পাখিয়াল : কাজী সাইফুল ইসলাম | Pakhiyal – Kazi Saiful Islam

  • বই : পাখিয়াল – পাঠ প্রতিক্রিয়া! + রিভিউ 
  • লেখক : কাজী সাইফুল ইসলাম
  • প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষের করা
  • ISBN : 9789847767895
  • Edition : 1st Edition, 2022
  • Number of Pages : 158
  • প্রকাশনী : ঐতিহ্য
  • মুদ্রিত মূল্য : ৩২০টাকা
Pakhiyal - Kazi Saiful Islam

❝মানুষের জীবন কি চক্রের মত? চক্রের কোন শুরু নেই, শেষও নেই। মানব জীবনও কি তাই? রহস্যময় চক্রের ভেতর এই জীবন ঘুরপাক খেতে থাকে? শুরু নেই শেষ নেই। চক্র ঘুরছে। এই চক্রের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে অপেক্ষা করে কেউ কেউ। কিংবা সকলেই। কিসের অপেক্ষা?❞

হুমায়ূন আহমেদ তার ❝অপেক্ষা❞ উপন্যাসে এ কথাটি বলেছিলেন। আসলেই কি তাই? আমরা কি চক্রের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছি?
মজিদ পাখিয়াল, প্রথম জীবনে যে ছিল এক সংগ্রামী। সময়টা ছিল ইংরেজদের শাসনের। মজিদের মতো কতো তরুণ জিন্নাহ আর গান্ধীর ডাকে এক হয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য লড়াই করেছিল। পাহাড়তলির গ্রামে চেনা পরিবেশে ছিল মজিদের বসবাস। সুরমাকে ভালোবেসে জীবন সাথী করে নেয় সে।
সুরমা। এক কোমল, নরম মেয়ের প্রতিচ্ছবি। মজিদকে বিয়ে করে সুখের ঘর বাঁধে সে। কিন্তু সুখ তো চিরস্থায়ী নয়। ঝলমলে দিনের পরেই তো অন্ধকার আসে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে সংঘটিত ক্লাব হামলার জের ধরে ইংরেজরা হানা দেয় পাহাড়তলিতে। আটক হয় কত শত স্বদেশী। মজিদ পালিয়ে যায়। শুরু হয় যাযাবর জীবন। সঙ্গী হয় সুরমা।
পথের প্রতিকূলতা, জীবন-মৃত্যুর খেলা, বেঁচে থাকার তাগিদ সব মিলে মজিদ-সুরমা জুটি এসে বাসা বাঁধে থুইচাপারার খিয়াংদের গ্রামে। পাহাড়ি জীবন শুরু করে। শুরুতে কঠিন লাগলেও পরে তা অভ্যেসে পরিণত হয়।
সংগ্রামী থেকে মজিদ হয় পাখিয়াল। নানা তরিকায় পাখি শিকারে সে একদম সিদ্ধহস্ত। সুরমা বোবা প্রাণী কষ্ট দিয়ে মারার বিপক্ষে। একজনের কষ্ট কি অন্যজনের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় আজ অথবা কাল?
বিধাতার জীবনচক্রের খেলায় মজিদ জীবনের মানে, স্রষ্টার আশীর্বাদ খুঁজতে পথে বেড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ে মার্থিয়াস-শৈমের কাছে লালিত পালিত হতে থাকে মজিদের ছেলে হাফিজ।
ইংরেজদের থেকে মুক্ত হয়ে তৈরি হয় ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান নামক দুটি দেশ। ২২০০ কিলোমিটার দূরে থেকেও বাংলাদেশ হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ। মুক্তি মিলবে কি?
লেখাপড়া শিখতে পাহাড়ি জীবনের ইতি টেনে মজিদ হাফিজকে নিয়ে আসে ঢাকায় তার বোনের বাড়িতে। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা স্থান ত্যাগ করে হাফিজ অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবন যেখানে যেমন, সেভাবেই নিজেকে বদলে ফেলতে হয়। হাফিজও শহুরে জীবন, লেখাপড়া আর কুরআন শিক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে। সঙ্গী হিসেবে পায় বিপ্লবকে।
বিপ্লবের মা শিউলি। গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন এক নারী। জীবন যেন তাকে অসীম দুঃখ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। ডায়েরীর পাতায় কলম ঘষে তুলে রেখেছে তার মনের গহীনের কথা, না পাওয়ার দুঃখ।
দেশ ভাগ হয়েও সুখ মিলে না বাঙালিদের। ইংরেজদের শোষণ শেষে আবার পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণে পড়তে হয়। ভাষার দাবিতে উত্তাল হয় রাজপথ।
মজিদ যাযাবর হয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়ায়। তার আর দেখা মেলে কি? সময় বয়ে যায় নিজস্ব গতিতে।

