পলের স্ত্রী প্রায় সাত-আট বছর ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ। অনেকটা পঙ্গু হয়ে একটা নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলেন। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে বড়ো আর ছেলে ছোটো।
মেয়েটি তার বয়ফ্রেন্ড এবং এক কন্যা সন্তানসহ পর্তুগালে বাস করতেন। প্রায় বছর দশেক আগে এক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে সেখানেই মারা যান। তার বয়ফ্রেন্ড মেয়েসহ সেখানেই বসবাস করছেন। নতুন গার্লফ্রেন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন স্থানীয় পর্তুগিজ এক নারীকে।
পলের একমাত্র ছেলের নাম ‘অ্যালান’। অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া ও একরোখা ছিল সে। কলেজের পর্যায় শেষে পল তাকে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে বলেছিলেন, কিন্তু সে তো বাবার অনুগত ছেলে নয়। কোথায় কী করবেন, সিদ্ধান্তটা সে-ই নেবে। ভার্সিটিতে ভর্তির আগে সে বিশ্বটা ঘুরে দেখতে চেয়েছিল। এজন্য সে কানাডা, আমেরিকাও বেড়িয়ে এসেছে কয়েক বছর আগে।
এরপরও সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি। পড়াশোনা শুরুর আগে তার আরও সময়ের প্রয়োজন। একটা শর্ট ট্রিপে স্পেন, ইতালিও বেড়িয়ে এসেছে। মাত্র মাস দুয়েক বাড়িতে থাকল, তারপরই বান্ধবীসহ ছুটল দক্ষিণ আফ্রিকায়।
বাবা-মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। মাঝেমধ্যেই সে এ রকম করত। কোথাও গেলে দিনের পর দিন বেখবর থাকত। দুশ্চিন্তায় কাতর বাবা-মা মুখিয়ে থাকতেন একটু ফোনের জন্য।
সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে বিশ্ব্যবাপী যোগাযোগ সহজ হলেও সর্বত্র বিস্তৃতি ঘটেনি। ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে তুলনামূলক প্রসারতা থাকলেও দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের সে রকম সহজলভ্যতা ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলিগ্রাম ও স্যাটেলাইট টেলিফোন। নেটওয়ার্ক ভালো থাকলে কথা বোঝা যেত বা শোনা যেত, তা না হলে নয়।
কাজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে; বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশ ও জনপদে যোগযোগ করাটা ছিল খুবই কষ্টকর। ফলে ছেলের সাথে পল দম্পতির যোগাযোগ হতো দীর্ঘ বিরতির পর।
কয়েক মাস পেরিয়ে গিয়েছে। ছেলের কোনো খবরাখবর পাননি তারা। পাহাড়সম দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে মনের মধ্যে। এমন অবস্থায় একটা পার্সেল এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পলের স্ত্রী অ্যাশলির নামে।
সেই আফ্রিকার লিসোথো থেকে ছেলেটি তার মাকে একটা হার পাঠিয়েছে। সামুদ্রিক শামুক, কড়ি, কোনো পশুর দাঁত আর হাড় দিয়ে খুব সুন্দর করে বানানো। পার্সেলে থাকা স্কার্টটাও দেখার মতো। নানা রকম উজ্জ্বল বর্ণের ছোট্ট ছোট্ট কাপড়ের টুকরো জোড়া দিয়ে তৈরি। শ’খানেক ছবিসহ ছোট্ট একটা অ্যালবামও ছিল তাতে।
আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ছেলের ঘুরে বেড়ানোর ছবি। পাহাড়ের খাড়া বেয়ে ট্রাকিং করে ওপরে উঠা, হাতির পিঠে বসে ঘন বনের ভেতরে সরু রাস্তা দিয়ে সোজা চলে যাওয়া পথের মাঝে সহাস্য মুখের স্থিরচিত্র। কোনো এক হ্রদে পানির নিচে স্কুবা ডাইভিং, আকাশ থেকে প্যারাসুট জাম্পিং করে নিচে অবতরণের বিষয়টিও বাদ যায়নি।
পার্সেলের সাথে দু’কলম হাতে লিখে দিলে কী অমন ক্ষতি হতো? স্ত্রী অ্যাশলির এমন ক্ষোভে পল কোনো কথা বলেননি।
তাই তো! দু’কলম লেখার সময় কি তার হয়নি? বাবা-মা ওই উপহারটুকুই চেয়েছেন। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের শূন্য হৃদয়ের হাহাকার দেখে না। চেষ্টাও করে না অনেকে। কবে যে তারা বুঝতে শিখবে!
ছেলেটি ছিল মায়ের ভক্ত। বাবার সাথে তার খুব একটা সখ্যতা ছিল না। কথাও হতো খুব কম। বিনা প্রয়োজনে ছেলেটা পলকে এড়িয়েই চলত। সন্তানের এমন আচরণের কোনো কারণ পিতা জানতেন না। অনেক ভেবেও সেটা বুঝতে পারেননি।
তবে এটা নিয়ে তার কোনো ক্ষোভও ছিল না। মনে মনে কিছুটা কষ্ট যে পেতেন নাÑতা নয়। তারপরও কোনো অনুযোগ ছিল না। ভেবেছিলেন, ছেলেমানুষ; একসময় ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া তার মায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তো আছে; সেটা থাকলেই হলো।
সেই পার্সেল আসার কারণে তারা অন্তত এটা জানতে পেরেছিলেন, ছেলেটি ভালো আছে এবং সুস্থ আছে। তারপর দীর্ঘ প্রায় আট মাস নিরুদ্দেশ। কোনো খবর নেই ছেলের পক্ষ থেকে।
আট মাস পরের ঘটনা। ডেভিড হার্টলপুলে রিজিওনাল হেড অফিসে গিয়েছেন ম্যানেজারদের এক বৈঠকে অংশ নিতে। বৈঠকের মাঝখানে হঠাৎ করে একটা ফোনকল।
অপরিচিত নম্বর, তা ছাড়া প্রোগ্রামে ব্যস্ত তাই প্রথমবার কলটা ধরলেন না। কিছুক্ষণ পরে আবারও ওই একই নম্বর থেকে কল। অনুমতি নিয়ে পল এবারে বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে ফোনটা ধরলেন।
কলটি ছিল নর্থটাইনসাইড জেনারেল হাসপাতাল (খবধাবং) থেকে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো-পলের স্ত্রী অ্যাশলি স্ট্রোক করেছেন। এইমাত্র হাসপাতালে আনা হয়েছে। অজ্ঞান ও আশঙ্কাজনক আবস্থায় রয়েছেন।
বৈঠক বাদ দিয়ে পল ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। সেখানে তার জন্য আরও বড়ো একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল।
স্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হলো। তার শ্যালিকাকে দেখামাত্রই খোঁজ নিচ্ছিলেন, এমন পরিস্থিতি কীভাবে হলো? স্ত্রীকে সুস্থই তো রেখে এসেছেন বাড়িতে!
তবে যে উত্তরে হৃদয়ে সুনামির সৃষ্টি হয়, দেহ পাথর হয়, সূর্যের দীপ্ত আভায় আলোকিত দুনিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, এমন উত্তরের জন্য কোনো বাবা-মা-ই প্রস্তুত থাকেন না….
ধরণীর পথে প্রান্তে বই থেকে