প্রায়শ্চিত্ত – আব্দুল্লাহ আমির | Prayschitto

শোকে বিহ্বল বিলাল। আজান দেওয়া ছেড়ে দিলেন। যে মদিনায় নবীজি নেই, সেই মদিনায় তিনি থাকতে চাইলেন না। চলে যেতে চাইলেন দূরে; কিন্তু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে অনুরোধ করলেন— -বিলাল, আপনি আমাদের কাছেই থেকে যান।
 

আমাদের কষ্ট দেবেন না। খলিফার কথা রাখলেন তিনি। মদিনায় থেকে গেলেন; কিন্তু আজান দেওয়া ছেড়ে দিলেন। যে কন্ঠসুর নবীজি শুনবেন না, সেই কণ্ঠ তিনি উঁচু করবেন না। নবীজির শোকে হাসতেও ভুলে গেলেন তিনি।

লোকেরা তাঁর সুমধুর কন্ঠের আজান আবার শুনতে চাইত। তিনি রাজী হতেন না। খলিফা তাকে বিশেষ অনুরোধ করলেন। তিনি রাজী হলেন। আবার আজান দেবেন। তার সুমধুর কণ্ঠ মদিনাবাসী আবার শুনবে। মদিনার বাতাসে আবার বিলালের সুর ছড়াবে।
বিলাল আজান দিলেন। এবং আজান শেষ করার সাথে সাথেই বেহুশ হয়ে গেলেন। এরপর থেকে আজান দেওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিলেন। যেখানে প্রাণের নবী নেই, সেখানে তিনি কীভাবে আজান দেবেন? কেউ আজান দিতে অনুরোধ করলে তিনি বলতেন—
-আমি যখন আজান দেব, তখন ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সময় পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারলেও এরপর আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। যখন ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ’ বলে মিম্বারের দিকে তাকাব, কিন্তু নবীজিকে আমার চোখের সামনে দেখব না, তখন আমার পক্ষে এটা সহ্য করা সম্ভব হবে না… তবুও সাহাবিরা তাকে পিড়াপীড়ি করল; কিন্তু বিলাল নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।
কোনোভাবেই নবীজির বিরহ সহ্য করতে পারেন না বিলাল। একসময় মদিনা ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। অনেক দূরে। দিমাশকের খাইলানে। ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন সবকিছু থেকে। দিমাশকেই ছিলেন। সেখানেই কাটছিল তার বিরহী সময়। একরাতে তার দুঃখ ঘুচে এলো; অথবা বৃদ্ধি পেল বিচ্ছেদ ব্যথা। তিনি নবীজিকে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি দেখলেন, নবীজি তাকে বলছেন
-বিলাল, তোমার এখনো সময় হয় নি আমার সাথে দেখা করার? স্বপ্ন দেখে তিনি দ্রুত রওনা হলেন মদিনার পথে। তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে প্রচণ্ডভাবে। নবীজি কি তার ওপর গোস্বা করলেন? দিমাশকে এসে তিনি কি নবীজিকে কষ্ট দিলেন? রাসুলের রওজা মুবারকে পৌঁছে অঝোরে কাঁদলেন তিনি। হুঁশ হারিয়ে ফেললেন। 
নবীজির দৌহিত্র হাসান হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা সংবাদ পেয়েছেন। সাইয়িদুনা বিলাল মদিনায় এসেছেন। তাদের দেখামাত্র তিনি আরও বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। নবীজি তাদের কপালে, মাথায় বার বার চুমু খেতেন।
দুই ভাই হাসান এবং হুসাইন রা. অনুরোধ করলেন। খুব করে অনুরোধ করলেন তারা। মদিনায় এলান হলো— বিলাল আগামীকাল ফজরের আজান দেবেন। ফজরে আজান শুরু করলেন তিনি। তার সুরেলা কণ্ঠ ভাসতে লাগল প্রতিটি বাসায়;—এমনকি পুরো মদিনায়। পরিচিত, শুধু পরিচিতই না, অতি পরিচিত কণ্ঠ শুনে সমস্ত লোক বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। কান্নার রোল পড়ে গেল চারদিকে। যারা নবীযুগের আজান শুনেছিল এবং যারা শুধু বিলালের নাম শুনেছিল—তাদেরও হেঁচকি উঠে গেল।
বিলাল রা.-এর কান্না দমকে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। তিনি যখন শাহাদাতের বাণী পাঠ করতে করতে পবিত্র রওজায় আঙুলের ইশারা করছিলেন, তখন এক হৃদয়-বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।
ঘরের নারীরাও আজান শুনে থাকতে পারলেন না। ঘরে থাকার মতো ধৈর্য তাদের হলো না। অধৈর্য হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। যেন নবীজি ফিরে এসেছেন। এই তো—সেই সুমধুর আজানের ধ্বনি! সবই যে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন ছিল…!
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইনতিকালের পর মদিনায় এমন দৃশ্য আর দেখা যায় নি। এটাই ছিল বিলালের শেষ আজান। মসজিদে নববিতেই শুরু। নববিতেই শেষ….।
  • বই: প্রায়শ্চিত্ত 
  • প্রকাশনায়: দারুল ইলম 
  • ছবি ক্লিক: Azmin Akther Eva
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?