নামাজ : যেমনটি তিনি চান লেখক : ড. রাগিব সারজানী | Namaz Jemonti Tini Chan By Dr. Ragib Sarjani

বই : নামাজ : যেমনটি তিনি চান

লেখক : ড. রাগিব সারজানী
প্রকাশনী : মাকতাবাতুল হাসান
বিষয় : সালাত/নামায
পৃষ্ঠা : 452
ভাষা : বাংলা

নামাজ : যেমনটি তিনি চান লেখক : ড. রাগিব সারজানী | Namaz Jemonti Tini Chan By Dr. Ragib Sarjani
ছবি : নামাজ : যেমনটি তিনি চান

নামাজ যেমনটি তিনি চান বলতে মহান আল্লাহ তায়ালাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে অর্থাৎ নামাজ যেমনটি তিনি চান মানে মহান আল্লাহ চান যেভাবে আমরা নামাজ পড়ি। এটি একটি নামাজ সম্পর্কিত বই এই বইটি রচনা করেছেন জনপ্রিয় ইসলামী লেখক ড. রাগিব সারজানী। যদিও নামাজ আমরা নামাজ নামাজ পড়ি কিন্তু আমরা কজন জানি কিভাবে নামাজ আদায় করলে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো তা জানতে পড়ুন। নামাজ যেমনটি তিনি চান লেখক : ড. রাগিব সারজানী। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
واستعينوا بالصبر والصلوة وإنّها تكبيرة الاعلى الخشعين –
আর ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য লাভ করো। নামাজকে অবশ্যই কঠিন মনে হয়, কিন্তু তাদের পক্ষে (কঠিন) নয়, যারা খুশু (অর্থাৎ ধ্যান ও বিনয়) -এর সঙ্গে পড়ে।
[সুরা বাকারা : ৪৫]
আমরাও নামাজ পড়ি; মসজিদে, বাড়িতে কিংবা কর্মস্থলে। নামাজের জন্য প্রতিদিনই আমরা আমাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করি। রুকু-সেজদা, তাসবিহ-তাহলিল ও অন্যান্য রোকনগুলো আদায় করি প্রত্যেক নামাজে। কিন্তু আমরা কি নামাজের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করতে পারি? আমরা কি নামাজে আমাদের চোখের শীতলতা অনুভব করি? যেমনটি অনুভব করতেন আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!
একজন মুসলিম হিসাবে এমনটি আমাদের সকলেরই কাম্য। আমরাও চাই, নামাজের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসুক। নামাজ হোক আমাদের চোখের শীতলতা।
এই বইটি নামাজবিষয়ক হলেও নামাজ শিক্ষার গতানুগতিক কোনো আলোচনা এতে নেই। কারণ, বইটি নামাজের নিয়মকানুন শেখানোর উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি; লেখা হয়েছে নামাজের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরার জন্য। আমরা যেমন নামাজ পড়ি, আর আমাদের প্রভু যেমন নামাজ প্রত্যাশা করেন আমাদের থেকে—এসব নিয়েই মূলত এ বইয়ের আলোচনা। বইটির লেখক ড. রাগিব সারজানি। তিনি তার অনবদ্য রচনাশৈলী ও জাদুময়ী উপস্থাপনার মাধ্যমে বইয়ের প্রতিটি বিষয়কে পাঠকের সামনে প্রাণবন্ত করে তুলে ধরেছেন।
সম্পাদনার সুবাদে পুরো বইটি বেশ কয়েকবার পড়ার সুযোগ হয়েছে আমাদের। লেখক এত চমৎকার সব বিষয় এতে তুলে ধরেছেন, যা আমাদের সামনে চিন্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। লেখক বইটির এক অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্বের কথা বলেছেন মহান স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টির কথা। উপস্থাপন করেছেন অবাক করা বহু তথ্য ও তত্ত্ব। আরেক অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন নামাজে একাগ্রতা অর্জনের স্তর ও পদ্ধতির কথা। এভাবে চমৎকার ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয় দিয়ে লেখক বইটির সবগুলো অধ্যায় এমনভাবে সাজিয়েছেন, যা পড়ে যেকোনো মুসলিমের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠবে। নামাজ তো অনেক পড়েছি জীবনে, এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি! স্রষ্টার সামনে এমন বিনয় ও একাগ্রতার উপলব্ধি নিয়ে তো নামাজে দাঁড়াইনি কখনো! কিন্তু আমার প্রভু তো এমন নামাজই চান আমাদের কাছে! নামাজের প্রতিদান ও পুরস্কারের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, তা অর্জনের জন্য এভাবেই তো নামাজ পড়তে হবে আমাদের!
