Post ID 1114534
বই : একাত্তরের সাবিহা
লেখক: মোঃরেজাউল করিম
প্রকাশনী: জলধি
প্রচ্ছদ: কাব্য করিম
“একাত্তরের সাবিহা” মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে একজন মেয়ের অসম সাহসিকতার কাহিনী।
আমি এই পর্যন্ত যতগুলো মুক্তিযুদ্ধের উপর বই পড়েছি তাতে অধিকাংশই পাকবাহিনীর নির্মমতা, মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলি আক্রমণ এবং নির্যাতিত মানুষের বিবরন পড়েছি। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ছবি মানেই পুরো দেশ রক্তের মাঝে ডুবে ছিল এমন একটা ছবি ভাসে চোখের সামনে। কিন্তু “একাত্তরের সাবিহা” পড়ে এই ধারণা অনেকটায় পাল্টে গেল। ঐ অস্থির সময়েও মানুষের পারিবারিক জীবন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থেকেও স্বাভাবিক ভাবে অনেকে চলার চেষ্টা করেছে তেমন ছবিও দেখা যায়।
কাহিনী সংক্ষেপ: সাবিহা ১৯৭১সালে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যিনি ২৫শে মার্চে রোকেয়া হলে ছিলেন। তখন এটাই ছিল একমাত্র মেয়েদের হল। পাক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে তিনি সহ আরও পাঁচ ছয়টা মেয়ে হলের প্রভোস্ট ম্যাডামের বাসার স্টোররুমে লুকিয়ে পড়েন। কারণ আগে থেকেই তারা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। ভাগ্যক্রমে ধরা পড়েন না। এদিক ওদিক করে ফিরে আসেন নিজের বাড়ি কুষ্টিয়া।
এখানে এসে পড়েন আর এক বিপদে। রাজাকারের সাহায্যে কুষ্টিয়ার পাকবাহিনীর ক্যাম্পে সাবিহাকে চাকরি করতে খানিকটা বাধ্য করে পাকবাহিনী। কারণ তাদের দরকার বাংলা এবং উর্দু ভাষা ভালো ভাবে জানা কাউকে। এবং সাবিহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দুতে অনার্স করার কারণে এই দুটো ভাষায় ভালো ভাবে জানতেন। দেশের মানুষকে যারা নির্বিচারে মারছে তাদের কাছে চাকরি করতে মন সায় দেয় না। কিন্তু বাবা-মা ছোট ভাইয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হয়। এবং এটাকে তিনি অন্যরকম কাজে লাগান। ক্যাম্পে আর্মিদের কাছ থেকে নানা তথ্য জেনে তা খুব গোপনে জানিয়ে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
খুবই রিস্ক ছিল কাজে। উনি জানতেন ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত। তবে তার আগে যে অত্যাচার সহ্য করতে হবে তা অকল্পনীয়। তবুও তিনি তার কাজ করে গেছেন সবকিছুর ঝুঁকি নিয়ে।
ডিসেম্বর পর্যন্তও তিনি ধরা পড়েননি। বরং ক্যাম্পের অফিসারদের মুখ দেখে এবং তাদের কথা শুনে বুঝতে পারছিলেন বাংলাদেশের বিজয় আসতে খুব দেরি নেই। অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল অনেক। ঠিক সেই সময় ধরা পড়লেন তিনি। শারীরিক নির্যাতন করে ওরা। সাবিহা স্বীকার করেন তিনি তথ্য পাচার করেছেন কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম বলেন না। তবে দুজন পাক অফিসার সাবিহাকে খুব ভালো জানতো। সাবিহা গুপ্তচরের কাজ করেছেন জেনে রাগে ফেটে পড়ে তারা। তবে সাবিহার উপর যেন পাশবিক নির্যাতন না হয় সেটা দেখেছে। তবে ভাগ্য ভালো কুষ্টিয়া শত্রু মুক্ত হয় তাড়াতাড়ি। সাবিহা পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
“একাত্তরের সাবিহা” আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন দলিল। যেখানে কুষ্টিয়া অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের কথা সুচারুভাবে উঠে এসেছে। এসেছে সাহসী বিরাঙ্গনা মেয়ের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন মানুষের কাছে যেমন বোধ আশা করি আমরা ঠিক তেমন একজন মানুষের কথা এটা। তিনি শুধু মেয়ে না পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দেশকে ভালোবেসেন। যার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
এমন সাহসী একটা চরিত্র নিয়ে একাত্তরের সালের উত্তাল সময়কে খুব ভালো ভাবে লেখক তুলে এনেছেন। সময়, ঘটনা, গুপ্তচরবৃত্তি, চেকিং এর সময় জোরালো ভাবে নিজের বক্তব্য জানানো সব কিছুই খুব গোছানো হয়েছে। কুষ্টিয়ার মানুষের মুখের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি। বোঝায় যাচ্ছে লেখক রেজাউল করিম এই উপন্যাস লেখার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। দুই একটা জিনিস একটু অন্যরকম লেগেছে তা হলো সাবিহা কে এক জায়গায় চেকিং এর সময় জিগ্যেস করছে তিনি কোথায় গিয়েছিলেন। উনি উত্তরে বলছেন,মেয়েলি জিনিস কিনতে গিয়েছিলেন। তবুও জেরা করলে বলছেন,স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গিয়েছিলেন।
আমি শিওর না, তবুও আমার ধারণা ঐ সময় স্যানিটারী ন্যাপকিন বাজারজাত হতো না।
যাইহোক এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু না। অতীত নিয়ে লিখতে গেলে মাঝেমধ্যে বর্তমানের কিছু চলে আসতে পারে।
আর এই লেখায় সবথেকে কষ্ট লেগেছে সাবিহার নারিত্ব নিয়ে যেন আশপাশের মানুষ প্রশ্ন তোলে। সাহসী সাবিহা পাক হানাদারদের কাছে মাথা নত করেননি। কিন্তু কটু কথার কাছে মিইয়ে যান। স্বাধীন দেশে তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি তা নিয়েও মন খারাপ করেননি। কিছু পাওয়ার আশায় যে তিনি যুদ্ধ করেননি তা স্পস্ট করেছেন। কিন্তু বাঁকা চাহনি থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাতে কুষ্টিয়া থেকে পরিবারকে ঢাকায় সরিয়ে নিয়ে একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছেন। যা মনের গহীনে কোথায় যেন কষ্টের আগুন ধরিয়ে দেয়।
“একাত্তরের সাবিহা” এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পড়া উচিত। আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সন্তানদের আত্মত্যাগের কাহিনী জানা দরকার। যা খুব সুন্দর করে লিখেছেন রেজাউল করিম স্যার।
মোঃ রেজাউল করিম স্যার এবং “একাত্তরের সাবিহা” এর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?