পাঠ প্রতিক্রিয়া:

গ্রুপে আয়োজিত ❝পাখিয়াল❞ এর রিভিউ প্রতিযোগিতা থেকে প্রথম বইটার নাম জানতে পারি। রিভিউ দেখে বইটা লিস্টে টুকে নিই।
লেখকের প্রথম বই পড়লাম। দেশভাগ পূর্ব ইংরেজদের হঠানোর আন্দোলন, দেশ ভাগ, পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই এর মাঝে একজন মজিদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে বইটিকে সাজিয়েছেন।
যাযাবর জীবন, সেখানে জীবনের খাঁটি অর্থ খুঁজে বের করা, পথে প্রান্তরে ঘুরে নানা রকমের মানুষের সাথে সময় কাটানো, জীবনবোধ সব নিয়ে প্রতিটি অধ্যায়ে সুন্দর সুন্দর শিরোনামে বইটি সাজিয়েছেন লেখক। যাযাবরদের জীবনের বর্ণনা পড়ে মনে হয়েছিল আসলেই তো! এটাই তো জীবন। জীবনের মানে, ন্যায়-অন্যায়বোধ বিচারে ইসলামের খলিফাদের উদাহরণগুলো ছিল এক কথায় অসাধারণ। 
উপন্যাসের কাহিনি থেকে মানুষের জীবন দর্শন, জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা, ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের সত্যিকার মানে, মানুষের মাঝে সম্প্রীতি এই ব্যাপারগুলো বেশি আলোকপাত করেছেন লেখক।
জন্ম না দিয়েও কি মা হওয়া যায়? তার উদাহরণ শৈমে আর রাহেলার থেকে বোঝা যায়। রাহেলা, যার উদরে একটি সন্তানও নেই সে এক সময় দুই সন্তানের মায়ের ভূমিকা পেয়ে যায়। আপন করে নিতে পারলে আপন হয় না কে?
মার্থিয়াসের মতো উদার একটি চরিত্র এই উপন্যাসে অন্য মাত্রা দিয়েছে। সুরমার মতো কোমল চরিত্রের এক নারী যাকে স্নিগ্ধতারই স্বরূপ হিসেবে ভাব যায়।
জীবনবোধে পূর্ণ বইটি পড়তে সময় খুব ভালো কেটেছিল। তবে কিছু এডাল্ট বর্ণনা ছিল সেসব না আনলে খুব ক্ষতি হতো না। শেষটা আরেকটু পরিণত হতে পারত। সমাপ্তি একটু খাপছাড়া লেগেছে। 
প্রচ্ছদ:
ধ্রুব এষের করা এই প্রচ্ছদটা খুবই সুন্দর। চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।