আফসোস হলো অনেক, আরও আগে যদি বইটি হাতে পেতাম! এই বইয়ে নামাজের যে বিবরণ ও বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, আমাদের অতীতের নামাজগুলোও যদি এমন হতো!
তবে দেরিতে হলেও এমন একটি বইটি হাতে পেয়েছি, এজন্য মহান
আল্লাহর কাছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা। বইটি আমরা যথাসম্ভব নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্তভাবে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবুও ভুলভ্রান্তি থেকে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। কোনো ভুল আপনাদের আমাদের দৃষ্টিগোচর হলে অবশ্যই তা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নেওয়া হবে। ইনশাআল্লাহ।
আমাদের বিশ্বাস, বইটি পড়ার পর নামাজে আপনি অন্যরকম এক অনুভূতি খুঁজে পাবেন। পূর্বের তুলনায় নামাজে আপনার একাগ্রতা বেড়ে যাবে বহুগুণ। যখনই আপনি নামাজের জায়নামাজে দাঁড়াবেন, আপনার উপলব্ধি হবে, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন আপনার মহান রবের সামনে। তিনি আপনাকে দেখছেন। আপনার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন। নামাজে থেকে আপনি যা বলছেন, সবকিছুরই উত্তর দিচ্ছেন তিনি।
তখন নামাজ হবে আপনার কাছে প্রশান্তির ঠিকানা। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তির উপলক্ষ। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কবুল করুন। আমিন!!
বিনীত —সম্পাদক
২২ মার্চ ২০২২ খ্রি.
আমার এক বন্ধু একবার নামাজে তার অবস্থা সম্পর্কে আমার কাছে অভিযোগ করলেন। তিনি জানালেন, নামাজে কুরআন তেলাওয়াতের সময় কিছুতেই তিনি তার মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। নামাজ শুরু করা মাত্রই এমন সব বিষয়ের কথা তার স্মরণ হয়, যেগুলো নিয়ে মনের অজান্তেই ভাবতে থাকেন তিনি। একসময় এভাবেই তার নামাজ শেষ হয়ে যায়। এমন আরও অনেক বিষয়ের কথা তিনি বললেন, যেগুলো তিনি নামাজের আগে অনেকবার স্মরণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, কিন্তু নামাজে দাঁড়াতেই সেগুলো তার স্মরণে এসে যায়!
তিনি আমাকে বললেন, এটি আমার অনেক দিনের পুরোনো সমস্যা, প্রায় সময় এগুলো নিয়ে আমি চিন্তিত হই।
আমি তাকে ধীরকণ্ঠে বললাম, ভাই, এটা মূলত এক ভয়াবহ রোগের উপসর্গ! আপনার প্রকৃত সমস্যা শুধু নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যদিও নামাজের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সমস্যা এর চেয়েও অনেক ভয়াবহ। আপনার এই উপসর্গ খুবই বিপজ্জনক; তবুও আমি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করছি যে, আপনি এটা নিয়ে অভিযোগ করছেন। অর্থাৎ আপনি এটা নিয়ে চিন্তিত। ইনশাআল্লাহ, এটাই হবে আপনার সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ।
তিনি আমার কথায় কিছুটা দ্বিমত করে বললেন, ডাক্তার সাহেব, এটা আবার কোন রোগ! আলহামদুলিল্লাহ, আমি তো ভালো আছি। আল্লাহর সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিমাণ উত্তম সম্পর্ক রয়েছে। আমার প্রতিপালক আমাকে সর্বদা সম্মানিত করেন। কিন্তু একটি সমস্যা আছে, সেটা হলো, নামাজে আমার মনোযোগ থাকে না। আমি মনে করি, নামাজে আরেকটু মনোযোগী হলেই সমস্যা কেটে যাবে। আমি এই বিষয়টাকে তেমন ভয়াবহ ভাবছি না। আমি তাকে বললাম, আপাতত এই আলোচনা বাদ দিই। আমরা বরং এমন একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে পর্যালোচনা করি, যার মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরে
নিন, আপনি আপনার অফিসের বস কিংবা ম্যানেজারের নিকট প্রমোশনের আবেদন কিংবা ছুটির অনুমোদন বা আপনার শাস্তি বা বহিষ্কারযোগ্য কোনো ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে গেলেন। এই অবস্থায় আপনি কি তার সঙ্গে উদাসীন ও অমনোযোগী হয়ে কথা বলবেন, নাকি আপনার সর্বোচ্চ মনোযোগ থাকবে তার দিকে?
