বই : জল কুঠুরি
লেখক: মুশফিক উস সালেহীন
প্রচ্ছদ : জাওয়াদ উল আলম
প্রকাশনী: চিরকুট
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা
শুনেছি অতীতকে আঁকড়ে ধরা কোনো কাজের কথা নয়। অতীতকে পেছনে ফেলে বর্তমানকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যৎটা সুন্দর হয়। বাস্তবসম্মত কথা, সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, অতীতকে আঁকড়ে ধরে না থাকা হলেও, অতীতের গুরুত্ব নেই তা জোর দিয়ে বলা যায় কি আদতে? যতোই হোক, অতীতই তো গড়ে দেয় বর্তমানের মানুষটাকে!
জল কুঠুরি বর্তমানের আলোকে লেখা উপন্যাস। তবে ওইযে, অতীত বারবার এসে নাড়িয়ে দিয়েছে বর্তমানের ভিতকে। চরিত্রদের কেউ এখনো অতীতকে আঁকড়ে আছেন, কেউবা এগিয়ে গিয়েছেন অনেকটা। ১৬০ পৃষ্ঠার ছোটখাটো আকারের বই। ছোটবেলায় বই কেনার সময় বেছে বেছে মোটা বই কিনতাম, যাতে শেষ হতে সময় লাগে খানিকটা। সেই অভ্যাসই রয়ে গিয়েছে কিনা জানিনা, এখনও আকারে ছোট বইগুলো পড়া হয় কম। বা পড়া শুরু করলেও খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। তবে জল কুঠুরি এদিক থেকে আলাদা বলা যায়, মাত্র ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি বেশ সময় নিয়ে শেষ করেছি, বোধহয় তিন দিন। তাছাড়াও, শেষ করার পর এমন একটা রেশ রয়ে গিয়েছিলো, যেটা কাটাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না একদম৷ যেকারণে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসতে সময় পেরিয়ে গেলো আরো দু দিন। কতোটা গুছিয়ে লিখতে পারবো জানিনা, তবে চেষ্টা তো করাই যায়!
পটভূমি: সোজা ভাষায় বললে জল কুঠুরি বর্তমানের গল্প। উপন্যাসের চরিত্ররা বর্তমানে বাস করছেন, বর্তমানের দিন-পঞ্জিকার হিসেব মেলাচ্ছেন। আর পাঁচটা সামাজিক উপন্যাসের মতো এই বর্তমানেই গল্পটা শেষ হতে পারতো, তবে তাতে হয়তোবা গল্প শেষে পাঠকের ঘোরলাগা অনুভূতি না-ও আসতে পারতো। খুব হালকাভাবে অতীতের পাতা ওল্টানোর ভান করে লেখক গল্পের পটভূমি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ১৯৭১ কে। স্মৃতিচারণ আর গল্প বলার মিশেলে কখন উপন্যাসের পুরনো চরিত্রগুলো চলমান চরিত্রগুলোর সাথে এক হয়ে গিয়েছে, তা যতোক্ষণে পাঠক আবিষ্কার করেন ততোক্ষণে বইয়ের শেষপাতা চোখের সামনে চলে আসবে। এই পটভূমির জন্যই খুব সাধারণ চরিত্রগুলোর সাথে মিশে যেতে যেতে চরিত্রদের সাথে পাঠকও মুখোমুখি হয়েছেন অপ্রত্যাশিত কোনো সত্যির।
কাহিনি সংক্ষেপ: আমেরিকা প্রবাসী আরিফুর রহমান দেশে ফেরত আসেন চল্লিশ বছর পর। যখন তিনি দেশ ছাড়েন তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তিনি দেশে ফিরেছেন সম্পত্তির কিছু বিলিব্যবস্থা করতে, অন্তত তিনি তা ই ভেবে ফিরেছিলেন। কিন্তু আসলেই কি এটুকুতেই আটকে থাকতে পারবেন তিনি? কি এমন কারণ ছিলো যেটা চল্লিশ বছর আগে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে হাজার মাইল দূরে? এতো বছর পর কোন উত্তর খুঁজতে চান তিনি? প্রাক্তন ইংরেজি শিক্ষক করিম উল্লাহ মজুমদারের একাকীত্বের কারণ কি বা কে? রানু ফুফু কেন বদলে গিয়েছেন এতোটা? সব প্রশ্নের উত্তর কি মিলবে?
