ফেরিওয়ালা – মিলাদ হোসেন সুজন

থমথমে রাত্রি, ৩ নাম্বার প্লাটফর্মের এককোণে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জামাল। পাশেই ময়লার বাগার থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ক’টা কুকুরের উপস্থিতি আর মাছিদের আন্দোলন। 

চিৎ হয়ে শুয়ে কি যেন ভাবনায় বিভোর জামাল। ভাবনার সাগরে হাজারো কথামালার বুনন করছে কিন্তু ঠাই পাচ্ছে না। গড়াগড়ি করছি এপাশ থেকে ওপাশে। 
জামাল মূলত একজন ফেরিওয়ালা। খুব সাধারণ ফেরিওয়ালা। বর্তমানে স্টেশন প্লাটফর্মই তার থাকার জায়গা। সারাদিন গ্রামে গ্রামে ফেরি করে, গ্রামের অলি গলিতে, কাঁচা পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনো হাঁক ছাড়ে__
লাগবে নাকি–
আলতা, কানের দুল, নাক ফুল,
ঠোঁট পলিশ, নখ পলিশ খোঁপার চুল।। 
লাগবে নাকি ——-*
হাতে থাকে একপ্রকার ভিন্ন রকম ঢোল-
যেটার আওয়াজ শুনে ছোট শিশু, গ্রামের ছেলেপেলে বুঝতে পারে ফেরিওয়ালার উপস্থিতি। 
হালকা থেমে ২ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা বিক্রি করে আবার হাঁটতে থাকে গ্রামের আলপথ ধরে, ধূলোপথ মাড়িয়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে। 
আবারো ইচ্ছে হলে হাঁক ছাড়ে —
লাগবে নাকি– পাউডার,রেশমী চুড়ি, আয়না, চিরুনী,, লাগবে নাকি—–।
আজকাল জামালের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না এই নিয়ে চিন্তিত সে, যদিও আগে সে একটা বোডিংয়ে থাকতো মাস শেষে গুনতে হতো এক হাজার টাকা কিন্তু এখন পুরো মাসেই সে এক হাজার টাকা চোখেই দেখে না, তাইতো স্টেশন প্লাটফর্ম তার শোবার ঘর। 
খাওয়ার জায়গা গফুর আলীর ভাতের হোটেল। ৫০ টাকা দিলেই পাওয়া যায় একপ্লেট ভাত,একবাটি ডাল সাথে ভর্তার গুটি,কনুই ভিজিয়ে খেয়েধেয়ে একবেলা চলে যায়।  সকালে রহমতের দোকানের পাঁচ টাকা দামের ড্যানিশ দুধের এক কাপ চা তেই সীমাবদ্ধ, তাতেই চলে যায় খাওয়া দাওয়ার পার্ট। 
আজকাল রাস্তায় বেরোলে লোকজন ডেকে নেয় না। আলতা, চুড়ি,পাউডার কিনে না।
কেন কিনে না ভাবতে গিয়ে জামাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই আধুনিক সময়ে ঘরে বসেই গ্রাম বালিকারারা পেয়ে যায় প্রয়োজনীয় সকল জিনিস। আলতা,পাউডার,ঠোঁট পালিস সব কিছুই পাওয়া যায়। আর ফেরিওয়ালার দরকার পড়ে কই? 
জামাল মাঝেমধ্যে লক্ষ্য করে – লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট মোটর গাড়িতে বিমানের মতো গতি, পেছনে ঝুলানো ব্যাগ নিয়ে কারা যেন অর্ডারকৃত জিনিসগুলো পৌঁছে দেয়। 
জামাল তাদের মধ্যে আর তার মধ্যে তুলনা খুঁজে, আর এটা ভেবে নিজেকে শান্ত রাখে যে- তারা হলো আধুনিক ফেরিওয়ালা। 
উদ্দেশ্য তো দুজনের একই রকম৷ আমি নিজে ছোট কিসে?  
মুচকি হাসে,আবার হাঁটতে থাকে। 
কখনো ভাবে সবকিছু যেন পরিবর্তন হচ্ছে -মাঝেমধ্যে কেউ ডেকে নিলে লিপস্টিক চায়,জামাল অবাক হয়! 
একসময় যেটা ঠোঁট পালিস ছিলো আজ সেটা লিপস্টিক হয়ে গেল৷ 
আরো কতোই না পরিবর্তন দেখতে হবে!  
তাও ভালো দেশের হয়তো উন্নতি হচ্ছে, বিদেশিদের মতো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। 
আমি জামাল আর কয়দিনই থাকবো?
তখন আর কেউ আমার হাঁক মনে করবে না, রাস্তায় দৌড় এসে আলতা,চুড়ি,পাউডার কিনবে না। ফেরিওয়ালা শব্দটাও একদিন হয়তো সবকিছুর মতো পরিবর্তন হয়ে যাবে অন্যকোনো নামে।।
তারপর!!
তারপর জামালও চির চেনা পেশা ত্যাগ করে   নতুন চাকরি নেয় চায়ের দোকানে। 
বিলিন হয়  আলপথ মেঠোপথে কাঁদা, ধুলো মাড়িয়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামের  আকাশ, বাতাস, ধুলোমাটির পরিচিত ফেরিওয়ালার চিরচেনা পেশার।।
ফেরিওয়ালা 
মিলাদ হোসেন সুজন
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?