আমার সঙ্গী নিশ্চুপ হয়ে রইলেন, যেন একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন তিনি!
আমি তাকে বললাম, আচ্ছা আপনি এই দৃষ্টান্তটিও রাখুন। বরং আসুন, আমরা সামনের সমস্যাটির সমাধান বের করার চেষ্টা করি।
ধরে নিন, আপনার ওপর একজন সম্মানিত ব্যক্তির বহু অনুগ্রহ রয়েছে, কিন্তু কোনো কারণে আপনি তার অধিকার ক্ষুণ্ন করেছেন। তার পছন্দনীয় বিষয়ে আপনি তার বিরোধিতা করেছেন এবং তার অপছন্দনীয় কাজ করেছেন। এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন তার থেকে আপনার কিছু টাকাপয়সা ধার নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য তাকে ছাড়া আপনি আর কাউকে পাচ্ছেন না। তাহলে আপনি নিজের কথাগুলো কীভাবে তাকে গুছিয়ে বলবেন, যেন আপনার অপরাধ থাকা সত্ত্বেও তিনি আপনাকে ধার দিতে রাজি হন?
আমার বন্ধু এবারও নিশ্চুপ রইলেন। কোনো কথা বললেন না; কিংবা আমতা আমতা করে কিছু হয়তো বললেন, কিন্তু আমি তা বুঝতে পারলাম না।
আমি তাকে বললাম, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের বরং আমল করা উচিত। এরকম প্রায়ই ঘটে। আমরা সকলেই এমন সমস্যার মুখোমুখি হই। আসুন, আমরা ধার পাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখি—
অবশ্যই আমরা প্রথমে আমাদের প্রতি তার পূর্বের অনুগ্রহগুলোর কথা স্বীকার করব। এরপর আমরা তার সেই দয়া ও অনুগ্রহের প্রশংসা করব, যে অনুগ্রহের কথা সবাই জানে।
অতঃপর আমাদের ভুলের কথা স্বীকার করে স্পষ্টভাবে কাকুতিমিনতি করব এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব যে, আর কখনো এমন করব না।
এরপর যখন আমাদের প্রবল ধারণা হবে যে, তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট
হয়েছেন, তখন আমরা আশা নিয়ে তার নিকট নতুন করে ধার চাইব। তিনি যদি আমাদের ধার দেন, তাহলে আমরা তার অনেক প্রশংসা করব। কারণ, তিনি আমাদের অনুরোধ রক্ষা করেছেন, পূর্বে তার সঙ্গে অপরাধ করা সত্ত্বেও তিনি আমাদের নতুন করে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছেন।
আর যদি তিনি আমাদের ঋণ দিতে সম্মত না হন, তাহলে আমরা তাকে বলব, এটা একান্তই আপনার অধিকার সম্পদের মালিক আপনি। আমরা অপরাধী। আমরা আপনার নিকট ঋণ চেয়েছি নিজেদের উপযুক্ত মনে করে নয়; বরং আপনার দয়া ও অনুগ্রহের আশা করে।
অতঃপর আমি আমার বন্ধুকে বললাম, আপনি কি এই দৃষ্টান্ত এবং এর রহস্য বুঝতে পেরেছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ— বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন করণীয় কী?
