Post ID 1114536
বই : মাওলানা মওদূদী একটি জীবন একটি ইতিহাস
খেলাফত আন্দোলন মাওলানা মওদূদীর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ই নয়, বরঞ্চ মুসলমানদের জাতীয় ইতিহাসের দিগদর্শী। সংক্ষেপে হলেও এ সম্পর্কে কিছু আলোচনার প্রয়োজন, যাতে করে তার পটভূমিকায় মাওলানার জীবন চরিত সম্যক উপলব্ধি করা যেতে পারে।
বিগত প্রথম মহাযুদ্ধে ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি তুরস্ক (The sick man of Europe) ইংরেজদের বিরুদ্ধে জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধ করে। সে সময় পর্যন্ত তুরস্কে উসমানিয়া সাম্রাজ্য খেলাফতের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসাবে গণ্য হতো। ইংরেজ প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত এবং মুসলিম ঐক্য ভেঙে চুরমার করার উদ্দেশ্যে লরেন্স অব অ্যারাবিয়াকে আরব জাতীয়তাবাদের প্রচারক হিসাবে আরব দেশে প্রেরণ করেন। মক্কার তদানীন্তন শরীফ হুসাইন হাশমী এ প্রচারণায় এতোটা প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে, ১৯১৫ সালে মাঝামাজি আরবদের জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারন করে তুরস্কের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করেন। প্রথম মহাযুদ্ধে ইংরেজ তথা সম্মিলিত বাহিনী (Allied Forces) বিজয় লাভ করে। তারা যুদ্ধের প্রারম্ভেই একটি গোপন চুক্তি মাধ্যমে উসমানিয়া সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে রেখেছিল। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হলো। ইউরোপীয় অংশ তার হাতছাড়া হলো। আরব জাতীয়তাবাদের বিষক্রিয়ার ফলে আরবদেশগুলি তুরস্ক সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল বটে, কিন্তু সেগুলিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও গ্রীসের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হলো। উসমানিয়া সাম্রাজ্য প্রাচীন আনাতোলিয়াতে (ইস্তাম্বুল) সীমিত হয়ে থাকল। ১৯১৯ সালের মে মাসে উসমানিয়া রাজধানীতে শুধুমাত্র নাম সর্বস্ব সুলতানের অস্তিত্ব বাকী রইল। এখানেও তার স্বাধীনতা ছিল বিপন্ন। বৃটিশ ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের মনে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিলেন যে, খলীফাতুল মুসলিমীন এবং খেলাফত ব্যবস্থা তাদের প্রকৃত ঈমানের অঙ্গ-অংশ। অতঃপর উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতন এবং তার ছিন্নভিন্ন অবস্থা দৃষ্টে ভারতীয় মুসলমানদের মনে এ সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ইংরেজ হয়তো খেলাফতের কেন্দ্রকেই ধ্বংস করে দেবে-যেটাকে মুসলমানগুণ তাদের দ্বীনী এবং রূহানী কেন্দ্র মনে করতো।
অতঃপর মুসলমান নেতৃবৃন্দ ভারতেই বড়লাটের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদ্ভী প্রমুখ নেতাদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। প্রত্যুত্তরে তাঁদেরকে বলা হয় যে, মূল তুরস্কের ভূখন্ড ব্যতীত অন্যান্য এলাকা তাদেরকে দেয়া যাবে না।
ব্রিটিশের আচরণে ভারতের মুসলমান অতিশয় ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং খেলাফতের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে ভারতে প্রচণ্ড খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়। খেলাফত কমিটি গঠিত হয় এবং ভারতীয় কংগ্রেস, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দু এবং খেলাফত কমিটি সম্মিলিতভাবে এ আন্দোলন পরিচালনা করে। ১০ই আগস্ট সারা দেশে খেলাফত দিবস পালন করা হয় এবং এ সময় থেকে বিভিন্ন স্থানে হরতালও পালিত হতে থাকে। মোটকথা, সমগ্র ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ শুরু হয়। এক মাসের মধ্যেই প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলমান কারাবরণের জন্যে নিজেদেরকে পেশ করেন। শহরে-বন্দরে, হাটে-বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে খেলাফত আন্দোলন এক প্রচণ্ড রূপ ধারনা করে। কিন্তু এতো বড়ো আন্দোলন ও ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ-বিস্ফোরণ সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তার কারণ এই যে, কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের মুসলমানদের জেহাদী প্রেরণার সুযোগ গ্রহণ করে অসাধারণ বীরত্ব ও বিচক্ষণতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে বহু এলাকা ইংরেজদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধার করেন। তুরস্কবাসীদের একতাবদ্ধ করেন এবং তাদের হৃত মর্যাদা ও গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এভাবে ক্ষমতা হস্তগত করার পর কামাল আতাতুর্ক ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে উসমানিয়া খেলাফতের সুলতান মুহাম্মদ হাশেমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কাষ্টপুত্তলিসম সর্বশেষ সুলতান আবদুল মজীদকে দেশ থেকে বহিস্কার করে খেলাফতের উচ্ছেদ সাধন করেন।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?