Post ID 111480
📚 বই : ওপারে
📚 লেখিকা : রেহনুমা বিনতে আনিস
📚 প্রকাশক : সিয়ান পাবলিকেশন
📚 মুদ্রিত মূল্য : ২০০/-
📚 পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১২০
💐 লেখিকার পরিচয় :
লেখিকার জন্ম চট্টগ্রামে, শৈশব ঢাকায়, কৈশোর আবুধাবি ও ভারতে । বর্তমানে স্বামী ও দুই সন্তানসহ ক্যানাডায়। আদর্শবাদী ও জ্ঞানানুরাগী একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা। মাস্টার্সের পর ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অনেক দিনের।
লেখিকার অত্যধিক আগ্রহের ফলে জ্ঞানের মোটামুটি সব শাখাতেই তার অল্পবিস্তর বিচরণ রয়েছে। তিনি প্রথম পরিচিতি লাভ করেন নয় বছর বয়সে, জুনিয়র নিউজে ও আবুধাবির ইয়াং টাইমসে নির্বাচিত লেখিকা হিসেবে। পরবর্তীতে দেশে ফিরে লেখালেখি শুরু। এরপর বৃহত্তর অঙ্গনে পদচারণা।
📕 বই রিভিউ :
মৃত্যু আমাদের জীবনের এক চিরন্তন বাস্তব সত্য, মৃত্যু আসবেই। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা বেমালুম ভুলে থাকি যে, আমাদের সবার জীবনে এক না এক দিন মৃত্যু আসবেই।মৃত্যুর যন্ত্রণা যে কত ভয়ংকর তা মৃত্যু আসলেই টের পাওয়া যাবে। এপার থেকে যদি নেক আমল না নিয়ে যেতে পারি ওপার সত্যিই আমাদের জন্য অনেক ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে রবের নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং প্রতিপালকের হুকুম মেনে চলার মাঝেই রয়েছে আখিরাতে মুক্তি পাওয়ার উপায়।
ওপারে বইটি বার বার আমাদের চরম সত্য মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিবে। বইটির প্রতিটি খন্ডে মৃত্যুর কথা পাঠকদের চরমভাবে ভাবিয়ে তুলবে বাস্তবতাকে মেনে নিতে। ক্ষণস্থায়ী এপারে আমরা কি নিয়ে মেতে আছি, চিরস্থায়ী ওপারের জন্য আমরা কি প্রস্তুতি নিচ্ছি তা এই বইটি পড়লে সহজেই অনুমেয় হবে।
বইটি মোট ২৭ খন্ডে বিভক্ত। প্রতিটি খন্ডে আপনি একেক রকম মৃত্যুর বর্ণনা পড়বেন আর ভাববেন সেই মৃত্যুর চিএগুলি আপনার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভাসছে। সেই সাথে আপনার চোখের পানি কখন যে টুপটুপ করে পড়ে বইয়ের পাতা ভিজে যাবে টেরই পাবেন না। প্রতিটি মৃত্যুর বর্ণনা আপনার হৃদয়ে ভীষণ কষ্টের অনুভূতি যোগাবে। বইটিতে কিছু মৃত্যু শিক্ষণীয়, কিছু মৃত্যু বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়া,কিছু মৃত্যু খুবই বেদনা দায়ক, কিছু মৃত্যু শান্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এক মুহূর্তের ভরসা নেই এ জীবনে আমরা মৃত্যুর সামনে যে কত অসহায় তা এই বইটি বার বার আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে।
📌 বইটি থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি যা বইটি পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে—
