অনুবাদ গ্রন্থের জরিপ করা হলে দেখা যাবে, সবচেয়ে বেশি অনূদিত গ্রন্থ আরবি ভাষার।
সম্প্রতি বাংলা ভাষাভাষী মুলিমদের মধ্যে আরবি চর্চার আগ্রহ বেড়েছে। অনলাইন ও অফলাইনের বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে অনেকেই আরবি ভাষা শিখছেন। ইসলামের চর্চা করছেন। ইসলামের জ্ঞানীয় নানা শাখা নিয়েও তারা লিখছেন। এই শেখা, গবেষণা, চর্চা ও লেখালেখির ভেতর দিয়ে ভাষাগত একটা অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। বলা ভালো, বাংলায় ব্যবহৃত আরবি ভাষার শব্দাবলির ‘বানানে’ কিছুটা বিচ্ছিন্নতা অথবা ‘নানা মুনির নানা মত’ নিয়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করছে। ভার্চুয়াল লেখালেখি এবং কাগুজে লেখালেখিতেও সেই বিশৃঙ্খলার প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
এক একজন মানুষ এক একজন বানানবিদ! প্রায় লেখকেরই নিজস্ব বানানরীতি দেখা যায়। যে যেভাবে চাইছেন; লিখছেন আরবি শব্দগুলোর বানান। এমন পরিস্থিতিতে সালাফি ঘরানার লেখকগণও নিজস্ব বানানে আরবি শব্দাবলি লিখছেন। এইসব বানান-বিশৃঙ্খলার মূলে কারণটা আসলে কী? সেই কারণগুলোর জন্য আমরা একটা হাইপো থিসিস দাঁড় করাতে পারি। যদিও হাইপো থিসিস তবুও এইসব বানান লেখকদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের চিন্তাভাবনার জগৎ থেকেই আমরা এই কল্প-ভাবনাটা দাঁড় করাব।
এই দেশে মৌলিকভাবে ধর্মীয় ব্যক্তিগণ বাংলা ভাষার চর্চা করেছেন অনেকটাই মানুষের পাঠ-চাহিদা মেটাতে। ফলে, তারা শব্দকে যেভাবে পেয়েছেন অথবা নিজেরা সচরাচর যে উচ্চারণে বলেছেন, সেই উচ্চারণে লিখেছেন। আর এই লেখালেখির ঘরানার মধ্যে তিনটি ঘরানা মোটাদাগে আমরা দেখি। এক, দেওবন্দি। দুই, সুন্নি। তিন, সালাফি। এই তিন ঘরানার আকাবিরদের মধ্যে শব্দ ব্যবহারের ভিন্নতা থাকলেও বানানে ততটা ভিন্নতা ছিল না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন নানামাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিটি ঘরানাকে; তখন তাদের কারো মধ্যে হীনম্মন্যতা, কারো মধ্যে আভিজাত্যবোধ আবার কারো মধ্যে ব্যতিক্রমতার চৈতন্য তীব্র হয়ে উঠছে। একদিকে বাংলা ভাষায় আরবি শব্দের প্রভাব ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একদল নিরন্তর প্রচেষ্টা করছে। ক্ষমতা, একাডেমিক চর্চা ও বাংলা একাডেমিকে ব্যবহার করে বানানের ঐতিহ্য বদলে আরবির আবহ পর্যন্ত ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আরেকদল ক্রমাগত আরবি সংলগ্নতার দিকে ছুটছে। দুই প্রান্তিকতার নিট ফলাফল: বানানে চরম নৈরাজ্য।
পৃথিবীর প্রতিটা ভাষাই আত্মীকৃত শব্দকে নিজস্ব ভাষার ঢঙ্গে উচ্চারণ করে থাকে। সেই সঙ্গে ভাষার ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করে। [ভাষার ঐতিহ্যের আলোচনা আমরা ভিন্ন লেখায় করব।] আমরা দেখি, আমাদের দেশের কেউ কেউ আরবি শব্দকে বাংলার ফ্লেভার থেকে বের করে চোস্ত আরবির উচ্চারণে লেখার চেষ্টা করেন। যদিও ভাষাতাত্ত্বিক ও ভাষার চরিত্র অনুযায়ী সেটা কখনোই সম্ভব নয়। বাংলার ট, ঠ, ড, ঢ, অথবা প, ভ-কে আরিবেতে কীভাবে উচ্চারণ করবেন? আরবি, ح ,ع ,ق অথবা হামজা সাকিনকে বাংলায় কীভাবে আপনি প্রকাশ করবেন? এই প্রচেষ্টা কেবল বিশৃঙ্খলাই তৈরি করবে।
