বনফুল তার বাড়িটি বন্ধক রেখেছিল : জাওয়াদ উল আলম

বইয়ের নাম : বনফুল তার বাড়িটি  বন্ধক রেখেছিল – রিভিউ
লেখক : জাওয়াদ উল আলম
জনরা : রিভেঞ্জ থ্রিলার/ক্রাইম থ্রিলার
প্রকাশনি : ঈহা প্রকাশ

কাহিনী সংক্ষেপ :

মাত্রই পুলিশ ডিপার্টমেন্টে সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে জয়েন করেছে তরুণ অর্ক হাসান খন্দকার।জয়েনিং এর প্রথম দিনই এক অদ্ভুত কেস এসে হাজির হল অর্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। আরিফুর রহমান নামে এক ছেলে এসে আত্মসমর্পণ করে সনামধন্য এক লেখককে খুন করার দায়ে।কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে বেরিয়ে আসল ভিন্ন এক তথ্য।খুনি যে লেখকের কথা বলেছিল তা একটা বইয়ের চরিত্র মাত্র! কিন্তু লাশ পড়ে আছে সেই বইয়েরই লেখক আশরাফুল ইসলামের!!ক্রাইম সিন এ পড়ে আছে তাঁরই বই “বনফুল তার বাড়িটি বন্ধক রেখেছিল”।তাহলে কি ছেলেটা মিথ্যে বলছে? মিথ্যে বললে পুলিশের কাছে এসে ধরাই বা দিবে কেন?নাকি এর পিছনে রয়েছে আরেক রহস্য??ভেতর থেকে কলকাঠি নাড়ছে অন্য কেউ??

আমজাদ আহমেদ গল্পের আরেকটি মুখ্য চরিত্র।মেয়ের আত্মহত্যার পর স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়া,মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত লোকটি হল কোতোয়ালি থানার ওসি।অর্কের সাথে মিলে এই কেসের সমাধানের জন্য তদন্ত শুরু করেন।তদন্ত যত এগোতো থাকে বেরিয়ে আসতে থাকে বিভিন্ন সত্য।বাড়তে থাকে সন্দেহভাজনের সংখ্যা।সন্দেহভাজনদের মধ্যে রয়েছেন আশরাফুল ইসলামের বড় ভাই আকবর ইসলাম,তাঁর স্ত্রী স্নেহা ইসলাম এবং অবশ্যই আরিফ।কিন্তু তদন্ত চলাকালীন হঠাৎ করেই একদিন খুন হয়ে যান আকবর ইসলাম।অর্ক এবং আমজাদ আহমেদের মাথায় হাত!যাকে সন্দেহ করা হল সেই খুন!তার চেয়েও বড় অবাক ব্যাপার এই খুনের ক্রাইম সিনেও পড়ে আছে সেই বইটি,” বনফুল তার বাড়িটি বন্ধক রেখেছিল”। তবে কি একই খুনী দুটো খুন করল?নাকি ভিন্ন খুনী?সত্য মিথ্যা এবং প্রতিশোধের বেড়াজালে লুকিয়ে থাকা মূল ঘটনা কি বের করতে পারবেন অর্ক এবং আমজাদ আহমেদ?

পাঠ-পর্যালোচনা :

পশ্চিমা বিশ্বের বা জাপানি ডার্ক রিভেঞ্জ থ্রিলারগুলা খুব আগ্রহ নিয়ে ইদানীং অনেকগুলো পড়েছিলাম।তবে আমাদের দেশের মৌলিক রিভেঞ্জ থ্রিলারের মধ্যে এটাই প্রথম পড়লাম।দেশীয়ে প্রেক্ষাপটে রচিত দারুণ এক মৌলিক থ্রিলার হচ্ছে ” বনফুল তার বাড়িটি বন্ধক রেখেছিল”।

যা ভাল লেগেছে :

