- বইঃ নৈর্ঋত
- লেখকঃ জাহিদ হোসেন
- প্রথম প্রকাশঃ মার্চ ২০২২
- প্রচ্ছদঃ মাহতাব রশীদ
- অলংকরণঃ ওয়াসিফ নূর
- পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫২০
- মূল্যঃ ৭০০ টাকা
গ্রিক মিথলজি অনুসারে, প্যান্ডোরা পৃথিবীর সর্বপ্রথম নারী। অলিম্পাসের দেবদেবীরা তাকে বিভিন্ন গুণ দিলেন, দেবতারাজ জিউস দিলেন কৌতুহল, আর একটি রহস্যময় বাক্স- সাথে নির্দেশ এই যে, বাক্সটি কোনোভাবেই খোলা যাবে না। নিষিদ্ধ বলেই হয়তো, কৌতুহল না আটকাতে পেরে প্যান্ডোরা একদিন বাক্সটি খুলে ফেলেন, সাথে সাথে বাক্সের ভেতর বন্দি থাকা দুঃখ, শোক, জরা, লোভ একে একে বেরিয়ে এসে সৃষ্টি করে বিপর্যয়। প্যান্ডোরা পরিস্থিতি সামাল দিতে বাক্স আটকে ফেলেন, আর বাক্সের সবচেয়ে নিচে থাকা আশা তখন বাক্সে আটকে যায়। প্যান্ডোরার বাক্সের এই কাহিনির সাথে মিথিলা ফারজানার মৃত্যুর কি সম্পর্ক থাকতে পারে, যেখানে প্যান্ডোরার বাক্স মিথ আর মিথিলা ফারজানা বাস্তব পৃথিবীর মানুষ!
শুরুটা একটি মৃত্যুকে ঘিরে। মিথিলা ফারজানা নামের এসএসসি পরীক্ষার্থীর খন্ডিত লাশ পাওয়া যায়। হাত পা মাথা কাটা, পরিচ্ছন্নভাবে বস্তার মোড়কে সাজিয়ে ট্যাগও লাগিয়ে দেওয়া, সাথে ২৯টি লেজবিহীন টিকটিকি, একফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট নেই- যেন শুষে নিয়েছে কেউ, ঘাড়ে অদ্ভুত ট্যাটু আর চিরকুট। চিরকুটে লেখা, লিজার্ড কিং ফিরে এসেছে। ঘটনাচক্রে রহস্যভেদে জড়িয়ে পড়ে মিথিলার চার সহপাঠী। সমাধান কি খুঁজে পাবে তারা, নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে কানাগলিতে? প্যান্ডোরার বাক্স যদি মিথই হয়ে থাকে, মিথ কিভাবে বর্তমানে ফিরবে? কেন ফিরবে?
চারজন টিনএজ ছেলেমেয়ে রহস্যভেদে নামলেও এটাকে কিশোর উপন্যাস বলা যাবেনা একদমই, কিশোরদের চাইতে বরং প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক বোধহয় বেশি উপভোগ করবেন বইটি। ফাঁকে ফাঁকে এমনভাবে নতুন সাব-টুইস্ট কাহিনীতে চলে এসেছে যে ঝিমিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। আর শেষের টুইস্ট যাকে বলে যথাযথ ছিলো, এমন, যেটা ভাবতেই পারিনি আমি! লেখকের গিলগামেশ বইটিতে ‘কাঁপে কাঁপে আমার হিয়া কাঁপে’ যেভাবে মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো, নৈর্ঋতে তেমনি ”Carry me, caravan ” আটকে গিয়েছে। মার্ডার, সাসপেন্স, মিস্ট্রি, ইমোশন, এ্যাটাচমেন্ট, জেলাসি, ফ্রেন্ডশিপ, সব মিলে কমপ্লিট প্যাকেজ বলবো। বাংলার মাঝে ইংরেজি শব্দ শ্রুতিকটু হওয়া স্বত্ত্বেও শব্দগুলো ব্যবহার করলাম, কেননা বাংলায় এগুলো ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারতাম না। আরেকটা জিনিস যেটা ভালো লেগেছে, নব্বই দশকের ঢাকা, আর সেই সময়কার নস্টালজিয়াগুলো দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। এক কথায় বললে বইটি উপভোগ্য, কাহিনীবিন্যাস- প্লট টুইস্ট, সব মিলে ভালো লেগেছে।