শোনা কথা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাকি বাংলা ভাষায় আরবি শব্দের বানানের ক্ষেত্রে ভিন্ন একটা পদ্ধতি ব্যবহার করতে চেয়েছিল। যেমন, এক আলিফ মাদ্দের জন্য দুই আকার এই রকম। মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীর এক আলোচনায় এমনটা শুনেছিলাম। এই ধরনের শুদ্ধতাবাদী চিন্তা ভাষাকে মূলত আড়ষ্ট ও গতিহীন করে দেয়। প্রতি চার কিলোমিটার অন্তর অন্তর নাকি মানুষের ভাষার উচ্চারণগত পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন, এক গ্রামের মানুষ ‘পানি’কে ‘ফানি’ বলছে তো পাশের গ্রামের মানুষ ‘হানি’ বলছে। ভাষা একটা গতিশীল বিষয়। এর গতিরোধ করতে চাইলে ভাষাই আপনাকে ত্যাগ করতে পারে।
বাংলা আমাদের ভাষা। আমরাই একে সমৃদ্ধ করব। আবুল হাসান আলি নদভির চৈতন্য ধারণ করে ভাষাকে ভালো ভাসলে একদিন এই ভাষাই আমাদের হয়ে কথা বলবে। আর যদি আমরা আমাদের ঐতিহ্যগত নানান তাফাররুদাত ও শুযুযের চর্চাকে ভাষা পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসি; তাহলে ভাষাগত উপনিবেশ ও ভাষাগত পরাধীনতা থেকে কখনোই মুক্তি পাব না। তাই আসুন অন্তত ভাষাটাকে, ভাষার বানানটাকে আমাদের ইখতেলাফের কেন্দ্রে না আনি।
রমজান। রামাজান। রামাদান। রমাদন। রামাদন। রমাদান। ড়মাদন। ড়ামাদান। ড়ামাদন। ড়মাদান। রামাদ্বন। ড়ামাদ্বন। ড়মাদ্বন। ‘জ’ এর জায়গায় ‘য’ দিয়ে আবার সবগুলো ভেরিয়েশন পড়ুন। কী ব্যাপার! আপনার মাথা আউলানোর জন্য আর কি চাই! হ্যাঁ, এইটাই চলছে। গত কয়েক বছরে ভার্চুয়াল জগতে, বইয়ের পৃষ্ঠায় এইরকম নানা ধরনের বানান দেখছি আর হয়রান হচ্ছি। এই দেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ‘রমজান’ লেখায় কী এমন সমস্যা বা হারাম হয়ে যাচ্ছিল! কেন এতগুলো বানান আমাদের আমদানি করতে হলো? এখন যেই শিশুটি ঘরে এই বানান দেখে বিপর্যস্ত হয়ে পরের দিন স্কুলের খাতায় ‘ড়মাদন’ লিখবে, সেই শিশুটির শিক্ষক বাংলা একাডেমির বানান অনুসারে এই বানান কেটে দেবে। শিশুটা জানবে তার সব জানা ঠিকঠাক না! কথাটা খুব সরল করে বলেছি। কারো কাছে হাস্যকর লাগতে পারে! একজন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের এই ধরনের কনফিউশন আমি দেখছি। এই নৈরাজ্য দিয়ে বৃহত্তর ও একাডেমিক সোসাইটিতে হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া কিছুই অর্জন হবে না।
সলাত, সালাত, স্বোলাত, স্বলাত। সহী, সহীহ, স্বোয়াহীহ, স্বহীহ। সাওম, সওম, স্বাওম, সিয়াম। সেহরি, সেহেরি, সাহরি, সাহূর। এই দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে জেনে আসছে, সালাত, সহী/সহীহ, সাওম, সেহেরি। অথচ হঠাৎ করেই তাদের ব্যবহৃত সেই ‘সেহেরি’ অর্থ হয়ে গেছে যাদু! এখন ‘সাহূর’ ব্যবহার করতে হবে! এই ধরনের বক্তব্যের মূল কারণ হচ্ছে ভাষাতাত্ত্বিক চর্চা ও গবেষণাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা। ভাষার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কিত ধারণাগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া না থাকা। শব্দের আক্ষরিক অর্থের বাইরে ‘শব্দোত্তর অতিরেক’, শব্দের অর্থালংকার ও শব্দ ব্যবহারের পরম্পরা সম্পর্কিত ঐতিহাসিক সিলসিলা সম্পর্কে বেখবর থাকলে যে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বহু শব্দের নতুন করে ‘মুসলামানি’ করাতে হবে!
