বইঃ আমেরিকা মুসলিমদের আবিষ্কার
লেখকঃ মুসা আল হাফিজ
প্রকাশনীঃ কালান্তর প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৪০৳
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১১২
১২ই অক্টোবর আমেরিকার জন্য একটি বিশেষ দিন। এ দিনে সমস্ত আমেরিকা জুড়ে দিবস পালন করা হয়। কলম্বাসের নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের বিজয়োৎসব।
প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী ১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবর আমেরিকার ভূখণ্ডে পা রেখেছিলেন কলম্বাস। এ উপলক্ষে সমস্ত আমেরিকা জুড়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসব পালন করা হলেও কেউ কেউ এই দিনে পরিতাপ করে থাকে। বিল বিগলো নামের এক শিক্ষক কলম্বাস দিবসে ক্লাসে ঢুকে তার ছাত্রীর টেবিলের উপর রাখা পার্সটি বগলদাবা করে হাঁটতে শুরু করেন। এতে ছাত্রীটি চেঁচিয়ে ওঠে, একি! আপনি আমার পার্স নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
বিগলো জবাব দেন, নিলাম কোথায়? এটা তো আমি আবিষ্কার করলাম। কলম্বাস এভাবেই আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকাকে। ওটা আবিষ্কার নয়; স্রেফ লুটতরাজ!
পড়ছিলাম মুসা আল হাফিজ লিখিত ‘আমেরিকা মুসলিমদের আবিষ্কার’ বইটি।
ইতিহাস সাধারণত রচিত হয় বিজয়ীদের হাতে। তারা তাদের মতো করেই রচনা করে ইতিহাসকে। তেমনি আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাসও বিজয়ী খ্রিস্টসমাজের হাতে রচিত হয়েছিল; তাদের মতো করেই। প্রকৃত অবদান বিজিতদের হলেও বিজয়ীর অবস্থান থেকে তারা তা রীতিমতো চুরি করে নিয়েছিল নিজেদের নামে।
কলম্বাস ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ইতালির জেনুয়া শহরের এক তাঁতি পরিবারে জন্ম তার। স্বপ্ন ছিল আকাশকুসুম! খ্রিস্টধর্মকে পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে দেওয়া এবং স্বর্ণের বিশাল ধনভাণ্ডার গড়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জীবনের গতিবিধি পরিচালনা করতে থাকেন তিনি। প্রথম টার্গেট নির্ধারণ করেন ভারতকে।
পৃথিবী গোলাকার নাকি চ্যাপ্টা, এটা নিয়ে মুসলিম বিজ্ঞানী ও খ্রিস্টসমাজের মতভেদ ছিল। খ্রিস্টানরা যা বিশ্বাস করত, তাকে ধর্মীয় বিশ্বাসের মতোই বিশ্বাস করত। বিপরীত বিশ্বাসীদের নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করত। কলম্বাস ছিলেন মুসলিম বিশ্বাসে বিশ্বাসী। এ বিশ্বাসকে পুজি করেই কলম্বাস ভারত অভিযানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
পূর্বদিকের সমুদ্রগুলো ছিল মুসলিমদের দখলে। তাই নিরাপদে যাত্রা করতে হলে তাকে যেতে হবে পশ্চিমের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। পশ্চিমের সমুদ্রের নাম আটলান্টিক। কিন্তু কলম্বাস তো ছিলেন দরিদ্র ঘরের সন্তান। বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জাহাজ পাবেন কই? বিশাল সাম্রাজ্য ভারতই বা অভিযান করার রসদ-সরঞ্জাম পাবেন কোথায়? এর সমাধানের জন্য তাকে তৎকালীন খ্রিস্ট শাসকদের দরবারে ছোটাছুটি করতে হয়। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে। পাত্তা দিলেন না কেউ। উল্টো উপহাসের পাত্র হলেন সবার কাছে। কিন্তু হতাশ হলেন না কলম্বাস!