আমি বললাম, খুবই সহজ। এখন এই দৃষ্টান্ত এবং রহস্য আল্লাহ তাআলার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ওপর প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমরা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হব। ইনশাআল্লাহ।
আমরা যখন আমাদের অফিসের বস কিংবা ম্যানেজারের নিকট কোনো কিছুর আবেদনের জন্য, কিংবা কোনো বিষয়ের অনুমোদন অথবা ক্ষমা প্রর্থনার জন্য যাই, তখন আমাদের যে উপলব্ধি থাকে, আমরা যদি তার কাছাকাছি উপলব্ধি নিয়েও নামাজে দাঁড়াতাম, তাহলে নিশ্চয় নামাজে আমাদের বিনয় ও একাগ্রতা আরও অনেক বেশি হতো!
আমরা যদি আমাদের প্রতিপালকের নিকট এই প্রত্যাশা নিয়ে নামাজ শুরু করতাম যে, দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করবেন; যদিও আমরা তার অনেক অবাধ্যতা করেছি।
তিনি আমাদের অনেক দোষত্রুটি গোপন রেখেছেন। আমাদের প্রতি অনেক সহনশীলতা দেখিয়েছেন। আমরা তার নিকট যা চেয়েছি, তার চেয়ে আরও বেশি তিনি আমাদের দান করেছেন। তিনি ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই, আমাদের আর কোনো আশ্রয় নেই—–আমরা যদি এই মনোভাব নিয়ে তার নিকট ড়াতে পারতাম, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের নামাজে বিনয় ও একাগ্রতা চলে আসত।
একজন ডুবন্ত ব্যক্তি কিছুতেই তার রক্ষাকর্তার দিকে অবহেলা ও
উদাসীনতার সঙ্গে হাত বাড়ায় না! বস্তুত, আমাদের এসব উদাসীনতা একটিমাত্র বিষয়ের দিকেই নির্দেশ করে। সেটা হলো আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের অন্তরে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানবোধ না থাকা।
এটা কি ভয়াবহ বিষয় নয়?
বরং এটা এমনই এক ব্যাধি, যার রয়েছে অনেকগুলো উপসর্গ। যেমন, নামাজ, দোয়া কিংবা কুরআন তেলাওয়াতে অন্তরের মধ্যে বিনয় ও একাগ্রতার স্বল্পতা।
দুনিয়ার প্রতি অতি ভালোবাসা, দুনিয়ার শোভা-সৌন্দর্যে মত্ত থাকা এবং অন্তরের ওপর এর প্রভাব বিস্তার করা।
গুনাহকে ছোট মনে করা এবং তুচ্ছ ভাবা। মৃত্যুকে ভুলে থাকা এবং এর জন্য কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ না করা।
ভালো কাজে উদাসীনতা ও শৈথিল্য দেখানো।
তাহাজ্জুদ পড়ার প্রতি অলসতা।
কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি অমনোযোগিতা। ফলে আমরা কেবল রমজানেই
কুরআন খতম করি।
জিহাদ থেকে বিরত থাকা। এমনকি জিহাদের আলোচনা থেকেও দূরে সরে থাকা।
সত্য বলা থেকে চুপ থাকা।
এসব ছাড়াও আরও অসংখ্য উপসর্গ রয়েছে। তবে আমি মনে করি, যে উপসর্গগুলোর কথা উল্লেখ করেছি এগুলোর মাধ্যমেই পর্যবেক্ষণটি স্পষ্ট হয়ে গেছে!