নববী, নবয়ী, নাবাউই, নাবাউভী। নদবী, নদভী, নাদাউই। তাজবিদ, তাজভীদ, তাজউইদ। এই হচ্ছে বানান এলিটিজমের আরেক উদাহরণ। আমরা শৈশব, কৈশোর থেকে পড়ে ও লিখে আসছি নববী, নদবী/নদভী ও তাজবিদ। ইদানীং এসে আমাদের এলিট ক্লাসের ভাইদের এইসব পুরোনো বানানে চলছে না। আরবির নিকট উচ্চারণে লিখতে হবে। আর সেই নিকট উচ্চারণে লিখতে গিয়ে কী খটমটে হালত করেছেন বানানগুলো তা তো দেখতেই পারছেন। আরবি ভাষার সরফ অংশের তালিল বা শব্দান্তর্গত সন্ধিতে আমরা দেখি উচ্চারণে জটিল ও বলার সময় কষ্টদায়ক বা ‘উসরে নুতক’ হলে শব্দটাকে সহজ উচ্চারণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে ‘তালিল’ করা হয়। সেই আরবি পড়ুয়ারাই আজ বাংলাকে জটিল, কঠিন, ও আজিব-গরিব বানানে লেখার কসরত করছেন!
আরবরা বাংলাদেশকে বলেন ‘বানজালাদিশ’। মিশরকে বলেন, ‘মিসর’। মরক্কোকে বলেন ‘মারাকিশ’। জিব্রাল্টারকে বলেন ‘জাবালুত তারিক’। পাকিস্তানকে বলেন, ‘বাকিস্তান’। তারা কাছাকাছি উচ্চারণের চেষ্টা করেন না। সাধারণত তাদের কেউ ‘নিজস্ব বানানের’ মতো নিজেই ইন্সটিটিউট বা একাডেমিয়া হয়ে বসেন না।
আবার ইংরেজরা, মিশরকে ‘ইজিপ্ট’, হাদিসকে ‘হাদিথ’, ইউসুফকে ‘জোসেফ’, ইয়াকুবকে ‘জ্যাকব’, ইব্রাহীমকে ‘আব্রাহাম’ ভারতকে, ‘ইন্ডিয়া’, ইবনে সিনাকে ‘আবে সীনা’ ইত্যাদি বানানে লিখে থাকে। এইটা তাদের ভাষার (এবং ধর্মীয় কিতাবাদিরও) নিজস্বতা। সেইখানে এইসব নিয়ে খুব একটা বিশৃঙ্খলা আছে এমন দেখা যায় না। তাদের লেখালেখিতে কখনোই আরবির নিকটতম উচ্চারণের প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যায় না।
মোঃ, মুঃ, মোহাঃ, মো., মু., মুহা. মোহাম্মদ, মোহাম্মাদ, মুহাম্মাদ, মুহাম্মদ, মহম্মদ। আহমদ, আহমাদ, আহমেদ, আহাম্মেদ, আহম্মদ। মোবারক, মোবারাক, মুবারাক, মুবারক। বানানের এই ভেরিয়েশনও আছে আমাদের সোসাইটিতে। প্রথম দুইটা যেহেতু ব্যক্তির নাম সংশ্লিষ্ট তাই ব্যক্তি যেভাবে লিখবেন সেভাবেই তার জন্য ঠিক। এই নিয়ে আসলে খুব একটা কথা চলে না। কিন্তু মোবারক নিয়ে নতুন করে এই বানান এক্সপেরিমেন্ট মূলত ভাষাগত বিশৃঙ্খলারই অংশ।
