বই কলকাতা – লেখক শ্রীপান্থ | Boi Kolkata

প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে আমরা কয়েকজন মিলে পাঠ্যচক্র করি। আড্ডা হয়। চা খাওয়া হয়। বই আর সাহিত্য যে আড্ডার বিষয়। এই মাসের শুরুতে এক দাদার হাতে নতুন মলাটের একটা বই দেখেই হাতে নিই। বইটির নাম ‘কলকাতা’ আর লেখক ‘শ্রীপান্থ’। বইয়ের নাম নতুন হলেও লেখক আমার কাছে নতুন নয়। শ্রীপান্থের লেখা ‘ঠগী’ বই পড়ে হরর মুভি দেখার চাইতে বেশি ভয় পেয়েছি। সুতরাং কলকাতাও ছাড়া যাবে না। দাদার হাত থেকে বইটা নিয়ে নিলাম। “দাদা, বইটা নিলাম। তবে কবে শেষ করবো বলতে পারছি না।” 
এপ্রিলের এক তারিখ থেকে পড়া শুরু ১৭ তারিখে শেষ। পুরো বইটা আমাকে এক জাদু মোহে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিলো। 

বইয়ের পরিচিতি

  • বইয়ের নামঃ কলকাতা
  • লেখকঃ শ্রীপান্থ
  • প্রকাশনীঃ আনন্দ
  • প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর,১৯৯৯ 
  • দ্বাদশ মুদ্রনঃ মার্চ, ২০২১
  • মূল্যঃ ৭৯৫ টাকা 
  • পৃষ্ঠাঃ ৫৬২
  • প্রচ্ছদঃ কৃঞ্চেন্দু চাকী 