💎🎈🕊️ আমরা যাকে ভালবাসি তাকে কতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চাই, সে আমাকে ভালবাসে কিনা, বাসলে সে ভালোবাসার গভীরতা কতখানি! তাহলে আমার প্রভু যদি ঝালাই করে নিতে চান আমরা আসলেই তাঁকে ভালবাসি কি না, বাসলে আমরা ভালবাসার পরীক্ষায় উওীর্ণ হতে প্রস্তুত কি না, তবে কি সেটা যুক্তিসংগত নয়??? অথচ আমরা কোন কাজ নিজের পছন্দ মতো না হলে, কোন কিছু চেয়ে না পেলে অল্পতেই হতাশ হয়ে যাই। দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা আনহু কিন্তু আমাদের পরীক্ষায় ফেলার অগেই উওীর্ণ হবার পথ বাতলে দিয়েছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা আনহু আল-কুরআনের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন —
“ আমি পৃথিবীর সবকিছুকে পৃথিবীর জন্যে শোভা করেছি, যার মাধ্যমে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে। এবং পৃথিবীর ওপর যা কিছু রয়েছে, অবশ্যই তা আমি উদ্ভিদশূণ্য মাটিতে পরিণত করে দেব।“
(কুরআন, ১৮: ৭-৮)
অথচ আমরা পরীক্ষার হলে খেলতামাশা করেই সময় নষ্ট করে ফেলি, কত বোকা আমরা। তাইতো আমাদের প্রভু স্বয়ং আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, বলো:
“আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।“
(কুরআন, ১:৬)
💎🎈🕊️ আমাদের ছোট্ট স্কুলটা দিনে দিনে বড় হতে থাকে। দেখা গেলো প্রায়ই সন্ধ্যার পর নানা ধরণের ট্রেনিং, আলোচনা বা অনুষ্ঠান তাই একজন নাইটগার্ডের প্রয়োজন দেখা দিলো। সাইফুল ছেলেটি, কদিন পরই ওর বিএ পরীক্ষা। টাকার অভাবে পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। নাইটগার্ডের চাকরি টি হলে পড়াশুনার খরচটা চালিয়ে নিতে পারবে। আমাদের পিয়ন জামশেদ বললো,সাইফুল তারই ফুপাতো ভাই। আমি বললাম ঠিক আছে, ওর চাকরি হয়ে গেল।
আমাদের নানান কাজে প্রায়ই সন্ধ্যার পর স্কুলে যাওয়া হতো। কিন্তু ভীষণ লাজুক সাইফুল ছেলেটির সাথে দেখা হতো না খুব একটা। তবে ওর প্রশংসা শুনতাম সবার কাছে। সে নামাজের ব্যাপারে ভীষণ নিয়মিত ছিল, এমনকি তাহাজ্জুদ নামাজেও। সে একাই নামাজ পড়তো না, সবাইকে ডেকে ডেকে পড়তে উৎসাহিত করত। মুখচোরা ছেলেটি দিনের বেলা খুব প্রয়োজন ব্যতিরেকে রুম থেকে বেরই হতো না। অন্য পিয়নরা অনেক-সময় স্কুলের আয়াদের সাথে কথাবার্তা বলত, সে কিছুতেই মহিলাদের সামনে আসতো না। রুমের ভেতর ঘাপটি মেরে পড়াশোনা করত আর সন্ধ্যা হলেই নিজের কাজে লেগে যেত।
একদিন সকালে স্কুলে গিয়ে দেখি স্টাফ-কোয়ার্টারের ওখানে বেশ ভিড়। ব্যাপার কি? উপরতলায় গিয়ে শুনলাম অদ্ভুত ঘটনা। মধ্যরাতে জামশেদ সাইফুলকে ডাক দিলো, ‘কিরে, আজ তাহাজ্জুদ পড়বি না?’ সাইফুল কোনো সাড়া দিলো না। জামশেদ ভাবল, হয়তো আজ শরীরটা ভালো নেই, তাই আর কিছু বলল না। ভোরে ফজর নামাজের সময়ও সে উঠল না। জামশেদ ভাবলো ওর শরীর মনে হয় নিতান্তই খারাপ, নইলে তো সে প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ পড়ে, কুরআন পড়ে। সকালে স্কুল খোলার টাইমেও ওর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জামশেদ গিয়ে ধাক্কা দিলো। গায়ে হাত দিতেই সে চমকে উঠল। হিম হয়ে আছে সাইফুলের দেহ। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার,প্রিন্সিপাল স্যারসহ অন্যান্য লোকজন মিলে গিয়ে দেখার পর সবাই হতবাক হয়ে গেল, ছেলেটা রাতে ঘুমের ভেতর মারা গিয়েছে। ২০ বছর বয়স, কিন্তু ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে!