চাইনিজদের ভাষা ‘মান্দারিনে’ বাংলাদেশকে ‘মুনজালা’ বলে। তারা এইসব উচ্চারণ নিয়ে মনে হয় না কোনো রকম হীনম্মন্যতা বা এলিটিজমের ক্রাইসিসে ভোগে।
ফলে, বাংলা ভাষায় আরবি শব্দের প্রচলিত যে বানান আছে, সেটাতেই আমাদের স্বস্তি। বাংলায় যদি ইসলামি কন্টেন্ট গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই, তাহলে গণমানুষের ভাষা ও অভ্যস্থ বানানেই পৌঁছাতে হবে। আর আমাদের এইসব এলিটিজমজাত ইনোভেটিভ বানানে মূলত নিজেদের নিজস্বতার আমিত্বপিয়াসই মিটবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
এইসব বানানের পেছনে এই অঞ্চলে ইসলাম নিয়ে আসা মানুষেরা কম জানত। আবার এখনো যারা প্রচলিত বানান লেখেন, তারা কম জানেন। অথবা তারা মানুষের কাছে আরবি শব্দগুলো যথাযথ পৌঁছাতে পারেননি। এইরকম একটা ব্যাপার কারো কারো বাকভঙ্গি ও দেহভাষাতে ধরা পড়ে। শিকড়কে এভয়েড করে, ঐতিহ্যকে বিদায় করে, জটিলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে মূলত শুযুয ও তাফাররুদাতকে উৎসাহিত করা যায়। সম্মিলিত সংগ্রামের পথকে সংকুচিত করা যায়। বিভাজনকে বাড়ানো যায়। দিনশেষে নানামাত্রিক আদর্শিক পরাজয় নিয়ে বাণিজ্যিক লাভে তুষ্ট থাকতে হয়।
•
সাইফ সিরাজ
কবি ও বিশ্লেষক
মাসুদ শরীফ,
একটু হলেও ভেবেছিলাম নতুন কিছু পাবো। অবশ্য মনে মনে ধরেই রেখেছিলাম অসম্পূর্ণ গবেষণা করে নতুন করে পুরোনো জিনিস বলা হবে। তাই হলো। সেজন্য আমিও গত ১০ বছর ধরে বলে যাওয়া পুরোনো কথাগুলিই নতুন করে বলব।
পুরো লেখাটির মূল কথা, আরবি শব্দের ‘প্রচলিত’ বানানেই স্বস্তি। ‘সবাই’ যেন সেগুলি ব্যবহার করেন।
লেখকের একাধিক যুক্তি থেকে দেখা যায়—শুধু আরবি না—বিদেশি শব্দের বাংলা বানানের বিবর্তন সম্বন্ধে লেখক অনেকটাই বেখেয়াল।
একদম শিরোনাম থেকে শুরু করি।
এই লেখার শিরোনামে লেখা ‘আরবি’। অথচ লেখকের যুক্তি মোতাবকে ‘প্রচলিত’ বানানে ‘আরবী’ হবার কথা ছিল। এটা কোন নিয়মে ‘আরবি’ হলো?
