বইঃ গোল গল্প, চৌকো গল্প ll bangla book review 2021

বইঃ গোল গল্প, চৌকো গল্প। (গল্প-সংকলন)

লেখকঃ সৌরভ মুখোপাধ্যায়

প্রকাশক: দ্য কাফে টেবল

মুদ্রিত মূল্য: ২২৫/-

হার্ডকভার

প্রচ্ছদশিল্পী: তৌসিফ হক।

————————————————————


পড়লাম -‘গোল গল্প, চৌকো গল্প’ সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প সংকলন। ঠিক পড়লাম না গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করলাম বলতে পারব না, তবে সব মিলিয়ে বইটি শেষ করেছি ৯ঘন্টা ৫৭মিনিটে। কিন্তু প্রতিটি গল্পের শেষে যে ডাইমেনশন তৈরি হয়েছিল, তার রেশ থেকে গেছিল বহুক্ষন। তাই বইটি এক বৃষ্টির বিকেলে হাতে পেয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার পর, দুদিন ধরে নতুন করে ভাবতে বসেছিলাম এর পাঠ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে! সত্যি বলতে সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের গল্প-এর রিভিউ করতে দম লাগে। 

 গত দেড় দশক ধরে যে লেখকের অজস্র রচনা পাঠকমহলে আলোড়ন তুলেছে বারে বারে, যিনি তার আখ্যান মঞ্জরীকে ‘আ ডকুমেন্টেশন অব দ্য মেকিং’ নামে নির্দেশিত করতে পারেন, যাঁর আত্মকথায় বর্ণিত  হয়েছে, নিছক গোল গল্পকে কিভাবে যাদুর ছোঁয়ায় চকিতে, তির্যক ক্ষিপ্রতায় কৌণিক করে তোলা যায়- তার একান্ত প্রয়াসের কথা, সেই লেখকের প্রতিটি লেখনী এক একটি মাইলস্টোন ছাড়া আর কিই বা হতে পারে। সাধারণ মানুষের জীবনের চাওয়া পাওয়া, আনন্দ বেদনা, প্রেম অপ্রেম, লোভ, ক্ষোভ, মোহ, যৌনতার যে জ্যামিতি তিনি নিরলসে পরিবেশন করেছেন, তা নিছকই তাঁর কলমচি জীবনের গল্প নয়! মানুষের মননে, চিন্তনে, বিলাসে, ব্যসনে যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভুতি তোলপাড় করে চলে তারই ভাঙা গড়ার এক রূপরেখা এই গল্প সংকলন।

  ‘দ্য ক্যাফে টেবিল’ কে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি বই প্রকাশনা করার জন্য। এ যেন দায়িত্ব  নিয়ে পাঠকের মনের ক্ষিদে মিটিয়েছে আন্তরিক প্রয়াসে। বইটির ২০টি গল্পের প্রতিটিতেই মনোজগতের একেকটি বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। যে সমস্ত বিষয় অত্যন্ত  স্বাভাবিক কিন্তু আপেক্ষিক, আবার যে সমস্ত বিষয় লোকচক্ষুর আড়ালে প্রতিটি মানুষের নজর কাড়ে অথচ তা বহু চর্চিত হয়ে ওঠেনা, সেই সমস্ত বিষয়ের শিকড়ে টান দিয়ে সমস্ত হিপোক্রেসিকে লেখক উন্মোচিত করেছেন তাঁর প্রতিটি গল্পে।

আগে তো দেখা,  তারপর ফিরে দেখা- তা গল্পগুলির মধ্যে কি দেখলাম দু-এক কথায় কয়েকটি গল্প নিয়ে না বললে সত্যিই অবিচার করা হবে।

বইটির প্রথম গল্প ‘মেরুদণ্ডী।’ ভাঙনের নেশায় উন্মত্ত ক্ষমতাবান পশুপতি তরফদার। তার আচরণে, গল্পের শুরু থেকেই সে এক মানবতা বিরোধী চরিত্র। অথচ গল্পের শেষ বাক্যে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য এনে গোটা প্রেক্ষাপটকে আমূল পরিবর্তন করে চমক দিয়েছেন লেখক। কি অদ্ভুত তার ভাষাশৈলী -‘ সবাই কি শালা কেন্নো হবে, কেন্নো।’ 

পরবর্তী গল্প ‘সিসিফাসের পাথর’। সাধারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের টানা পোড়েনকে গ্রিক মাইথোলজির এক অদম্য চরিত্রের সাথে মিলিয়ে, গল্পটির যে রূপকধর্মী তাৎপর্য সৃষ্টি করেছেন, তা শেষ পর্যায়ে না আসলে বোধগম্য হওয়ার নয়। নরনারীর মথিত কামই যে সৃষ্টির দ্যোতক তা লেখক এই গল্পে নতুন করে ছবি এঁকেছেন।

এবার আসি ‘নাইটল্যাম্প’ গল্পটিতে। আমার কেবলি মনে হয়েছে প্রতিটি সাদাসিধে পুরুষের চোরামনের এক গোপন ইচ্ছের কথা যেমন তুলে ধরেছেন লেখক, তেমনি আবার লোকলজ্জার ভয়ে মনের সুপ্ত লাগামছাড়া ইচ্ছে থেকে মুক্তির তাড়নায় ছটফটিয়ে ওঠা সেই পুরুষ মনের উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন কি অবলীলায়। আর গল্পের শেষে গড়পড়তা এক পুরুষের বিবাহোত্তর বৈচিত্র্যহীন নিশিযাপনের দীর্ঘ আপোষ, গল্পটিকে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।