লেখক পরিচিতি

জন্মঃ ১৯৩২ সালে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। 
লেখাপড়াঃ ময়মনসিংহ ও কলকাতায় 
কর্মজীবনঃ সাংবাদিক হিসেবে আনন্দ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত ছিলেন। 
সাহিত্যিক জীবনঃ গবেষণা মুলক রচনা, কলকাতার সমাজ ও সংস্কৃতি ছিলো তার চর্চার বিষয়। 
গ্রন্থসমূহঃ সতীদাহ, দেবদাসী, ঠগী, হারেম, যখন ছাপখানা এলো, মোহন্ত এলোকেশী সন্মাদ, কেয়াবাৎ মেয়ে, মেটিয়াবুরুজের নবাব, বটতলা, ক্রীতদাস। 
সর্বশেষ বইঃ কলকাতা 
পুরস্কারঃ ১৯৭৮ সালে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হোন 
মৃত্যুঃ ১৭ ই অগাস্ট, ২০০৪ 
সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ 
“কলকাতার নাম কলকাতা না হয়ে বোম্বাই, ডোভার বা হংকং হল না কেন?”- বইয়ের শুরুতেই এই মিসেস হোয়াই-এর এই প্রশ্ন শুনেই মিস্টার বিকজ এর মতো যে কোনো পাঠকের মনেই প্রশ্নটা আসবে যে,”আসলেই তো কলকাতার নাম কলকাতা হলো কেন? অন্য কিছু নয় কেন?” প্রশ্ন শুনে মিস্টার বিকজও একটু হকচকিয়ে গেলেন। তবে পুরোপুরি নয়। তিনি ছুটে গেলেন ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে। 
কলকাতা নামটির সাথে মিশে আছে এক মায়া, এক জাদু। কলকাতা এক মুগ্ধকর শহর। বলা যায়, রহস্যময়ী, রোমাঞ্চকর শহর। 
এই কলকাতা সেই কলকাতা নয়। সেই কলকাতা হলো ইংরেজ সাহেবদের কলকাতা। ইংরেজরা এই শহরে এসে নিজেদের বসতি স্থাপন, কুঠি স্থাপন থেকে শুরু করে নিজেদের এখানে নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সবই এই বইতে রয়েছে। 
বইটির প্রতিটি পাতায়, লাইনে রয়েছে কলকাতার প্রাচীন ইতিহাস। মনে হয়, সেই পথে,সেই কালে ,আমি নিজেও কলকাতার পথে হেঁটে চলেছি। মাঝে মাঝে বিভোর ভাব থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। 
আগেই বলেছি, এই কলকাতা আর সেই কলকাতা এক নয়। সেই কলকাতা ছিলো ইংরেজ সাহেবদের কলকাতা। সাহেবরা এই দেশে এসেছিলো কেউ ব্যবসা করতে আবার কেউ এসেছিলো ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে সরাসরি নিয়োগ পেয়ে। কেউ এসেছেন গভর্নর হয়ে, কেউ জেনারেল, কেউবা সাধারণ চাকরি নিয়ে। 
কলকাতার ইতিহাসের সাথে জড়িত আছে প্রায় শ’ খানেক ইংরেজ সাহেবের গল্প। যাদের অনেকেই কলকাতার মাটিতে শায়িত আছেন। জড়িত আছে তাদের প্রেম কাহিনী। কেউ হয়তো বাঙ্গালী নারীকে বিয়ে করেছেন, আবার বাঙ্গালী হয়তো ইংরেজকে। 
কলকাতার পথের ইতিহাসও কম নয়। যেমন ফ্যান্সি রোডের নামের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক ফাঁসির কাহিনী। শুধু কী ফ্যান্সি রোড? কলকাতার প্রতিটি রাস্তার নামের আড়ালে রয়েছে নানা ধরণের রোমাঞ্চকর কাহিনী ও গল্প। তেমনি চৌরঙ্গী রোড, সার্কুলার রোড, থিয়েটার রোড, বটতলা, নিমতলা, বাঁশতলা, তালতলা, মির্জা গালিব স্ট্রিট, ডেকার্স লেন, কিড স্ট্রিট, প্যারীচরণ সরকার স্ট্রিট, জানবাজার রোড ইত্যাদি। এছাড়া বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামেও রাস্তা রয়েছে যেমন – গান্ধী বা নেহেরু, হো-চি-মিন, মার্কস। আরো আছে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নামেও রাস্তার নামের ছড়াছড়ি। যেমন- বাল্মীকি, কৃত্তিবাস, শেকসপিয়র, ইকবাল, গিরিশ ঘোষ, ভোলা ময়রা, দানীবাবু, শিশির ভাদুড়ি সহ প্রায় ৪০ টির বেশি রাস্তার নামকরণের ইতিহাস লেখক এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। রাস্তার বর্ণনা পড়ার সময় মনে হবে আপনি নিজেই বুঝি সেই রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। 
ব্ল্যাক টাউন আর ব্ল্যাক জমিদার, চিনেপাড়ায় গৃহযুদ্ধ, প্রাচ্যবিদ্যার পীঠস্থান,রাইটার, মূর্তি চোর প্রভৃতি শিরোনাম দিয়ে লেখ কলকাতার ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসকে তুলে এনেছেন পাঠকদের সামনে। 
কলকাতার প্রথম নাট্যশালা তৈরিতে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন লেবেদেফ। কে এই লেবেদেফ? লেভেদেফ হলেন কলকাতায় আসা প্রথম রুশ নাগরিক। যিনি কলকাতায় এসেছিলেন ১৭৮৫ সালের ১৫ ই অগাস্ট। তিনি কলকাতায় এসে পূর্ব-ভারতীয় ভাষা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এরপর তিনি বাংলা ভাষা শিখেন এবং দুটো ইংরেজী বইকে বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর বাংলার প্রথম নাট্যশালায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করা হলো। 
আশ্চর্য সব গল্প ও কাহিনী নিয়ে কলকাতা বইটি লেখা হয়েছে। তবে গল্প হলেও সত্যি যে, একসময় এই কলকাতায় মাদাম গ্রান্ড নামের কোনো এক রূপসী ইংরেজ ম্যাম ছিলেন। তারই প্রেম কাহিনী অমর এক কাহিনী। 
কেমন ছিলো সেই কলকাতার যানবাহন? এই পর্বে লেখক ছোট্ট আলোচনার মাধ্যমে কলকাতায় পালকি, ঘোড়ার গাড়ি, বাষ্পচালিত ট্রাম, রিকশা, রেল,  স্টিমারের আগমন ও প্রচলন নিয়ে আলোচনা   করেছেন। পালকির বেহারাদের জন্য যখন নিয়ম বেধে দিলো ইংরেজরা, তখন বেহারারা এক হয়ে ধর্মঘট ডাকলেন। আর এই ধর্মঘটই হলো কলকাতার প্রথম ধর্মঘট। 
সেই কলকাতার বিয়ের অনুষ্ঠান কিভাবে হতো? কালীঘাটের বিয়ে নামক এই অনুচ্ছেদে জানতে   পারবেন সেই কালে বিয়ের কথা। এগারো টাকা দিয়ে সমাপ্ত একটা বিয়ের কথা লেখক নিজেই লিখেছেন। মাত্র দশ মিনিট লেগেছিলো বিয়েটা সম্পন্ন হতে।   এছাড়া চার্চেও বিয়ে হতো। রবিবারে সবাই সেজেগুজে আসতো। একদিকে মেয়েরা আর অন্যদিকে ছেলেরা। কে আগে কোন মেয়ের হাত ধরবে তাই নিয়ে হতো প্রতিযোগীতা।
 অসাধারণ সব গল্প আর কাহিনীতে উঠে এসেছে কলকাতার ইতিহাস। এই বই নিয়ে সংক্ষেপে রিভিউ লিখতে গেলেও ২-৩ হাজার শব্দ লেখা যাবে। লেখাটা যেহেতু বড় করবো না তাই আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পরে গেছে। সেগুলো নিয়ে পরে লেখা যাবে। 
 এতো এতো গল্প। সাহেবদের গল্প, ম্যাম সাহেবদের গল্প, ইংরেজ গভর্নরের শাসনের গল্প, বাঙ্গালী জমিদার, নায়েব, নবাব, ও রাজাদের গল্প, দোভাষীদের গল্প, রানাঘরের গল্প, মাছের গল্প, বাজারের গল্প আরো কত গল্প!! আসলে এগুলো গল্প নয়। এই গল্প গুলোই হলো কলকাতার প্রকৃত ইতিহাস। সাহেবদের ইতিহাস। 
কলকাতা বইটার প্রতিটি তথ্যই নেওয়া হয়েছে সেই সময়ের পত্রিকা, ম্যাগাজিন, দলিল-দস্তাবেজ, ইংরেজদের ডায়রি, ইংরেজদের লেখা বই ও   এশিয়াটিক সোসাইটি সহ ভারত ও ব্রিটিশদের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে। 
আজ বেশি কিছু বলবো না। বইটা নিয়ে আরো লেখার ইচ্ছে আছে। 
ছোট্ট এই অসমাপ্ত রিভিউ ভালো লাগলে সামাজিক কাজে লেগে পড়ুন। লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?