সাইফুলকে হিংসা হয়। এত পঙ্কিলতার মাঝে সে পণ করে নিয়েছিল, ‘ নিশ্চয় আমার নামায, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য’ (কুরআন, ৬:১৬২) এবং সে-অনুযায়ী নিজের ওয়াদা পূর্ণ করে কোনো প্রলোভন কিংবা প্রতারণার দিকে না-তাকিয়ে পথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সে চলে গিয়েছে। আমরা কি ততটা ভাগ্যবান হতে পারব?
💎🎈🕊️ একবার এক লোক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করার সময় মরুঝড়ে পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। হঠাৎ বাতাস আর বালির আস্তরণ ভেদ করে কিছু দূরে তাঁবুর মতো কিছু একটা তার চোখে পড়ল। কোনরকমে হামাগুড়ি দিয়ে সে তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তাঁবুতে প্রবেশ করে সে বুঝতে পারল শতছিন্ন তাঁবুর ভেতর ধূলিঝড় আর প্রচন্ড বাতাস অনায়াসে আনাগোনা করছে। এর মধ্যেই মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ। দেখাই যাচ্ছে বৃদ্ধের সম্পূর্ণ শরীর প্যারালাইজড, তার চোখ দুটো অন্ধ হয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধ একটানা বলে চলেছে, ‘ সকল প্রশংসা আল্লাহর,যে, তিনি তাঁর অনেক বান্দার ওপর আমাকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তাঁর রাহমাতের জন্য আমাকে নির্বাচন করেছেন।‘
বৃদ্ধের কথা শুনে লোকটি এত আশ্চর্য হলো যে সে বলল, ‘আমি এসেছিলাম আপনার কাছে দিক-নির্দেশনা চাইতে। কিন্তু আগে আমি জানতে চাই কোনোদিক থেকে আপনি মনে করেন আল্লাহ আপনাকে তাঁর অন্যান্য বান্দার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন? অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার অবস্থা সবদিক থেকেই শোচনীয়!’ বৃদ্ধ বললেন, ‘আল্লাহ কি আমাকে সুস্থ মস্তিষ্ক দেননি, ফলে আমি তাঁর প্রশংসা করতে পারছি? তুমি কি দেখনি কত নারী-পুরুষ রয়েছে যাদের আল্লাহ এই নিয়ামতটি দেননি?’ লোকটি বলল, ‘জি , আপনি ঠিক বলেছেন।‘ বৃদ্ধ বললেন, ‘আল্লাহ কি আমাকে তাঁর পছন্দনীয় দীন বোঝার ক্ষমতা দেননি? অথচ তাঁর কত বান্দা তাঁকে চেনেই না!’ লোকটি বলল, আপনি নিঃসন্দেহে সত্য বলেছেন!’