‘মলিন মর্ম মুছায়ে’ গল্পটি শুরু করেছেন অত্যন্ত পরিচিত বাস্তব মুহূর্ত-এর মধ্যে দিয়ে,কিন্তু শেষ করেছেন এক পরাবাস্তব মুহূর্তের দোরগোড়ায়। পাঠক যেন একলাফে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে পথ হেঁটেছেন লেখকের লেখার সাথে। সবশেষে সেই অত্যন্ত গতিময় যাত্রাপথ এসে ক্ষান্ত হয়েছে এক নিথর নিশ্চুপ সত্যের মুখোমুখি।

অনন্য সাধারণ আরো একটি গল্প হচ্ছে ‘দাহ’। দুই বন্ধুর মাঝে বন্ধুত্বের ওঠাপড়া, সখ্যতা, আনুগত্যের রূপভেদ, অলিখিত দায় সব মিলিয়ে এক অনন্য সৃষ্টি। অসামান্য বাক্যবাণে পাঠক মন বিদ্ধ হয়েছে বারে বারে,  ‘তুই-আমি আলাদা নাকি?’ কিন্তু জীবনের প্রতিটি স্তরেই যে দুটি মানুষের বন্ধুত্ব সব কিছু ভাগ করে নিতে সমর্থ নয়, আর তার অপারগতার যে যন্ত্রণা, তারই এক নিরলস নজিরবিহীন খতিয়ান এই গল্প। পাশাপাশি নারী পুরুষের শরীরী আবেদনের যে শৈল্পিক রূপরেখা, যে ‘ইরোটিক’ আশ্লেষ, তাকে সর্বগ্রাসী আগুনের দহনে দাহকর্ম -এর সাথে তুলনা করার যে অসামান্য ব্যঞ্জনা,তাকে স্যালুট না জানিয়ে পারছি না।

কোন গল্পটাকে ছাপিয়ে কোন গল্পের কথা বলি, প্রতিটি গল্পই চাবুক। প্রতিটি গল্পের পরতে পরতে এক নতুন বাঁকের জন্ম দিয়েছেন তিনি। কোনরকম মেনারিজিমের তোয়াক্কা না করে গল্পগুলিকে সমকালীন থেকে চিরকালীন স্তরে তুলে নিয়ে গেছেন। তাঁর গল্প বলার বাস্তব ভঙ্গিমা, বেলাগাম ভাষাশৈলীর ব্যবহার, তার মুক্ত ব্যক্তিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার আজন্ম প্রয়াস, অনায়াস দক্ষতার ছাপ রেখে গেছেন, ‘বহুকৌণিক’ ও ‘অবরোহিনী’ গল্প দুটির মধ্যে। মানবমনের উত্থান পতন, পাপ পুণ্যকে বোধের আয়নায় ভেঙে চুরে ফেলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাবে। সত্যি বলতে একটি পুরুষ তার মনের দিক থেকে কতটা নারী আবার একটি নারী কতটা পুরুষোচিত হতে পারে, সেই রূপান্তরকামী সত্তার বলিষ্ঠ ছোঁয়া প্রতিভাত হয় তার লেখনীতে।

সর্বশেষে আসি ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ’ গল্পটিতে। যদিও বিষয়বস্তু নির্বাচনে একেবারেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন তিনি।এক জিগোলো বা পুরুষ যৌনকর্মীকে কেন্দ্র করেই লেখা এই গল্পটি। তবে বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের বিষয় নিয়ে কতটা কাজ হয়েছে আমার সঠিক জানা নেই। কিন্তু উক্ত গল্পটিতে লেখক তার নিজ ঘরানার অনাস্বাদিত লেখনী পরিবেশন করে পাঠকের রসনা পরিতৃপ্ত করেছেন। যদিও ফাঁকা বাড়িতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে জিগোলো ডেকে নিঃসঙ্গ রমনীদের যৌন তৃপ্তিই এ গল্পের মূল উপজীব্য বিষয় নয়। এই সমস্ত ছাড়িয়েও শরীর আর মন যে দুটি ভিন্ন কম্পোনেন্ট, এই তথ্যই নতুন রূপে পেশ করেছেন তিনি। সাধারণ মানুষের বদ্ধ ধারনার অচলায়তনকে নাড়িয়ে দিয়ে, দেহ সঞ্জাত সুখের ওপরেও যে মনের স্থান, তাই চিত্রায়ণ করেছেন অকপটে। একই গল্পের মধ্যে দুটি পরষ্পর বিরোধী ধারনার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে শরীর আর মনের মাঝে এক নিস্তব্ধ প্রেমের আকুতি ফুটিয়ে তুলেছেন।  

পরিশেষে বলি, ছোট গল্পের শেষে এক চমক পাঠককে সবসময় মনে করিয়ে দেয়, সেই চিরাচরিত অনুভুতি ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। আর তাঁর গল্পে বারে বারেই ফিরে এসেছে সেই উপলব্ধি,আর এখানেই তিনি সফল। তাই তাঁর আত্মকথনের শেষ দুটি কথাকে অবলম্বন করে বলি, ‘জন্ম থেকে মৃত্যু – এই চেনাবৃত্তের মধ্যে অজস্র সুখ দুঃখের চতুষ্কোণ রচনা করে’, সব মিলিয়ে যে জ্যামিতি উপস্থাপন করেছেন তিনি, তারই নাম জীবন।

————————————————————

প্রাপ্তিস্থান: 

Shri Ganesh Creations

Mousumi Club (1st fl.), Nutanpally (E)

Purba Bardhaman 713101

Call : 7001877312 | 7407966319

Wtsp : 7407966319।

লিখেছেন ঐন্দ্রিলা মুখার্জ্জী। 

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?