১.”মার্ডার মিস্ট্রি” বিষয়ক থ্রিলার পড়ার সময়টায় প্রথমেই আমি লক্ষ করি তদন্ত প্রক্রিয়াটা।ঠিক ঠাক ভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে লেখক গল্পে উপস্থাপন করেছেন কিনা সেটা।গল্পটিতে এই জায়গায় আমি বেশ সন্তুষ্ট। দুটি খুনেরই তদন্ত প্রক্রিয়া,ক্রাইম সিন পর্যবেক্ষণ,ফরেনসিক ডিটেইলস,আংগুলের ছাপ সনাক্তকরণ,সাসপেক্ট ইন্টারোগেশন খুব সূক্ষ্মভাবে লেখক ধাপে ধাপে সময় নিয়ে বর্ণনা করেছেন।সাধারণ এই টাইপ বিশ্লেষণগুলো ধীর গতির হয়। এখানে তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি।লেখক এখানে বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।

২.ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট টা এখানে সময় নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।যেমন গল্পের দুই মুখ্য চরিত্র অর্ক এবং আমজাদ এর ক্যারেক্টর বিল্ড আপ টা ধাপে ধাপে সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন।তাড়াহুড়ো করা হয় নি কোন জায়গাতে।একদিকে যেমন তদন্ত প্রক্রিয়া দিয়ে কাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে ফ্ল্যাশব্যাকে আমজাদ আহমেদ এবং অর্কের ব্যাক স্টোরি দেখানো হয়েছে।চরিত্রায়নের জন্য যতটুকু সময় গল্পে দেওয়া দরকার ঠিক ততটুকুই বর্ণনা করা হয়েছে।

৩.”মেমরি প্যালাস” সম্পুর্ণ নতুন একটা টপিক ছিল।এত এত গল্প মুভি দেখার পর ও এই টার্ম টা আমি এই প্রথমবারের মত জানলাম।যদিও কাহিনী তে এই টপিক তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি।বেশ গুগল ও ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে জানার পর।নতুন শব্দটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য লেখক কে অসংখ্য ধন্যবাদ।

৪.মূল দুই চরিত্রের ক্যামিস্ট্রি টা দারুন লেগেছে আমার কাছে।যেন বড় দুই ভাইয়ের মধ্যেকার বন্ডিং দেখানো হয়েছে। আমজাদ আহমেদ এবং অর্কের মধ্যে কর্তব্যরত বস-কর্মচারির সম্পর্ক ছাড়াও তাদের মধ্যে ভালবাসা এবং স্নেহের যে বন্ধন গড়ে উঠেছে তা খুব ভাল লেগেছে আমার কাছে।সাধারণ থ্রিলার বইয়ে প্রোটাগনিস্ট এর মধ্যে এসব দেখানো হয় না শুধু তদন্ত প্রক্রিয়া এবং আনুষঙ্গিক জিনিসে বেশি ফোকাস করা হয়।

৫.বাংলাদেশে মূলত(ব্যাতিক্রম কিছু বাদ দিলে)মৌলিক থ্রিলার এর পটভূমি সাধারণত ঢাকা ভিত্তিক বা ঢাকার আশেপাশে হয়ে থাকে।কিন্তু এই গল্পে চিটাগাং শহরের পটভূমি দেখানো হয়েছে যেটা বেশ ভাল লেগেছে।এই সুযোগে চিটাগাং শহরের কিছু জায়গার নাম ও জানা হল! চিটাগাং এর বাসিন্দারা আরো বেশি উপভোগ করবেন বইটি।

৬.বইটির মধ্যের দুইটি উক্তি আমার খুব পছন্দের।এর মধ্যে একটি হল,

জীবন হলো চলন্ত গাড়ির মতো। যতক্ষন পর্যন্ত ড্রাইভিং সিটে আছো ততক্ষন চালিয়ে যেতে হবে। প্রিয়জন নামের অনেক মানুষ প্যাসেঞ্জার সিটে বসবে। কিছুক্ষণ গাড়িতে তোমার সাথে সামনে এগিয়ে আবার অনেকেই চলে যাবে। কেবল গাড়িতে থেকে যাবে তাদের স্মৃতি নামক শরীরের ঘ্রাণ। তবুও ড্রাইভিং সিটে বসে তুমি জীবন থামিয়ে রাখতে পারবে না। এগিয়ে যেতেই হবে, সামনের দিকে।

আরেকটি পছন্দের উক্তি হচ্ছে,

অন্ধকার নিশাচরদের হাতিয়ার। তবে অন্ধকার হ‌ওয়াটা কী আসলেই ভুল? আসলেই কী সবসময় আলো থাকা সঠিক?