আমাদের উচিত, নামাজের একাগ্রতাকে নিছক নামাজ আদায়ের ‘সৌন্দর্য’ হিসাবে না দেখা; বরং এটাকে বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার প্ৰতি ‘সম্মান প্ৰদৰ্শন’ হিসাবে গণ্য করা। ফলে, আল্লাহর প্রতি যখন আমাদের সম্মান বৃদ্ধি পাবে, তখন নামাজে আমাদের একাগ্রতাও বেড়ে যাবে। তখন যদি আল্লাহর নিকট আমরা এই প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদের পুরস্কার প্রদান করেন, আমাদের ক্ষমা করেন, আমাদের সম্মানিত করেন এবং রিজিক প্রদান করেন তাহলে এটা এক যৌক্তিক বিষয় বলে গণ্য হবে। অন্যথায় উদাসীন মন, বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক এবং এমন অলস শরীর নিয়ে নামাজে প্রবেশ করা, যা সঠিকভাবে দাঁড়াতে ও সুন্দরভাবে সেজদা করতে সক্ষম নয়; অতঃপর দীর্ঘ সময় দোয়া করা— আল্লাহর শপথ! এটা এক সীমাহীন নির্বুদ্ধিতা! আমরা সকলেই অন্তরকে জিজ্ঞেস করে দেখি, সেজদার দোয়াই কেন সবচেয়ে আশাজাগানিয়া দোয়া? কেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد فأكثروا الدعاء» সেজদারত অবস্থায় বান্দা তার প্রতিপালকের সবচেয়ে বেশি নৈকট্য অর্জন করে। অতএব, তোমরা (সেজদারত অবস্থায় ) অধিক পরিমাণে দোয়া করো।
আমি এই হাদিসে এমন এক মহান হেকমত দেখতে পাই, যা আমাদের নিকট নামাজের প্রকৃতি তুলে ধরে এবং বান্দা ও তার রবের মাঝের সম্পর্কের ধরন বর্ণনা করে। তবে এই হেকমতটি উপস্থাপনের পূর্বে আসুন আমরা এমন একটি সমস্যার কথা আলোচনা করি, যে সমস্যাটি আমাদের প্রায় সবার মধ্যেই রয়েছে।
কিছু কিছু নামাজি কয়েক মিনিট আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে, নামাজের নামে কিছুক্ষণ ওঠাবসা ও নড়াচড়া করে ভাবে যে, সে তার ওপর অর্পিত সব দায়িত্ব আদায় করে ফেলেছে। এখন তার ‘অধিকার’ হয়েছে, প্রভুর কাছে তার সব ইচ্ছা সে ব্যক্ত করতে পারে।
প্রিয় পাঠক, আপনি কে?
আপনি কি প্রতিপালকের দাসত্বের মর্ম বোঝেন? আসুন আমরা হাদিসের এই ভাষ্যগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখি। অবশ্যই এগুলো আমাদেরকে দাসত্বের মর্ম জানতে সাহায্য করবে। ইনশাআল্লাহ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আবু যর রা. বর্ণনা করেন, হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
১. সহিহ মুসলিম, ৪৮২; সুনানু আবি দাউদ, ৮৭৫; আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ি, ৭২৩; আল মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ৯৪৪২
হে আমার বান্দারা, আমি আমার নিজের সত্তার ওপর জুলুমকে হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের ওপর তা হারাম বলে ঘোষণা করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।
হে আমার বান্দারা, তোমরা সবাই ছিলে দিশেহারা, তবে আমি যাকে সুপথ দেখিয়েছি সে ব্যতীত। তোমরা আমার কাছে হেদায়েত প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের হেদায়েত দান করব।
হে আমার বান্দারা, তোমরা সবাই ক্ষুধার্ত, তবে আমি যাকে আহার করিয়েছি সে ব্যতীত। তোমরা আমার কাছে আহার চাও, আমি তোমাদের আহার করাব।
হে আমার বান্দারা, তোমরা সবাই বস্ত্রহীন, তবে আমি যাকে পরিধান করাই সে ব্যতীত। তোমরা আমার কাছে পরিধেয় চাও, আমি তোমাদের পরিধান করাব।
হে আমার বান্দারা, তোমরা রাতদিন অপরাধ করে থাকো, আর আমিই সব অপরাধ ক্ষমা করি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেবো। হে আমার বান্দারা, তোমরা কখনো আমার অনিষ্ট করতে পারবে না, যাতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হই এবং তোমরা কখনো আমার উপকার করতে পারবে না, যাতে আমি উপকৃত হই।
