বই : আশিয়ানী লেখক : জুলিয়ান – রিভিউ | Ashiyani : Julian Book Review

বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্য জগতে ফ্যান্টাসির কাজ তেমন একটা হয়নি। যা হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। আশরাফুল সুমন ভাইয়ের লিখা কিছু বই ছাড়া বাংলা মৌলিক ফ্যান্টাসির সাথে আমি তেমন একটা পরিচিত ছিলাম না। তবে এই বছর ফ্যান্টাসির উপর বেশ কিছু কাজ হয়েছে যার মধ্যে আমীনুল ইসলামের যুদ্ধের সহস্র বছর পর, কাফি আল নয়নের রাজকীয় উৎসর্গ, সুজানা আবেদিন সোনালির মিরিয়া- যোদ্ধাকুমারির সন্ধানে অন্যতম।

  • বই : আশিয়ানী
  • লেখক : জুলিয়ান
  • প্রচ্ছদ :জুলিয়ান
  • প্রকাশনি : চিরকুট প্রকাশনি
  • মূল্য : ৮০০ টাকা
  • রেটিং : ৪.৭/৫
  • Category : রহস্য, গোয়েন্দা, ভৌতিক, মিথ, থ্রিলার, ও অ্যাডভেঞ্চার: অনুবাদ
  • Edition 1st Published, 2022
  • Number of Pages 656
তবে যে বইটার জন্য সবচেয়ে বেশি মুখিয়ে ছিলাম, সেটা ছিল রিয়াজুল ইসলাম জুলিয়ান ভাই এর আশিয়ানী। এর কারণ ছাপার অক্ষরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কলেবরের ফ্যান্টাসি বই হল এটা। এর আগে এত বড় মৌলিক আধুনিক ফ্যান্টাসি কেউ বাংলায় লিখেছে বলে আমার মনে পড়ে না। তাই হাতে পাওয়ার পরে বেশিদিন দেরি না করে শেষ করে ফেললাম। বইটা এতটাই ভাল লেগেছে যে একটা বড়সড় রিভিউ না লিখলে খানিকটা অস্বস্তি বা অসম্পূর্ণতা কাজ করছিল।

আমাদের ভাষায় একটা কথা আছে, আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারি। তো দর্শনধারীর খাতায় আশিয়ানী বইটা একেবারে অনার্স মার্ক পেয়ে উতড়ে গেছে। পেজ কোয়ালিটি, বাইন্ডিং, কভার, ইলাস্ট্রেশন সবকিছু এককথায় অসাধারণ। এত সুন্দর বই এত কম দামে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বৈকি। যাক, সেকথায় আর বেশি না যাই। এবার কথা বলি অন্তঃপুরের বিষয়বস্তু নিয়ে।

আশিয়ানী এমন একটা উপন্যাস যাকে আসলে একটা গল্প বললে ভুল হবে। বরং একে পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা দুই কাহিনীর সমষ্টি বলাটাকে আমি অধিক সমীচিন মনে করি। যে গল্পের শুরুটা মৃদুমন্দ এবং শান্ত হলেও লেখকের সাবলীল বর্ণনাভঙ্গির জন্য তা কখনোই বিরক্তিকর বলে মনে হয়নি। উলটো কখন যে পাতার পর পাতা উল্টে চলে গেছি টেরও পাইনি।

গল্পের কাহিনি শুরু হয় সেভিদোনিয়া নামের এক কল্পরাজ্যের রাজকন্যার অজানাকে জানার অদম্য বাসনাকে চরিতার্থ করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা উন্মুক্ত করে দেয় নতুন এক পরিস্থিতির যা রাজকুমারি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। এক এডভেঞ্চার এর দুনিয়ায় তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন যার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। এর থেকে বেশি বললে বড়সড় স্পয়লার হয়ে যাবে তাই ওদিকে আর আগালাম না। তাই লেখকের সাথে সুর মিলিয়ে বলি, বইয়ের উপর আগেই এক্সপেকটেশন না রেখে বরং উপভোগ করুন জার্নিটাকে । Journey before destination, life before death.