‘রমজান’ আর ‘সালাত’ শব্দের বহু বানান দেখিয়ে—যেগুলোর মধ্যে শেষের একাধিক বানান ব্যবহারের হার ১%-এরও কম হবে—লেখক পাঠককে চমৎকৃত করতে চেয়েছেন। লেখকের মূল কথা: ‘রমজান’ শব্দটা যেহেতু বহুল প্রচলিত, এখানে অন্য বানানগুলো আনা অবান্তর। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন এতে শিশুরা বা নতুন পাঠকেরা একই শব্দের একাধিক বানান দেখে বিভ্রান্ত হবে।
মজার ব্যাপার, একসময়ের ‘বহুল প্রচলিত’ বানানের ‘অবান্তর’ পরিবর্তনের ফলে এখন আমরা ‘নমাজ’কে লিখি ‘নামাজ’, ‘মগরেব’কে লিখি ‘মাগরিব’, ‘এশা’কে লিখি ‘ইশা’, ‘এবাদত’কে লিখি ‘ইবাদত’, ‘এহসান’কে ‘ইহসান’, ‘কোরআন’কে ‘কুরআন’, ‘কেতাব’কে ‘কিতাব’, ‘ফাতেহা’কে ‘ফাতিহা’, ‘তফসীর’কে ‘তাফসির’, ইত্যাদি।
লেখক কি জানেন, ‘কুরেশি’ আর ‘বয়েত’ শব্দদুটো যথাক্রমে বর্তমানে ‘প্রচলিত’ ‘কুরাইশ’ ও ‘বাইয়াত’ শব্দের আদি বানান?
আরবি-শব্দের-বাংলা-বানান গবেষকেরা ইংরেজি বইপত্র পড়লে দেখতেন একই ‘Salah’ শব্দের অন্তত ৪টি ধরন: salat, salah, salaah, (এই তিনটি উচ্চারণ মোতাবেক) ṣalāt (এটা প্রতিবর্ণীকরণ; এই প্রতিবর্ণীকরণের আবার একাধিক রীতি আছে)।
এই পরিবর্তনগুলো কেন হলো? কেন আমরা এখনো ‘মগরেব’ বলি না? ‘একামত’ বলি না?
শুরুর দিকে এই শব্দগুলি যখন এল, তখন বাংলা ভাষার নিজেরই কোনো চেহারা ছিল না। আমরা এখন যে বাংলায় কথা বলি বা লিখি—যদি বঙ্কিমের গদ্যরচনার সময় থেকে ধরি—মাত্র ২ শ বছরের ওপর হবে। এর আগে মূলত লেখা হতো পুঁথি। মুখে মুখে রচনা হতো কবিতা। তখন বাংলা ভাষার কোনো অভিধান ছিল না। ব্যাকরণ ছিল না। তখন শুধু বিদেশি ভাষার শব্দ না; বাংলা শব্দের বানানেও কোনো সংগতি ছিল না। খোদ বাংলা বানানেরই একটা অভিন্ন রূপ দেয়ার বয়স হবে মাত্র ৮০-৯০ বছর। লেখক যে যুক্তি দেখালেন শিশুরা বাসায় ‘রামাদ্বান’ আর স্কুলে ‘রমজান’ দেখলে ভিড়মি খাবে, এই একই শিশু ২০ বছর আগের বইতে ‘পাখী’ আর এখনকার বইতে ‘পাখি’ দেখলে কি বেহুঁশ হবে?
বাংলা ভাষায় বাংলা শব্দের এখন পর্যন্ত শতভাগ অভিন্ন বানান দেখা দুষ্কর। সেখানে বিদেশি শব্দের বেলায় সেটা যে আরও কিছু সময় নেবে সেটা তো আশ্চর্যের না। প্রতি যুগে সেই সময়ের লেখক-সমাজ বিদেশি শব্দকে তার পাঠ-অভিজ্ঞতা ও ভাষাজ্ঞানের মিশেলে লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ ‘টেলিভিশান’ লিখেছেন; অথচ আমরা গণহারে বলি ‘টেলিভিশন’। আমরা ছোটবেলায় জানতাম ‘আগস্ট’। ক্যালেন্ডারে তা-ই দেখেছি। এখন আমরা শিখছি লিখছি ‘অগাস্ট’।
সময় যত এগিয়েছে আরবি শব্দের বানানেও তা-ই ভাষার স্বাভাবিক নিয়মে বিবর্তন এসেছে। আসতে থাকবে আরও কিছু বছর। তারপরও কিছু বিষয় থাকবে তর্কসাপেক্ষ। এটাই ভাষার চরিত্র। এখনো আমরা ‘কারও/কারো’, ‘এখনও/এখনো’, ‘ভাল/ভালো’ ইত্যাদি বাংলা বানান নিয়ে একমত হতে পারিনি। এই যে লেখক ‘কারো’ লিখে গেছেন, এটা তো বাংলা একাডেমি মতে শুদ্ধ না। আমাদের শিশুরা পাঠ্যপুস্তকে দেখবে ‘কারও’। এখানে দেখবে ‘কারো’। কী শিখবে সে?