চরিত্র বিন্যাস: শুরুর দিকে চরিত্রগুলোর হিসেব রাখা খানিকটা কঠিন লাগতে পারে, তবে পরে সেটা ঠিকও হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় চরিত্র আরিফ সাহেব, তাকে ঘিরে থাকা চরিত্রগুলোর সংখ্যা একেবারে কম নয়। আরিফুর রহমান, হারুন, করিম উল্লাহ মজুমদার, রানু ফুফু, রিতা, কাদের শেখ, প্রতিটা চরিত্রই যার যার জায়গা থেকে ঠিক ছিলো। তবে পুরো বইয়ের প্রাণ বোধহয় ছুটি চরিত্রটি! ছুটি যেন সবরকম হিংসা, প্রতিবন্ধকতা, জটিলতা আর থমথমে আবহাওয়ার ফাঁক গলে এক চিলতে রোদ্দুর পুরো বইতে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া : সাধারণত যেটা হয়, সামাজিক উপন্যাসের প্রতি অধিকাংশ পাঠকেরই বাড়তি কোনো চাহিদা থাকে না। বাড়তি চাহিদা বলতে, পাতায় পাতায় থ্রিল বা প্লটে কোনো টুইস্ট, এসব ব্যাপার। জল কুঠুরির শুরুটা যেমন, আমি খুব সাদামাটা একটা গল্প কল্পনা করেই এগোচ্ছিলাম। সাদামাটা গল্পের ব্যাপারটা ভুলও না, একজন প্রবাসীর লম্বা সময় পর দেশে ফেরার মতো খুব সহজভাবে উপন্যাসের শুরু। শুরুতে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন অধ্যায়, চরিত্রগুলোর পরিচিতির জন্য যেটা দরকারও ছিলো। আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন অধ্যায় বা অপরিচিত চরিত্রগুলো একই বিন্দুতে মিলে গেলো, এই মিলে যাওয়ার ব্যাপারটা একটা পাজল মেলানোর চেয়ে কোনো অংশে কম না! তো যেটা বলছিলাম, সহজ গল্পটাই কিভাবে যেন প্রশ্নের পর প্রশ্নের জন্ম দিতে শুরু করলো, আর সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাঠকও উন্মুখ হয়ে আগাতে থাকলো সামনের দিকে, প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে হিসেব মিলতে মিলতেই বইয়ের শেষপাতা চোখের সামনে! মানে অদ্ভুত সুন্দর একটা সময় কেটেছে বইটার সাথে। মাত্র ১৬০ পৃষ্ঠার মাঝে এতোবার অনুভূতির ওঠানামা হয়েছে, যেটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিলো। অধিকাংশ চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো নিঁখুতভাবে ফুটে উঠেছে। সহজ গল্পের ফাঁকে প্রশ্নগুলো যেভাবে জন্মেছে, উত্তরগুলোও পৃষ্ঠার সাথে তাল মিলিয়ে যথাসময়ে সামনে এসেছে। আর সবশেষে যে চমকটা, সেটা আমি অন্তত আশা করিনি! শহরে বড় হয়েছি, গ্রামকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার কম। তারপরও, বইয়ের বন্যার বিবরণটা এতোটা জীবন্ত লেগেছে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। ‘৭১ এর যোদ্ধারা আজীবনই যোদ্ধা, তাই হয়তো এই শেষবয়সে এসেও দারিদ্র্যের সাথে তাদের যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে, আর সুবিধাবাদী শ্রেণী বরাবরই সুবিধা আদায় করে সমাজের উপরের স্তরেই থেকে যায়, এই কঠিন সত্যিটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে বইতে। তাছাড়া কিছু উক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বই জুড়ে, যেগুলো সত্যিই মনে দাগ কেটে যাওয়া মতো।