এবার আসা যাক, আশিয়ানীর সবচাইতে পছন্দের দিক আমার দৃষ্টিতে। এর চরিত্রায়ন ও ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং। চরিত্রায়নের মুন্সীয়ানার জন্য লেখক নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। গল্পের প্রধান চরিত্র রাজকুমারি আশিয়ানী, তার পিতা রাজা আরসালান, রানী জেহেনিয়া, প্রধান সেনাধ্যক্ষ আরহাম মেনদার ছাড়াও আশিয়ানীর বান্ধবীকুল অন্যান্য ছোটখাট চরিত্র গুলোও অসাধারণ হয়েছে। আর রাজকুমারি আশিয়ানীর চরিত্রায়ন এর যে দিক সবচেয়ে বেশি পছন্দ তা আশিয়ানীর সাহস, দৃঢ়তা কোনটাই নয় বরং তার কর্মের ফলশ্রুতিতে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে বা অনিষ্ট হয় তবে সেই ভুল স্বীকার করে সমস্যার সমাধান করতে চাওয়ার যে স্পৃহা, এটা অনেক ফ্যান্টাসি চরিত্রে কমবেশি থাকলেও আশিয়ানীর সংলাপ, মনোভাব, চিন্তাধারা তার চরিত্রকে অনেকটাই বাস্তবতার প্রতিফলনে রূপান্তরিত করেছে।

যাই হোক, ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ও যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার। একটা কথা আছে সাহিত্যে- show, don’t tell. এই কাজটাই করে দেখিয়েছেন লেখক। ভূগোল বই এর মত এত একগাদা তথ্য তুলে না দিয়ে ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে সেভিদোনিয়া লেখক চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একঘেয়ে তথ্যকণিকার বদলে ক্রমপরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সেভিদোনিয়ার নগর, গ্রাম, নদী, দুর্গ, বন্দর, পর্বতমালা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের কাজই বটে।

আর এত প্রশংসার পরেও বইটা নিয়ে সামান্য অভিযোগ আছে তা আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত। আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্রকে মেরে ফেলা হয় শেষাংকে। আর আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত চরিত্র শুধু বেঁচেই থাকে না তার উদ্দেশ্য সে আংশিক সফল করতেও সক্ষম হয়। গল্পের ক্লাইমেক্স এর গ্রন্থিমোচন প্রক্রিয়াটাও আমার তেমন পছন্দ হয় নাই৷ তবে সমাপিকা যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে। অধিকাংশ পাঠকের কাছেই তা পছন্দ হবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ সমস্ত প্লট পয়েন্ট এত সুন্দরভাবে শেষে এসে মিলিয়ে দিয়েছেন যে আমারও মনে হয় এডিটর সুমন ভাই এর মত বলি, ‘ভাই, কেমনে মিলাইলা?’

শেষ করি একটা কথা দিয়ে। এই বই সকলের জন্য না। মাইকেল বে আর মার্টিন স্করসেজি পুরো দুই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাতা। একজন ধুমধারাক্কা একশন, আরেকজন ড্রামা, সাস্পেন্স এর কাজে দক্ষ। ঠিক তেমনিভাবে এই বইয়ে একইভাবে কেউ যদি মুহুর্মুহু থ্রিল, একশন খুঁজতে চান তবে হতাশ হবেন। কিন্তু কেউ যদি চান একটু শান্ত মেজাজের কাহিনি, হালকা হাসিঠাট্টা, রাজনীতির মারপ্যাঁচ, বন্ধুত্বের নির্মলতা, সমাজের বাস্তব চিত্র আর এক শান্ত সৌম্য এডভেঞ্চার যার পরতে পরতে আছে নাটকীয়তা। তবে এই বই তাদের জন্য।

অবশ্য একশন, যুদ্ধ, রোমঞ্চ যে নেই তা কিন্তু নয়। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। গলধঃকরন না করে আস্তে ধীরে বইটিকে উপলব্ধি করুন তখন শেষ পাতাটি উলটানোর পর আপনার অন্তর হয়তো এক অব্যক্ত শূণ্যতায় ভরে যাবে। মনে হবে কেন কাহিনি এখানেই থেমে গেল। ইশ! যদি আর কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম সেভিদোনিয়ায়। আশিয়ানীর সাথে ঘুরে বেড়াতাম সেই কল্পরাজ্যের মাঠে প্রান্তরে। আর এই অব্যক্ত শূণ্যতার অনুভূতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আশিয়ানীর সার্থকতা।

তাই সাহস করে বইপ্রেমিরা পড়ে ফেলতে পারেন আশিয়ানী। মুহূর্তে হারিয়ে যাবেন এক অজানা দুনিয়ায়। একঘেয়ে এই দুনিয়ায় এক চিলতে মুক্তির স্বাদ আপনাকে দিতে পারবে জুলিয়ান ভাইয়ের লেখা বইটি। এটুকু আমার দৃঢ় বিশ্বাস!

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?