যা ভাল লাগেনি :

১.গল্পটিতে ক্যারেক্টর ডেভেলপমেন্ট এ সময় লাগলেও কোন কোন জায়গায় অহেতুক টেনে লম্বা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে।২৩৬ পৃষ্ঠার বই সম্পাদনা করে আরো কাটছাঁট করে ছোট করা যেত।এই অহেতুক কথাবার্তার জন্য গল্পটি মাঝে স্লো হয়ে গিয়েছিল এবং সাসপেন্স টাও কমে গিয়েছিল।

২.লেখনশৈলী তে দুর্বলতা দেখা গেছে।বাক্য গঠনে কোন কোন জায়গায় অপারদর্শিতা এবং শব্দচয়ন ও ঠিকঠাক লাগে নি।উন্নতির প্রয়োজন আছে লেখকের লেখনশৈলী তে।আশা করি সিরিজের পরবর্তী বইয়ে লেখকের কাছ থেকে আরো সুন্দর লেখনশৈলী দেখতে পারব।

৩.বইয়ের অন্যতম মূল চরিত্র অর্ককে একটু হলেও দূর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।আমজাদ আহমেদের ছায়ায় যেন ছিল চরিত্র টি পুরো বই জুড়ে।আরো শক্তিশালী ভাবে উপস্থাপনের আশা করেছিলাম এই চরিত্র টি কে।

কেন বইটি পড়বেন :

রিভেঞ্জ এবং পুলিশ প্রসিডিওরাল এই দুইয়ের সংমিশ্রণে যদি কোন থ্রিলার পড়তে চান তাহলে বইটি হাইলি রিকমেন্ডেড।গল্পটি তে একেবারে চমকে যাওয়ার মত টুইস্ট নেই,সাদামাটা টুইস্ট থাকলেও চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে রচিত “বনফুল তার বাড়িটি বন্ধক রেখেছিল” এই রিভেঞ্জ থ্রিলারটি পড়ে বুঝতে পারবেন প্রতিশোধের নেশা মানুষকে কি থেকে কি বানিয়ে ফেলতে পারে।পাতায় পাতায় থ্রিল,সাসপেন্স যদি বইটি তে খুঁজতে চান তাহলে আপনাকে আশাহত হতে হবে।

প্রচ্ছদ :

তেমন ভাল লাগে নি প্রচ্ছদটা। তবে প্রচ্ছদের মধ্যে দেওয়া দুটি বইয়ের ছবির সাথে গল্পের প্লটের সাথে সামঞ্জস্যতা লক্ষ করা গেছে।

বাইন্ডিং :

এই বইটির বাইন্ডিং সন্তুষ্টজনক।একদম স্মুথ,দুইপাশে রেখে ইজিলি পড়া যায়,কোন জোরাজুরি করা লাগে নি এছাড়া বইটি ধরতেও বেশ আরামদায়ক।

বানান এবং সম্পাদনা :

খুব হতাশ এই জায়গাটায়। প্রচুর বানান ভুল ছিল। প্রায় অনেক জায়গায়ই যুক্তবর্ণ প্রিন্টে ঠিকঠাক ভাবে আসে নি। তাছাড়া যতি চিহ্নের ব্যবহারও সঠিকভাবে হয় নি।এসব ভুল পড়ার গতিকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছিল।আশা করি প্রকাশক ভবিষ্যতে সম্পাদনার দিকে একটু মনোযোগ দিবেন।

Jawad Ul Alam আপনার বইয়ের শুরুতে লিখা উৎসর্গপত্র টা আমার হ্নদয় ছুঁয়ে গেছে।অনেক অনেক ভাল লেগেছে আপনি যেভাবে লিখেছেন।অনেক অনেক শুভকামনা আপনি এবং আপনার পরিবারের জন্য।

বনফুল তার বাড়িটি বন্ধক রেখেছিল” সিরিজের পরবর্তী বইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

পার্সোনাল রেটিং – ৪/৫

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?