স্পয়লার বিহীন পাখিয়াল বই রিভিউ

পৃথিবীতে মায়ের ওপরে কেউ ভালোবাসতে পারে না। সন্তানও তার মাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বায়েজিদ বোস্তামির কথা আমাদের সবারই মনে আছে। কিন্তু মায়ের মতো করেও তো অন্য কেউ ভালোবাসতে পারে। নিজের সন্তান না তবুও তো সবটা উজাড় করে দিতে পারে কেউ কেউ। অথবা যে ছেলে কোনোদিন মায়ের আদর কাকে বলে জানেনি তার কাছে মা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তার উত্তর কেমন হবে? সে কী মায়ের সেই আবেগের কথা টের পাবে? 
বলছিলাম কাজী সাইফুল ইসলাম রচিত পাখিয়াল বইটির কথা। এ বইয়ের বর্ণনা যেরকম সুখপাঠ্য ছিল সেরকম এর দর্শনও ছিল ভাবগম্ভীর! আমাদের পৃথিবী একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে চলে। এমনকি সৃষ্টির প্রত্যেকটা বস্তুই এই কার্যসিদ্ধি পালন করে চলে। প্রত্যেকটা আঘাতের বা বিপদের নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ থাকে। যা জানে একমাত্র স্রষ্টা। যার যার স্রষ্টাই হোক না কেন একটা বিন্দুতে তিনি একজনই। পাখি মারলে লোকে বলে বোবা প্রাণীদের কষ্ট দিতে হয় না অথচ মাছও কিন্তু কথা বলতে পারে না। 
সেক্ষেত্রে অবাধে মাছ মারা হয়। পাখি গান গাইতে পারে বলে তার দিকে কিছুটা সিমপ্যাথি আসে কিন্তু মাছের কোনো নিদর্শন নেই বলে মাছ মারায় কোনো ক্ষতি নেই। 
এ সবকিছুর বর্ণনা পরে দেব আগে চলুন ঘুরে আসি আখ্যানে। 

আখ্যান

পাখিয়াল মজিদ। স্বদেশী হওয়ার কারণে ইংরেজদের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালায়। সাথে করে নিয়ে যায় প্রাণের প্রিয় স্ত্রীকে। গিয়ে ওঠে পাহাড়ে। সেখানে পরিচয় হয় বিভিন্ন গোত্রের সাথে৷ পরিচিত হয় মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সাথে। বেঁচে থাকার জন্য শিকার করে। শহুরে জীবনের বাইরেও যে একটা জীবন থাকতে পারে তার শিক্ষা পায় মজিদ। হারায় অজস্র মানুষকে, আবার অনেক মানুষকে পেয়েও যায় যাদেরকে পুরো জীবনেও ভুলতে পারে না।
সৃষ্টিতত্ত্বের এই লীলাখেলায় মজিদ শুধু অভিনয় করে যায় বাকি খেলাটুকু খেলে বিধাতা। 

