ফেরারী বসন্ত : আফিফা পারভিন | Ferrari Boshonto By Afifa Parvin

 বই : ফেরারী বসন্ত
লেখক : আফিফা পারভিন
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর 
প্রকাশনী : অন্যপ্রকাশ
জনরা : সমকালীন
মুদ্রিত মূল্য : ৮০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৩৭৫
প্রকাশকাল : অক্টোবর ২০২১
রিভিউ লেখনীতে : আরফিয়া 

 
🔷 ভূমিকাঃ ‘ফেরারি বসন্ত’ হাতে পাওয়ার পর অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। কেমন যেনো স্বপ্নের মতো লাগছিলো। এরপর পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। টেবিলের দিকে তাকাতেই আতংকে উল্টোদিকে দৌড় মারতাম। এতো বড় বই কীভাবে পড়বো! অনেকদিন কাছে-দূরের এই খেলা চলার পর অবশেষে যখন বই হাতে নিলাম, তখন বই থেকে দূরে থাকাই মুশকিল হলো। কয়েক পাতা পড়ে বইয়ের ভারে হাতে ব্যাথা ধরে যেতো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পড়তে বসতাম। একবারে পড়ে ফেলা যায় না, আবার বেশিক্ষণ না পড়েও থাকা যায় না। পুরো বইটাই যেনো মন নিয়ে খেলেছে।
🔷 নামকরণঃ বসন্ত নিয়ে আমাদের সকলের ভাবনাই আনন্দময়, সুখকর, সুন্দর এবং স্বপ্নভরা। বসন্ত তো আসেই রঙ নিয়ে, যার রঙে মন রঙিন হয়ে ওঠে। কিন্তু ঋতুর বসন্ত তো ক্ষণস্থায়ী, মনের বসন্তও কখনো ক্ষনস্থায়ী হয়। কারো ক্ষেত্রে তো মনের সেই বসন্ত আবার ফেরারি হয়৷ ধরা দিয়েও যেনো ধরা দেয় না।
🔷 প্রচ্ছদঃ রঙ তুলি খেলার মাঝে নিশ্চল নারী পুরুষের অবয়টি কতো কথা বলে যায়! সামনে অ*স্ত্র হাতে সং*গ্রামী বাংলার দামাল ছেলেরা, গড়িয়ে পরছে তাজা র*ক্তের ধারা। তারই দিকে চেয়ে আছে পুরুষটি। পাশেই সাগর সমান ভালোবাসা নিয়ে পুরুষটির দিকে তাকিয়ে নারী অবয়টি। টেলিফোনের সেইযুগে এইটুকুই দূরত্বই যেনো কতোশত দূরত্ব! 
🔷 ফ্ল্যাপ থেকেঃ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘সময়’ , যে একাধারে নায়ক ও খলনায়ক। পুরো উপন্যাসে এই ‘সময়’ কোনো মানুষ কিংবা কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনে কখনো এসেছে গ্রীষ্মের খরতাপ হয়ে, কখনো এসেছে বর্ষার ঝুম বৃষ্টি হয়ে। কখনো কারও জীবনে ‘সময়’ বয়ে নিয়ে এসেছে রঙ্গিন বসন্ত, আবার কারও বসন্তকে করে দিয়েছে ফেরারী। একটা ব্যাপক ও বিস্তৃত ‘সময়’ কে কথাবন্দি করার প্রয়াসই হলো ‘ফেরারী বসন্ত’। 
🔷 লেখক পরিচিতিঃ ‘এসো নীপবনে’ দিয়ে যাত্রা শুরু। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি লেখক আফিফা পারভীনকে। ফেরারি বসন্ত এর মতো বিস্তৃত উপন্যাসের পাশাপাশি ‘বাতাসে বহিছে প্রেম’, ‘যাও পাখি বলো তারে’ এর মতো উপন্যাসও লিখেছেন।
🔷 সার-সংক্ষেপঃ আধুনিক এই যুগে বসে চলে যাওয়া যাক ১৯৯৭ সালের সেই দিনগুলোতে। স্বল্প সচেতন মানুষগুলো যখন খুব কমই পড়াশোনার দিকে ঝুঁকে ছিলো। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের হৈমন্তী বুকে অদম্য ইচ্ছেশক্তি নিয়ে ঢাকার নামকরা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে আসে৷ যেখানেই দেখা মিলে তার রাজপুত্রের।  কাঠকুড়ানি হৈমন্তীর কী দুঃসাহস সেই রাজপুত্রকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে! বু*র্জোয়া সমাজ নিয়ে তার ধারণাও দিছো আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নেতিবাচক।  কিন্তু সেই বিশাল অধিপত্যের রাজকুমারের যে কাঠকুড়ানি সেই হৈমন্তীকে চাই, চাই। 
🔷 চরিত্রকথনঃ
🔹হৈমন্তীঃ প্রচুর বাস্তববাদী একটি মেয়ে। অযথা সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন সে দেখে না। বলা চলে আসলে এমন স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়, পাছে সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। শক্ত ধাপের মেয়েটি অনায়াসে কেঁদে ফেলে কিন্তু কখনো আফসোস, অভিযোগ করে না। একসময় দেখা যায় চোখের জলটুকুও আর রইলো না।