বৃদ্ধ এবার বললেন, ‘আমি তোমাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে দেবো, কিন্তু তোমাকে আগে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে। আমি আমার সব সম্পদ এবং স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে ফেলেছি,আমার কনিষ্ঠ পুএ ছাড়া—যে আমার দেখাশোনা করে। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ আমার পক্ষে নিজের কোন কাজই করা সম্ভব নয়। আমার ছেলেটি কাল বেরিয়েছে, কিন্তু এখনো ফিরে আসেনি। তুমি কি যাবার আগে তাকে খুঁজে দিয়ে যেতে পারো? লোকটি তাঁবু থেকে বের হয়ে দেখতে পেল অদূরেই শকুনের দল চক্কর দিচ্ছে। তার হৃৎপিন্ড ধক করে উঠল। যখন সে সেই স্থানে পোঁছল, তখন দেখতে পেল বালকটির মৃতদেহ অর্ধভুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। নেকড়ের দল যা ফেলে গিয়েছে তা সাবাড় করার জন্যই শকুনের আগমন।
লোকটি এবার ভাবল, ‘পালিয়ে যাই’। কারণ, বৃদ্ধকে তার জীবনের শেষ অবলম্বনটিও হারানোর খবর দেয়ার মতো সাহস তার ছিল না। কিন্তু সে পারল না। সে বৃদ্ধের কাছে ফিরে গেল। বৃদ্ধকে খবরটি জানানোর পরিবর্তে সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি মনে করেন আল্লাহ আপনাকে বেশি ভালোবাসেন নাকি আইয়ুব (আঃ) –কে।‘ সে বলল, ‘আপনি কি মনে করেন আল্লাহর পথে আইয়ুব (আঃ) বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন নাকি আপনি?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘অবশ্যই আইয়ুব (আঃ)। তিনি আল্লাহর পথে সব কিছু ত্যাগ করেছিলেন, আমার তো একটি পুএ অবশিষ্ট রয়েছে।‘ এবার আর কোনো উপায় রইল না, লোকটিকে জানাতেই হলো যে বৃদ্ধের এখন আর কেউ অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু সংবাদটি শুনেই বৃদ্ধ বললেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যে, তিনি আমাকে আইয়ুব (আঃ) –এর ভাগ্য দান করেছেন!’
অল্প কিছুক্ষণের ভিতরেই তার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো, তার শ্বাসপ্রশ্বাস কমতে লাগলো এবং অবশেষে তিনি মারা গেলেন। লোকটি চিন্তায় পড়ে গেলো কিভাবে তাকে কবর দেবে। কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতর সেখানে একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে পৌঁছল, তারাও মরুঝড়ের কারণে পথ থেকে সরে এসে এখানে উপস্থিত হয়েছে। সবাই মিলে বৃদ্ধকে গোসল দিয়ে, কাফন পরিয়ে, কবর তৈরি করে, দাফন দিয়ে দিলো। জানাজার পর লোকটি ওই কাফেলার সাথেই ওই স্থান ত্যাগ করলো।
সে রাতে বৃদ্ধ তার স্বপ্নে দেখা দিলো। কিন্তু এ কি! সে তো এক তাগড়া নওজোয়ানে রূপান্তরিত হয়েছে! তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং অত্যন্ত আনন্দিত দেখাচ্ছিল। সাথে ছিল তার সম্পূর্ণ পরিবার। সে বলল, ‘ আমি তোমাকে জানাতে এসেছি যে, আল্লাহ আমাকে জান্নাত উপহার দিয়েছেন, কেননা আমি তাঁর রহমাতের জন্য তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং কৃতজ্ঞ ছিলাম।’
⏳ পরিশেষে বলতে চাই, জীবন নিয়ে পাগল আমরা আসলে মৃত্যুর কাছে কত অসহায়! অথচ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও এর জন্য আমরা কতটা অপ্রস্তুত ভাবতেই অবাক লাগে! সামান্য টাকাপয়সা আয় করার জন্য বিশ থেকে ত্রিশ বছর পড়াশোনা করি ; মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য আমরা কথাবার্তা, চালচলন, পোশাকআশাক থেকে মানসিকতায় পর্যন্ত আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসি। অথচ যাকে মুগ্ধ করা জরুরী, যার কাছ থেকে এসেছি এবং যার কাছে ফিরে যেতে হবে, তাঁকে খুশি করার জন্য কী করা প্রয়োজন তা জানার জন্য আমরা কতটুকু সময় ব্যয় করি???
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?