বানানের অস্থিরতা ভাষার অস্থিরতা নয়। বানান একটা টেকনিক্যাল বিষয়। ৩ মাস সময় দিলে ৯০ ভাগ বানান আত্মস্থ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ইসলামি অঙ্গনের মূল সমস্যা ‘ভাষায়’। শব্দ ও বাক্যের সহজতায়, সাবলীল বর্ণনায়, সাহিত্যিক প্রয়োগে। এই জায়গায় মুনশি হলে লেখক ‘ইদ’ লিখলেন না ‘ঈদ’ তাতে লেখার মান বাড়ে-কমে না।
বাংলা ভাষায় আরবি শব্দের বানান নিয়ে অতি-কাল্পনিক উদ্ভট আশঙ্কা দূর হোক। বানান নিয়ে প্রায় প্রত্যেক পেশাদার প্রকাশনী ও পত্রিকার নিজস্ব রীতি আছে। বাংলা বানানের বেলায় এই রীতিগুলোতে প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে অভিন্ন বানান দেখা যায়। ইসলামি প্রকাশনীর মধ্যে বড়জোর ৩/৪টি প্রকাশনী ছাড়া কারও কোনো নিজস্ব ভাষারীতি আছে বলে আমার জানা নেই। যাদের আছে তারা সেই রীতি ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। এর ফলে দুটো প্রকাশনীর মধ্যে একই শব্দের দুই ধরনের আরবি বানান দেখতে পাওয়ায় সমস্যা নেই।
বানানের বিচিত্র কিসিম দেখা যায় সাধারণত অনলাইন লেখালেখি ও কোর্স শিটে। অনলাইনের অনেক লেখকদের অনেকের বাংলা বানানই ঠিক নেই। সেখানে তাদের হাতে আরবি বা বিদেশি শব্দের চতুর্থ বা পঞ্চম রকমের বানান দেখতে পাওয়ায় চোখ ওল্টানোর তো কিছু দেখি না। কোর্স শিটগুলো সাধারণত প্রুফ-রিড হয় না। কোনো প্রকাশনী থেকে না আসায় এখানে কোনো নির্দিষ্ট ভাষারীতি অনুসরণ হয় না। সুতরাং এখানেও বাংলা-আরবি-ইংরেজি শব্দের বিচিত্র বানান দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক।
পুনশ্চ: আরবি শব্দের বানান নিয়ে আমার এ-ধরনের কথায় অনেকের ধারণা হয়, আমি বুঝি ‘খবর’কে এখন থেকে ‘খাবার’ লিখতে বলছি। ‘সবর’কে ‘সাব্র’, ‘গলদ’কে ‘গালাত’ লিখতে বলছি।
না তা বলি না।
আমি শুধু পরিভাষা, নাম ও জায়গার বেলায় উচ্চারণ মোতাবেক বানান বা প্রতিবর্ণীকরণের সপক্ষে বলি। বাংলা ভাষায় নিত্য ব্যবহার হওয়া বিদেশি বা আরবি শব্দের বেলায় বানান উচ্চারণ মোতাবেক লেখার সলা দিই না।
উচ্চারণ মোতাবেক বানান ও প্রতিবর্ণীকরণ দুটো আলাদা রীতি। দুটোকে কেউ গুলিয়ে ফেলবেন না।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?