🔹 জুবায়েরঃ বু*র্জোয়া সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেও যে ল*ড়ে গেছে নিম্নবিত্ত সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য। যো*দ্ধার শরীরের র*ক্ত বইছে তার শরীরে, যার অমর্যাদা সে কখনোই করেনি। একজন প্রলয়ঙ্কারী প্রেমিক, অকুতোভয় লিডার, যোগ্য কম*রেড, সর্বদা পাশে থাকা বন্ধু- সবকিছু মিলিয়ে সে একজন হৃদয় হ*রণকারী চরিত্র।
🔹 শম্পাঃ ভালোবেসে হাসি মুখে কীভাবে ভালোবাসার মানুষটির জন্য নির্দ্বিধায় গ*রল গলাধঃকরণ করা যায় এই মেয়েটির থেকে শেখা উচিত। নিজে জ্ব*লেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো তবুও হৈমন্তীকে উপযুক্ত করে তুলতে কতো পরিশ্রম। সর্বদা ছায়া হয়ে হৈমন্তীর সাথে থেকেছে।
🔹 ফালকিঃ ভালোবাসায় কী অদ্ভুত আত্মত্যা*গ! কতো সামান্যতেই সন্তুষ্ট পাহাড়ী শক্ত গড়নের মেয়েটি। মানুষরুপী দেবতার প্রতি তার ভক্তি দেখে শ্রদ্ধায় বুক ভার হয়ে আসে। 
🔹 ইশতিয়াকঃ পুরো উপন্যাসে এই চরিত্রটির জন্য একটা চাপা কষ্ট অনুভব করেছি। সমাপ্তিতে এসে মুখে লেগে থাকা হাসিটা এই মানুষটির জন্য ফিকে হয়ে যাচ্ছিলো। নিজের মোহনীয় কথা দিয়ে খুব অল্প সময়ে হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলো। 
🔹 নীলিমা হাসানঃ এই যে আমরা স্বাধীন দেশে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিচ্ছি এর পেছনে নীলিমা হাসানের মতো লক্ষ নারীর আত্মত্যা*গ রয়েছে। যারা ভ*য়ানক অতীতের তাড়ায় চোখ বুজে ঘুমাতে পারে না, নতুন স্বপ্ন দেখতে পারে না। যারা সবার চোখে অস্বাভাবিক। ভালোমন্দের অনুভূতি হারানো এই মানুষগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রইলো। 
🔹 সালমা পারভিনঃ বইয়ের ভিতর ঢুকে কোনো চরিত্রকে ইচ্ছেমতো পি*টানো গেলে এই মহিলাকে পি*টাইতাম। ধন সম্পদই যেনো তার কাছে সব। কেউ এতোটা অমানবিক কেমনে হতে পারে!
🔷 পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ নিজ দেশের অতীত, সেই সময়ের মানুষদের সম্পর্কে জানতে গেলে কেমন নস্টালজিক ফিল হয়। সেই অনুভূতি নিয়ে শুরু করেছিলাম ‘ফেরারি বসন্ত’।  হৈমন্তী, জুবায়ের, শম্পা,  রিফাত, মন্টু, জয়দেব, ঝুমুর চরিত্রগুলোর ভার্সিটি ক্যাম্পাসের ব্যস্ততম সোনালী বর্ণনা পড়তে গিয়ে টেলিফোনের যুগের দিনগুলো উপভোগ করেছি।
ধীর-তাল-লয়ে চরিত্রগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা পাঠক হৃদয়ে এতোটাই গভীর স্থান করে নিয়েছে যে চরিত্রদের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, লাজুকতা সবটাই না দেখে, না ছুঁইয়ে অনুভব করা যায়। 
একাত্তরের যু*দ্ধ, বীরবেশে মু*ক্তিযো*দ্ধাদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় চাতক পরিবার, বী*রাঙ্গনার ভাগে জোটা অবহেলা ধীক্কার, তাদের য*ন্ত্রণা-আ*তংক, যুদ্ধ পরবর্তী দেশে অরাজ*কতা ইত্যাদির বর্ণনা পড়তে গিয়ে নিজ দেশের জন্য গর্ব হচ্ছিলো। সেই সময়ের পরিবেশ কিছুটা হলেও মন মস্তিষ্কে ধরা দিয়েছে। 
একজন যো*দ্ধার উত্তরাধিকারী হিসেবে জুবায়ের এর দায়িত্ববোধ, আত্মউপলবদ্ধি,  তার লড়াই, রাজনীতিকে নতুন উদ্যমে, নতুনভাবে উপস্থাপন করা সবটাই শিক্ষণীয়।  
ধুকপুক মন নিয়ে বই পড়া শুরু করেছিলাম। সবখানে কেমন চাপা আ*তংক, আসন্ন আ*র্তনাদের হাতছানি। হৈমন্তীর মতো সব পাওয়ার পরও হারিয়ে ফেলার ভয়। ১২০ পৃষ্ঠায় যে আনন্দ সংবাদ পেয়েছিলাম তাতে যতোটা মন রঙিন হয়েছে ততোটাই হয়েছে তটস্থ। ছোটো ছোটো ঘটনায় ভয় পেয়েছি। ২০৪, ২৯১, ৩১৭, ৩২৭ এই পৃষ্ঠাগুলো পড়তে গিয়ে গলায় কান্নারা আটকে গিয়েছিলো।
২৯৬ পৃষ্ঠা পড়ার পর তো আমি লম্বা সময় বিরতি নিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো এতো লম্বা সফর এভাবে কষ্ট দিয়ে গেলো!  