অবশেষে রাজকীয় সহযোগিতার অনুমোদন পাওয়া গেল ঠিকই; কিন্তু আটলান্টিক সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার মতো কোনো স্বজাতি পাওয়া গেল না।
১৪৯২ সালের আগে মুসলিম ছাড়া অন্য কারো কোনো জাহাজ চোখে পড়েনি আটলান্টিকে। আটলান্টিকে যাত্রা করার ম্যাপ, সূত্র এবং জ্ঞান সবগুলোই ছিল মুসলিমদের থেকে ধার করা। এমনকি জাহাজ পর্যন্ত।
কলম্বাসের জাহাজ যেখানে নোঙ্গর করে, সে দ্বীপটির নাম বাহামা। বাহামায় দেখা মিলে একদল স্বদেশত্যাগী সম্ভ্রান্ত ও সরল মানুষের। তাদের প্রকৃত পরিচয় কী ছিল, স্বভাব-সংস্কৃতি কেমন ছিল, কোন দেশ থেকে তারা পালিয়ে এসেছিল, কেন এসেছিল, এসবও উঠে এসেছে বইটিতে।
কলম্বাস সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না। তার একটা বিশেষ পরিচয় ছিল–‘ক্রুসেডার’। তার স্বপ্ন ছিল ইসলাম নিশ্চিহ্ন করা এবং খ্রিস্টবাদ ছড়িয়ে দেওয়া। এজন্য তিনি অতিসুক্ষ্মতার সাথে আমেরিকার প্রকৃত পরিচয় লুকিয়েছেন। বিকৃত করেছেন অনেক কিছুই। ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালিয়েছেন। গণহারে লুটতরাজ, সরল মানুষদের দাস হিসেবে পাচারকরণ, নানান অপকর্ম করেছেন। ইতিহাসের নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে মিথ্যা ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কলম্বাসের আসল চেহারাও উন্মোচিত হয়েছে বইটিতে।
ইতিহাস বিকৃতি, আমেরিকার শহর-সংস্কৃতি পরিবর্তন, ব্যাপক নিধনযজ্ঞের পরও রয়ে গেছে সত্য উন্মোচনের অনেক কিছু। রয়ে গেছে হাজার বছরের মুসলিম নিদর্শন, সংস্কৃতি, বংশধারা। সেসবকে পাঠকের সামনে সাবলীলভাবে পেশ করেছেন বিশিষ্ট কবি ও গবেষক মুসা আল হাফিজ।
কলম্বাস কখনোই দক্ষিণ আমেরিকায় যাননি; এ ব্যাপারে সকল গবেষক একমত। অথচ তার বর্ণনায় দক্ষিণ আমেরিকার খুঁটিনাটি পাওয়া যায়। কীভাবে সম্ভব? প্রশ্নের উত্তর পেতে পাঠককে বেগ পোহাতে হবে না। মুসা আল হাফিজ সুন্দর করে জানিয়ে দিয়েছেন উত্তরটি।
কলম্বাসের জন্মেরও পাঁচশো বছর আগে আমেরিকার মানচিত্র, ভৌগোলিক অবস্থান, শহর-বন্দরের বর্ণনা দিয়ে গেছেন এক মহাবিজ্ঞানী। তার পরিচয়, দলীলপত্র, তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার রিপোর্ট-প্রতিবেদন, বহু গবেষকের গবেষণা, ইত্যাদিও রয়েছে।
ড. বেরি ফিল। একজন আমেরিকান গবেষক। তিনি মনে করেন, হিজরির প্রথম শতক সপ্তম খ্রিস্টাব্দেই মুসলিমরা আমেরিকায় আগমন করেছিলেন। ড. বেরি ফিলের গবেষণাপত্রও স্থান পেয়েছে বইটিতে।
‘আমেরিকা মুসলিমদের আবিষ্কার’ বইটিতে লেখক মুসা আল হাফিজ ঐতিহাসিক দলীল, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকার প্রতিবেদন, গবষকদের গবেষণাপত্র, কলম্বাসের পত্র, ভ্রমণ-ডায়েরি এবং তার সহযোগী ডা. চানার ব্যক্তিগত ডায়েরির লেখাজোখা ইত্যাদির সূত্র ধরে প্রমাণ করেছেন আমেরিকা মুসলিমরাই আগে আবিষ্কার করেছেন; কলম্বাস নয়।
শুরু থেকে অদ্যাবধি আমেরিকার মুসলিম ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ‘কালপঞ্জি’ও উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন আমেরিকা নিয়ে তাদের মিথ্যা ইতিহাস রচনার অপচেষ্টা। বইটি সাহিত্যের মানে যেমন উন্নীত, তেমনি ইতিহাসের নথিপত্র হিসেবেও ঝরঝরে। সুখপাঠ্য এবং উপভোগ্য।
পুরো বইটি পড়তে গিয়ে হয়ত হয়ত পাঠকমনে প্রশ্ন জাগতে পারে–তবে কি মুসলিমরাই আমেরিকায় প্রথম পদার্পণ করেছিল? সোজা কথায় উত্তর হল, ‘না’। তবু কেন তাকে মুসলিমদের আবিষ্কারই বলা হবে? এর উত্তরও কিন্তু লেখক দিয়েছেন বইয়ের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায়। সুতরাং বইটা একবারের জন্য হলেও পড়ে দেখা উচিত নয় কি?
সবশেষে একটা সুখের খবরও দিয়ে যাই। আগামীর আমেরিকা ইনশাআল্লাহ মুসলমানদের! ২০০০ সালে আমেরিকায় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মাত্র দশ লক্ষ। এ পরিসংখ্যান প্রকাশ হওয়ার পর শাসকগোষ্ঠী একটু নড়েচড়ে বসে। এই বুঝি আমেরিকা মুসলিমদের হাতে চলে গেল! পরের বছরই ঘটল নাইন-ইলেভেন ট্রাজেডি। পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল ইসলামোফোবিয়া! এরপর হুহু করে বাড়তে থাকে মুসলিম বিরোধী (উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অভিবাসন বিরোধী) সংগঠন এবং জনমত। সেইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম জনসংখ্যাও! আজকের আমেরিকায় মুসলিম জনসংখ্যা ৩৩ লাখকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইনশাআল্লাহ আমেরিকায়ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে আগামীর কোনো এক ঊষালগ্নে!
বইঃ আমেরিকা মুসলিমদের আবিষ্কার
লেখকঃ মুসা আল হাফিজ
প্রকাশনীঃ কালান্তর প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৪০৳
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১১২