নৈর্ঋত শব্দের এক অর্থ দক্ষিণ পশ্চিম কোণ, আরেকভাবে বললে, নৈর্ঋত কোণের অধিপতিকে বলা হয় রাক্ষস। পড়া শেষে পাঠকমাত্রই নামকরণের সার্থকতা ধরে ফেলবেন। এটা এজন্য বললাম, শুরু থেকেই আমার মাথায় ঘুরছিলো বইয়ের নাম নৈর্ঋত কেন! শেষে গিয়ে উত্তর পেয়েছি।
৫২০ পৃষ্ঠার বড়সড় বই হওয়ার পরও একটানা পড়ে যাওয়া মতোই বইটি।
⬛ স্পয়লার এ্যালার্টঃ
সব মিলে উপভোগ্য হলেও কিছু প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে পাঠক হিসেবে। এবার সেগুলো বলি। স্পয়লার চলে এসেছে, তাই যারা বইটি পড়েননি তারা এই অংশটুকু এড়িয়ে যেতে পারেন।
১. শুরু থেকে যেভাবে ২৯ বছর আগের ভয়াবহ পাপের উল্লেখ আছে, তাতে ব্যাপারটাকে ভীষণ শক্ত কিছু ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষে এসে ব্যাপারটাকে নিতান্তই সাদামাটা লেগেছে।
আশিকুর রশীদের মৃত্যু হয় ১৯৭৪ সালে, অর্থাৎ ২৯ বছর আগে। বইয়ের শেষাংশে উল্লেখ আছে শাহানা আর শিউলি আশিককে পছন্দ করতেন স্কুল জীবন থেকে। আশিক মারাও যায় স্কুলে পড়া অবস্থায়।
২৯ বছর আগে শিউলি বোধহয় স্কুলে পড়তো, যেহেতু আশিক তার স্কুল সহপাঠী। স্কুলে থাকতে তো তৃতীয়বার কিংকে সে ডাকেইনি, ডেকেছে ভার্সিটিতে এসে। তাহলে আশিক কেন মারা গেলো?
বই অনুযায়ী, তৃতীয়বার লিজার্ড কিং কে ডাকার জন্য প্রিয় কাউকে উৎসর্গ করতে হয়, অন্যথায় কাছের মানুষরা মারা যাবে। আমার প্রশ্ন, শিউলি তো তৃতীয়বার লিজার্ড কিং কে ডেকেছে ভার্সিটিতে পড়া অবস্থায়, তাহলে স্কুল-কলেজের সময়কার প্রিয় মানুষেরা কেন মারা গেলো? তখনো তো শিউলি কিং এর পূজারি হয় ও নি! আর এমন উল্লেখও ছিলো না যে কিং কে ডাকলেই প্রিয় মানুষের ক্ষতি হবে! তো এই শুরুর দিকের তিনটি মৃত্যুর ব্যাখ্যাতে ঘাটতি রয়ে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
২. তানভির জামানের মৃত্যুর সাথে লিজার্ড কিং এর সম্পর্ক নেই। গল্পে জটিলতা আনা ছাড়া এই ঘটনার কোনো উপযোগিতা পাইনি। হয়তোবা না থাকলেও কাহিনিতে প্রভাব পড়তো না কোনো।
পাঠক হিসেবে এই দুটো ব্যাপারে আমি উত্তর মেলাতে পারিনি। বিশেষ করে প্রথম পয়েন্টটাতে। তবে এটুকু বাদ দিলে, বইটি ভালো লেগেছে।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?