মূল রিভিউ

অতীতের বর্ণনায় বর্ণিত পাখিয়াল বইটি অনেকগুলো দর্শনকে একসাথে করে যেন দার্শনিক একটা উপাখ্যান হয়ে উঠে এসেছে আজকের এই সমাজে। লেখক চেয়েছেন গল্পের মাধ্যমে ইতিহাস, মায়া, ভালোবাসা, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, জাতি, স্থান, কাল, পাত্রভেদে তুলে আনতে। তিনি সফল হয়েছেন। বইটির মধ্যে আমি একটি সমাজকে খুঁজে পেয়েছি যে সমাজে অনেকেই ডুবে যেতে চায়। সমাজ ছাড়াও সবচেয়ে বড়ো যে বিষয়টি বইতে ছিল তা হলো ত্যাগের মহিমা। কে কতটুকু ত্যাগ করতে পারে তার উপর আমাদের জীবনের অনেককিছু নির্ভর করে। কোনো কিছু পেতে হলে আমাদের অনেক কিছুকেই ত্যাগ করতে হয়। ভালো খেতে হলে ভালো খাটার ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ভালো কিছু করতে হলে সেই পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়। কাউকে ভালো রাখতে গেলে কাউকে খারাপ রাখার ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। 
স্বদেশী আন্দোলন ছিল ইংরেজদের কাছ থেকে ভারত মুক্তির প্রথম দিককার আন্দোলন। সেসময় অনেক স্বদেশীকেই ইংরেজরা হত্যা করেছিল। অনেক স্বদেশী নিজ পাড়া-মহল্লা থেকে বিতাড়িত হয়েছিল৷ হারিয়েছিল আপনজনদের। হারাতে হয়েছিল অনেক পরিচিত মুখ। সেই তেমন মানুষদের মতোই একজন ছিল মজিদ। নিজ মা বাবাকে হারিয়েছিল অনেক আগেই। পাহাড়তলী গ্রামে থাকাকালীন একদিন পালিয়ে বিয়ে করে সুরমাকে।
সেসময়ের সমাজ কতটা ভয়ানক হতে পারে তা টের পেয়েছিলাম মজিদের মতো আমিও। তবুও সে সময়ের বিয়ের মর্যাদাকে মানুষ মূল্যায়ন করতো। 
একসময় তাদের সুখের জীবনে আসে ইংরেজ। স্বদেশী উদঘাটন করতে খুঁজতে থাকে মজিদকে। কারণ মজিদ একজন স্বদেশী। মজিদ বুঝতে পারে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে আর রক্ষে হবে না। 
কেটে পড়ে পাহাড়তলী থেকে। সেখান থেকেই মজিদ চেনে জীবনের আসল সংজ্ঞা। পরিচিত হয় বিভিন্ন যাযাবরের সাথে। পরবর্তীতে স্ত্রীকেও নিয়ে আসে তার সাথে। 
তাদের সঙ্গী হয় পাহাড়ের জনগোষ্ঠী। 
আমাদের মতো শহুরে মানুষদের কাছে যেমন পাহাড় কোনো থাকার জায়গা হতে পারে না বলে মনে হয় ঠিক তেমনি পাহাড়ের জনগোষ্ঠীদের কাছেও শহর থাকার পরিবেশ হতে পারে না বলেই মনে হয়। প্রথমে বলেছিলাম না আমাদের জীবনের একটা চক্র রয়েছে যা একইভাবে চলতে থাকে? সেই চক্রের দেখা পায় মজিদ আর সুরমা পাহাড়ে গিয়ে। পাহাড়ের মানুষেরা কতটা সরল হয় তার বর্ণনা সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক৷ 
প্রকৃতির কাছে প্রত্যেকটা জীবের কেন যাওয়া উচিৎ তা এই বই না পড়লে হয়তো বুঝতাম না। 
পৃথিবীতে কোনো সুখই স্থায়ী না। মজিদ দম্পতির কাছেও তা এসে ধরা দেয়। তবে সেই ধরায় মজিদের অপকারের চাইতে উপকারই বেশি হয় বলে মনে করি। 
একসময় দেশভাগ হয়। বর্ডার তৈরী হয়। স্রষ্টার জমিন ভাগ হয়। কিন্তু দেশ ভাগ হলেও কি বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছিল? পাকিস্তানের কবলে থেকে যায় দেশ। প্রথমে ইংরেজরা দাপিয়ে বেড়ায় প্রায় দুশো বছর তারপর দাপায় পাকিস্তান। মুসলীম লীগের সব মুখোশ উন্মোচন হয়ে পরে ভারত স্বাধীনতার পর। খোলস থেকে বেরিয়ে আসে মুসলীম লীগ। চাপাতে থাকে বাংলায় জুলুমের বোঝা। 
বাঙালি মানতে নারাজ। ইংরেজরা প্রথমেই বুঝেছিল বাংলা থেকে স্বাধীনতার ডাক আসতে পারে তাই তারা ধর্মের বীজ বপন করে দিয়েছিল ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে। সেই বীজের ফলন দেখা দেয় ১৯৪৭ এর পর। তবে একটু অন্যরকম হয়ে। মুসলিম বনাম মুসলিম হয়ে। 
বইতে একদিকে স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত যেভাবে এগিয়ে গেছে তেমনি একই ধারায় এগিয়ে গেছে মজিদের কাহিনি নিয়ে। মজিদের সাথে যুক্ত হয়েছে তার ছেলে এবং তাদের সাথে যুক্ত হয় আরও অনেক মানুষ। যাদের প্রত্যেকের একেকটা আলাদা জীবন রয়েছে। ভাগ্য এমন এক জিনিস যে কোনো কোনো সময় যারটা খুলে যায় তার সবদিক দিয়েই খুলে যায় আবার যারটা বন্ধ হয় তার সবদিক দিয়েই বন্ধ হয়। দেখা যায় একটা সন্তান তিনটা মা পেয়ে যায় আবার একটা সন্তান তার একমাত্র মা’কেও হারায়। মায়ার টানে মানুষ সবকিছু ছাড়তে পারে। এমনকি পৃথিবীও। 
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার থেকে শুরু করে সূর্য সেন আবার বাইবেল থেকে মার্কসবাদ সব কিছুরই একটা আপেক্ষিক মিল রেখেছেন লেখক বইতে৷ 