লেখনী: মুশফিক উস সালেহীনকে চিনতাম থ্রিলার লেখক হিসেবে। লেখকের কোনো বই এর আগে পড়া না হলেও থ্রিলার বইসংক্রান্ত গ্রুপগুলো থেকেই নাম চেনা। লেখকের ‘কাকতাড়ুয়া’ বইটা বছর খানেকেরও কিছু বেশি সময় ধরে সংগ্রহে থাকলেও যেকোনো কারণেই হোক এখন পর্যন্ত শুরু করে ওঠা হয়নি, যে কারণে ‘জল কুঠুরি’ দিয়েই লেখকের লেখার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। সত্যি বলতে বই শুরু করার আগে একটা ব্যাপার মনে হয়েছেই, যে একজন থ্রিলার লেখকের হাতে সামাজিক উপন্যাস কতোটুকু ফুটে উঠবে! তবে বই শেষে এইপ্রশ্ন আর দ্বিতীয়বার মনে আসেনি। পড়তে গিয়ে একবারও মনে হয়নি এটা লেখকের প্রথম সামাজিক উপন্যাস, বরং মনে হয়েছে তিনি এরকমভাবেই লিখে অভ্যস্ত। গাঁথুনি, সাবলীলতা, কাহিনি বিন্যাস, সবটা মিলে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে বইটি।
অসামঞ্জস্যতা : তেমন কোনো খারাপ লাগা চোখে পড়েনি সত্যি বলতে। তবে একটা জিনিস মনে হয়েছে, চল্লিশ বছর পর জন্মস্থানে ফেরত এসে আরিফ সাহেবের চোখে এলাকার পরিবর্তনগুলো আরেকটু মোটাদাগে দেখানো যেতো কিনা। এই যেমন, আগেকার কাঁচা রাস্তার বদলে এখনকার পিচঢালা রাস্তা, আশেপাশের বাড়িগুলোর রূপবদল বা সবুজ কমে যাওয়া। বলতে চাইছি, চল্লিশ বছরের মতো এতো লম্বা একটা সময়ে অনেক বড় কিছু পরিবর্তন আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক ! সেই পরিবর্তনগুলো আরিফ সাহেবের চোখে পড়েছে কিনা সেটার উল্লেখ থাকলে বোধহয় আরো ভালো লাগতো৷ যখন তিনি হারুনের সাথে পোড়া সরকার বাড়ির জায়গায় দাঁড়ানো এতিমখানা দেখতে যান, সেখানেও অতীতে বাড়িটা দেখতে কেমন ছিলো তার একটা ফ্ল্যাশব্যাক আশা করেছিলাম, যেহেতু বইয়ের অনেকটাই স্মৃতিচারণের আদলে লেখা। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে মাথায়, যেটা হলো, একজন মানুষ যিনি এতো লম্বা সময় শেকড়কে ভুলে ভিনদেশি জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তিনি তো স্বার্থপর ধাঁচের মানুষ হওয়া উচিত। তাহলে এতোগুলো বছর পর দেশে ফিরে অতীত কিংবা অতীতের মানুষগুলোকে নিয়ে তার এতো আগ্রহের কারণ কি! যদি সত্যিই অতীতের মানুষগুলোর প্রতি এতোটা টান তার মনে অবশিষ্ট থাকতো, তিনি কি পারতেননা আরো আগে একবারের জন্য হলেও ফিরতে? যতোটা আকুলতা নিয়ে তিনি অতীতকে খুঁজেছেন, ততোটা আকুলতা মনে চেপে সত্যিই কি চল্লিশটা বছর দূরদেশে পার করা সম্ভব? পুরো উপন্যাসে এটুকুই আমার কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ছিলো, জানিনা অন্য পাঠকদের মনে এই প্রশ্ন এসেছে কিনা।
নামকরণ , প্রচ্ছদ, সম্পাদনা: ভেজা মাটির একটা ঘ্রাণ আছে, আমার অদ্ভুত সুন্দর লাগে। নামকরণ কতোটা ঠিকঠাক তা বলতে পারি না, তবে উপন্যাসের বৃষ্টির অংশগুলো পড়তে গিয়ে ওই ভেজা মাটির ঘ্রাণটাই পাচ্ছিলাম এমনটা মনে হচ্ছিলো। বৃষ্টি হোক বা বন্যা, বইয়ের বড় একটা অংশ জুড়ে জল ছিলো। তাই সাদা চোখে জল কুঠুরি নামটা বইয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে যদি বইয়ের আগাগোড়া কাহিনির সাথে মেলাতে যাই, তাহলে সেক্ষেত্রে তেমনভাবে কাহিনি আর নামকরণ মেলাতে পারিনি। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত। তবে প্রচ্ছদের সাথে নামকরণ মানিয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়। প্রচ্ছদ, নামকরণ আর গল্প, তিনটিকে একশব্দে বলতে বললে আমি বলবো, “স্নিগ্ধ”। এরবেশি আর কিছু হয়তো না বললেও চলবে!
সম্পাদনার ব্যাপারে বলতে গেলে, ছোটখাটো বানান ভুল ছিলো, তবে বড় তেমন কোনো ভুল চোখে পড়েনি। বাঁধাই ঠিকঠাক ছিলো, বই জোর করে টেনে ধরে রাখতে হয়নি, অবশ্য জোর করে ধরে রাখা মতো বড় আকারও না বইয়ের। সব মিলে খারাপ লাগা মতো বড় কোনো কারণ পাইনি, ভালো লেগেছে।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?