হে আমার বান্দারা, তোমাদের আদি তোমাদের অন্ত, তোমাদের মানুষ ও জিনজাতির মধ্যে যার অন্তর আমাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও, তাতে আমার রাজত্ব বিন্দু পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে না।
হে আমার বান্দারা, তোমাদের আদি, তোমাদের অন্ত, তোমাদের সকল মানুষ ও জিনজাতির মধ্যে যার অন্তর সবচেয়ে পাপিষ্ঠ, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও, তাতে আমার রাজত্ব বিন্দু পরিমাণও কমবে না।
হে আমার বান্দারা তোমাদের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সব এবং মানুষ ও জিন যদি কোনো বিশাল মাঠে দাঁড়িয়ে সবাই আমার কাছে কিছু চায়, আর আমি প্রত্যেকের চাহিদা পূরণ করি, তাহলে আমার
কাছে যা আছে তা থেকে ততটুকুও কমবে না, কেউ সমুদ্রে একটি সুঁই ডুবিয়ে দিলে, সমুদ্র থেকে যতুটুকু (পানি) কমে।
হে আমার বান্দারা, আমি তোমাদের আমলগুলোই তোমাদের জন্য সংরক্ষিত রাখি। এরপর পুরোপুরিভাবে তার বিনিময় প্রদান করে থাকি। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো কল্যাণ অর্জন করে, সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে। আর যে কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু পায়, সে যেন নিজেকেই দোষারোপ করে। (২)
আপনার নিকট অনুরোধ, খুবই ধীরতার সঙ্গে এই হাদিসটি কয়েকবার পড়ুন। আপনি কি জানেন, আবু ইদরিস খাওলানি রহ. (৩) যখন এই হাদিস বর্ণনা করতেন, তখন তিনি আল্লাহর প্রতি তার সীমাহীন ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে নিজের দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসতেন। (৪)
এবার কি আপনি বান্দা এবং অর্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন? আপনি কি বুঝতে পেরেছেন নামাজের অন্তর্নিহিত মর্ম? এমনইভাবে আরেকটি হাদিস নিয়েও আমাদের কিছু চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন। আবু হুরাইরা রা. বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«لن يدخل أحدا عمله الجنة قالوا ولا أنت يا رسول الله قال لا ولا أنا إلا أن يتغمدني الله بفضل ورحمة فسددوا وقاربوا ولا يتمنين أحدكم الموت إما محسنا فلعله أن يزداد خيرا وإما مسيئا فلعله أن يستعيب»
২. সহিহ মুসলিম, ২৫৭৭; সুনানুত তিরমিজি, ২৪৯৫; সুনানু ইবনি মাজাহ, ৪২৫৭; আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ২১৪০৫
৩ আবু ইদরিস খাওলানি পুরো নাম আবু ইদরিস খাওলানি আইয়ুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর আওযি দামেশকি (৮-৮০ হিজরি মোতাবেক ৬৩০-৭০০ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি ছিলেন প্রথম যুগের একজন তাবেয়ি ও ফেকাহবিদ। তিনি দামেশকবাসীর উপদেশদাতা, ওয়ায়েজ এবং ফাযালা ইবনে উবাইদের পর আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের যুগ পর্যন্ত মুআবিয়া ও তার ছেলের পক্ষ থেকে বিচারক ছিলেন। সিয়ারু আলামিন নুবালা লিয-যাহাবি, ৪/২৭২-২৭৭, আল-ওয়াফি বিল-ওয়াফায়াত লিস-সফাদি, ১৬/৩৪০; আল-ইসতিআব লি-ইবনি আবদিল বার, ২/৮০০, ৪/১৫৯৪
8 সহিহ মুসলিম, ২৫৭৭; সহিহ ইবনি হিব্বান, ৬১৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, ১৭২ (৪৯০)
তোমাদের কোনো ব্যক্তিকে তার নেক আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। লোকজন প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল, আপনাকেও নয়?