লেখনশৈলী

লেখনশৈলী দারুণ লেখকের। বিশেষ করে প্রকৃতি বর্ণনা করার ক্ষমতা লেখকের মাঝে নিদারুণ ভাবে উপস্থিত রয়েছে বলে মনে করি। তাঁর বর্ণনায় প্রকৃতির প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বিষয় উঠে এসেছে। সেসময়ের বঙ্গ সমাজ। সে সময়ের পাহাড়ের মানুষদের জীবন যাপন বিশেষ করে যাযাবরদের জীবন কীভাবে যাপিত হতো তার বিস্তর আলাপ তিনি করে দিয়েছেন এই বইতে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় অতিরিক্ত মনে হতে পারে তবে তা সুখপাঠ্য হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে আমার কাছে। 
সবচেয়ে দারুণ বর্ণনা করেছেন তিনি পাহাড়ের অঞ্চলগুলোকে। এছাড়াও জিপসিদের খাবার বা ম্যাজিকের বর্ণনা, প্রত্যেকটা যাযাবরদের কাহিনি, মাঝে মাঝে দর্শন মূলক গল্প, কুরআনের উদ্ধৃতি, বাইবেলের উদ্ধৃতি, বুদ্ধের গল্প ইত্যাদি মেলবন্ধন দারুণভাবে করেছেন লেখক। 

চরিত্রায়ন

বইতে উল্লিখিত প্রত্যেকটা চরিত্র ছিল বলার মতো। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা নিজ স্বার্থ পরখ না করে অন্যের উপকার করেন। তেমনই এক চরিত্র হচ্ছে মার্থিয়াস। নিজের দিকে যে খেয়াল না করে সব রকম বিপদ আপদ থেকে মুক্ত করেছেন মজিদ এবং তার স্ত্রী সুরমাকে। অথচ এক যাযাবরের কথায় মজিদ মার্থিয়াসের শরণাপন্ন হয়েছিল। কোনোরকম পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও নিজ গোত্রের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল মার্থিয়াস। 
রিভিউর প্রথমে বলেছিলাম যে ত্যাগের মহিমা না থাকলে মানুষ হওয়ার মর্যাদা থাকে না। সেই ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করলে সবচেয়ে প্রথমে যে চরিত্রের কথা মনে পড়ে তা হলো শৈমে। নিজের বুকের থেকে যে নিজ সন্তানের আহার আরেকজনকে দিতে পারে তাকে ত্যাগের মহারানী বানালেও বুঝি এতটুকু কম হয়ে যায়। 
এছাড়াও রয়েছে বিপ্লবের মতো মমতা না পাওয়া ছেলের চরিত্র, রয়েছে শিউলির মতো অবলা নারী। শেষদিকে এই দুটো চরিত্রের জন্য চোখে পানি চলে এসেছিল। পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন। 
আব্দুর রহমান নামক এক চরিত্রের একটা অতীত আছে। 
সেই অতীত মজিদের অতীতের চাইতেও বেদনাদায়ক। 

উপসংহার

অনেক স্পয়লার এড়িয়ে গিয়েছি। সামাজিক উপন্যাসের স্পয়লার তেমন একটা না থাকলেও এই বইটার রয়েছে। দুঃখ, হাসি, সুখ, কান্না, মায়া, মমতা ইত্যাদি সবকিছুর মিশ্রনে বইটি এককথায় দারুণ। স্বদেশী আন্দোলনের সময় এমন হাজারো মজিদ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল পালিয়ে। অনেকে ফিরেছিল নিজ গৃহে, অনেকে আবার হারিয়েও গিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর হয়তো তাদের আত্মারা খুশি হয়েছিল। ইংরেজদের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আরেক ‘ইংরেজ’ ভাষা কেড়ে নিতে চাইলে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার ছেলেরা। তেমনই একজন হাফিজ। কে এই হাফিজ এবং মজিদের সাথে এর কী সম্পর্ক তা জানতে হলে পড়া দরকার বইটি। 
বইয়ে সমালোচনার দিক তেমন না থাকলেও বানান ভুল ছিল কিছু। বইয়ের ৯৮ পৃষ্ঠায় আব্দুর রহমানের জায়গায় হাফিজ নামটা ভুলবশত চলে এসেছে। 
বইতে কিছু কিছু জায়গায় প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় রয়েছে। তবে তা খুবই অল্প। নিতান্তই না দিলে নয় এমন তবুও সেসব বিষয় প্রাপ্তবয়স্ক না হলে এড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ রইলো।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?