কিন্তু বসন্ত তো ঘুরে ফিরে পরের বছর আবার আসে। 
🔷 প্রিয় উক্তিঃ
🔹আমি জুবায়েরকে ভালোবাসি বলেই স্বার্থপর। জুবায়ের,  মানে আমার ভালোবাসা তখনই ভালো থাকবে, যখন তার ভালোবাসা ভালো থাকবে। আর আমার ভালোবাসার ভালোবাসা হচ্ছিস তুই। কাজেই আমার ভালোবাসাকে ভালো রাখার জন্য তোকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। 
🔹 আমার জীবনের বসন্ত ফেরারি হয়ে গেছে। এই জীবনে এখন শুধু নিঃসীম শুন্যতা বিরাজ করে। একবার একজনকে মনে লেগেছিল, তাই আর কাউকে আমার চোখেও লাগে না, মনে তো লাগেই না।
🔹আমার সুখ-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, হতাশা-যন্ত্রণায়, বিক্ষোভ-বিপ্লবে, প্রেমে ও প্রার্থনায় আমি সবকিছুতেই তোমাকে চাই। আমার ঘুমঘোর চোখের ভোর, ব্যস্ত দুপুর, অলস বিকেল, ক্লান্ত সন্ধ্যা কিংবা হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গা চোখে গভীর রাতে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমি তোমাকে চাই। 
🔹আমার বেয়াড়া লাগামছাড়া ইচ্ছেরা সব সময় এমনই থাকবে। কখনো এদের আমি লাগাম পরাব না। 
🔹 সবার জীবনে প্রেম এক রকমভাবে আসে না৷ সবার প্রেমের ধরণ এক হয় না। দ্রো*হই আমার প্রেম, প্রেমই আমার দ্রো*হ।
🔹হৈমন্তী,  কথা ছিল আমাদের লাল-নীল সংসার হবে। ছোট ছোট পুতুল আসবে সে সংসারে।  আমার তো হলো না। তোমার কোলে যখন সেই পুতুলেরা আসবে, তাদের ঘুমপাড়ানিয়া গান বলো যে এক সমুদ্র ভালোবাসার বিনিময়েও তার রাজকন্যাকে ভাগ্যদোষে হারিয়ে ফেলেছিল।  
🔹তোমার আমার মাঝে এখনো অনেক দূরত্ব, তাই আমি তোমাকে ছুঁয়ে চোখের পানিও মুছে দিতে পারবো না। আমাকে এতটা অসহায় করে দিয়ো না।
🔹তুমি নাহয় আমাকে ভালো নাই বাসলে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার জন্যই থেকে যাও, প্লিজ। আমার মায়ের স্নেহের জন্য থেকে যাও। 
🔹তুমি জানো আমার ধৈর্য অনেক বেশি। আর ব্যাপারটা যদি তোমার জন্য আমার অপেক্ষার হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আমার ধৈর্য অপরিসীম।  তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকতে আমার কষ্ট হয়, তবে আমি কখনো ক্লান্ত হই না। আমি জানি একসময় তোমাকে আমার ভালোবাসার সামনে হার মানতে হবে, আমার কাছে তোমাকে আসতেই হবে।
🔷 ব্যক্তিগত রেটিংঃ কখনো কাঁদিয়েছে, কখনো লজ্জায় রাঙিয়েছে, ভালো লাগায় ভাসিয়েছে, শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে এসেছে। সবমিলিয়ে সর্বক্ষণ আতংকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। সেইসাথে সুদীর্ঘ এই জার্নিতে একটুকুও বিরক্ত না লাগার জন্য ৪.৮/৫। 
🔷 উপসংহারঃ রয়েল সাইজের ৩৭৫ পেজের বিশাল বই। মোটা পাতার ভারী ওজনে হাতে ব্যাথা ধরানো বইটা সারাজীবন মনে থাকবে। চরিত্রদের কষ্টে দুঃখ পেয়ে পানি খেয়ে গলা ভেজানো, সইতে না পেরে বই বন্ধ করে দুঃখবিলাস মনে থাকবে। ক*মরেড জুবায়ের এর অনেক কষ্টে অর্জিত ভালোবাসা মনে থাকবে।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?