তিনি বললেন, আমাকেও নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে তার করুণা ও দয়া দিয়ে ঢেকে না নেবেন। সুতরাং সঠিক পথে চলো এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কেননা সে ভালো লোক হলে (বয়স দ্বারা) তার নেক আমল বৃদ্ধি হতে পারে। আর খারাপ লোক হলে, সে তওবা করার সুযোগ পেতে পারে। (৫)
আপনি কি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলের সঙ্গে আমাদের আমলের তুলনা করতে পারবেন? আমরা সকলে একমত যে, একজন নিষ্পাপ রাসুল—–—যিনি সকল রাসুলের শ্রেষ্ঠ–(৬) এবং এমন বান্দাদের মাঝে কোনো তুলনা চলে না, যারা প্রতিনিয়ত গুনাহ করে বেড়ায়। যিনি রবের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত, তিনিই যখন মনে করেন আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া তিনি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না। ফলে তিনি তার অস্তিত্বের প্রতিটি অণুকণা দিয়ে তার অনুগ্রহ প্রত্যাশা করেন, তাহলে কীভাবে আমরা আমাদের নামাজে এমন যথেষ্ট ইবাদতকারীর উপলব্ধি নিয়ে প্রবেশ করি, যেন আমাদের জন্য (ক্ষমার) প্রতিশ্রুতি এসে গেছে; বরং আমরা তো অনেক সময় এর চেয়েও আরও অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করি!
এখন এই হাদিসটি নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করে দেখি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
সবার শেষে যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বের হবে এবং সবার শেষে যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার সম্পর্কে আমি জানি—
• সহিহ বুখারি, ৫৩৪৯; সহিহ মুসলিম, ২৮১৬ আবু সাইদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি আদমসন্তানদের সর্দার, তাতে গর্বের কিছু নেই। কেয়ামতের দিন প্রথম আমার জন্য জমিন বিদীর্ণ হবে (কবর থেকে প্রথম আমিই উঠব), এতে গর্বের কিছু নেই। আমিই হব প্রথম শাফায়াতকারী এবং সর্বাগ্রে আমার শাফায়াত কবুল করা হবে। এতেও কোনো গর্ব নেই। কেয়ামতের দিন আল্লাহর প্রশংসার পতাকা আমার হাতে থাকবে। এতেও গর্বের কিছু নেই। সূত্র: সুনানু ইবনি মাজাহ, ৪৩০৮
এক ব্যক্তি হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় জাহান্নাম থেকে বের হবে। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, যাও, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত পূর্ণ হয়ে গেছে। তখন সে ফিরে আসবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক, জান্নাত তো পূর্ণ দেখতে পেলাম। আবার আল্লাহ বলবেন, যাও, জান্নাতে প্রবেশ করো। তখন সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত পূর্ণ হয়ে গেছে এবং সে ফিরে আসবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক, জান্নাত তো পূর্ণ দেখতে পেলাম। তখন আল্লাহ বলবেন, যাও, জান্নাতে প্রবেশ করো। কেননা তোমার জন্য রয়েছে দুনিয়ার সমতুল্য জান্নাত এবং তারও ১০ গুণ । অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুনিয়ার ১০ গুণ। তখন লোকটি বলবে, আপনি কি আমাকে উপহাস করছেন, অথচ আপনিই আমার মালিক? (বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন,) আমি তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমনভাবে হাসতে দেখলাম যে, তার মাড়ির দাঁত প্রকাশিত হয়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, এটা জান্নাতিদের সর্বনিম্ন অবস্থা। (৭)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আল্লাহ তাআলা সেই বান্দার উত্তরে বলবেন, আমি তোমার উপহাস করছি না; বরং আমি যা চাই, তা করতে সক্ষম। (৮)
পৃথিবীতে কোনো মানুষ হয়তো দাবি করতে পারে যে, সে আপনার সব প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম। আপনার সব আকাঙ্ক্ষা সে বাস্তবায়ন করে দেবে। পৃথিবীতে আপনি যা-কিছু প্রত্যাশা করেন, তার সবই সে আপনাকে প্রদান করবে। কিন্তু এমন মানুষ কে আছে, যে পরকালের কোনো বিষয় সম্পর্কে তার সক্ষমতার দাবি করবে? আমরা সকলেই নিশ্চিতভাবে জানি ও স্বীকার করি, কেয়ামতের এই ভয়াবহ দিনে সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের একমাত্র অধিকারী হবেন আল্লাহ তাআলা। সেখানে কোনো মাখলুকের (সৃষ্টিজীবের) সামান্যতমও অংশীদারি থাকবে না। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেন,
সহিহ বুখারি, ৬২০২; সহিহ মুসলিম, ১৮৬ ৮. সহিহ মুসলিম, ১৮৭; আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ৩৮৯৯
يوم هم برزون لا يخفى على الله منه شيء من الملك اليوم يله
الوحد القهار
যেদিন তারা সকলে প্রকাশ্যে এসে যাবে। আল্লাহর কাছে তাদের কোনো কিছুই গোপন থাকবে না। (বলা হবে) আজ রাজত্ব কার? (উত্তর হবে একটিই যে,) কেবল আল্লাহর, যিনি এক, পরাক্রমশালী।
[সুরা মুমিন ১৬]
আপনি এখানে প্রভুর অনুগ্রহ ও ক্ষমতার দিকে লক্ষ করুন। তিনি ছাড়া কেউ সেখানে কিছু প্রদান করতে সক্ষম নয়। তিনি যদি কাউকে অতি সামান্যও দেন, তবুও মানুষ তা সন্তুষ্ট হয়ে গ্রহণ করে। অথচ সর্বনিম্ন নেয়ামতপ্রাপ্ত জান্নাতের অধিবাসীকেও তিনি প্রদান করবেন ১০ দুনিয়ার সমপরিমাণ! এই হলো ক্ষমতা, অনুগ্রহ এবং প্রভুত্ব!
পরিশেষে, সেজদায় দোয়ার বিষয়ে আলোচনায় ফেরার আগে আমরা কিছুক্ষণ রবের সঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্জন আলাপচারিতায় তার বিনয় ও একাগ্রতার কিছু চিত্র দেখে আসি। যেন আমরা সেই স্তরটি চিনতে পারি, যার সঙ্গে আমাদের তুলনা করা উচিত এবং জানতে পারি সেই মানদণ্ড, যার অনুপাতে সবকিছু পরিমাপ করা আবশ্যক। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কারও ওপর যখন কোনো বিপদ ও দুঃখ আপতিত হয়, তখন যদি সে বলে, হে আল্লাহ, আমি তোমার বান্দা, তোমার বান্দার পুত্র, তোমার বাঁদির পুত্র। আমি তোমার হাতের মুঠোয়, আমার অদৃষ্ট তোমার হাতে। তোমার হুকুম আমার ওপর কার্যকর, তোমার আদেশ আমার পক্ষে ন্যায়। আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি তোমার সেসব নামের অসিলায়, যেন তুমি নিজেকে অভিহিত করেছ অথবা তোমার সৃষ্টির কাউকে তা শিক্ষা দিয়েছ, অথবা যা তোমার কিতাবে অবতীর্ণ করেছ, অথবা অদৃশ্যের পর্দায় যা তোমার কাছে গোপন রেখেছ। তুমি কুরআনকে আমার অন্তরের বসন্ত বানিয়ে দাও, আমার হৃদয়ের আলো করে দাও, আমার দুঃখ ও চিন্তা দূর করার উপায় বানিয়ে দাও। (এই কথাগুলো বললে) আল্লাহ তখন তার চিন্তা ও কষ্ট দূর করে দেবেন এবং এর পরিবর্তে সেখানে প্রশান্তি দান করবেন। (৯) বর্ণনাকারী বলেন, এ সময় বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, এটা কি আমরা শিখে নেব না?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, এটা যে শুনবে, তার জন্য এটা শিখে নেওয়া উচিত। (১০) আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দোয়া পড়ে দোয়া করতেন,
«رب اغفر لي خطيئتي وجهلي وإشرافي في أمري كله وما أنت أعلم به مني اللهم اغفر لي خطاياي وعمدي وجهلي وهزلي وكل ذلك عندي اللهم اغفر لي ما قدمت وما أخرت وما أسررت وما أعلنت أنت المقدم وأنت المؤخر وأنت على كل شيء قدير
হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমা করে দিন আমার গুনাহ, আমার অজ্ঞতা, আমার কাজের সব বাড়াবাড়ি এবং আমার যেসব গুনাহ আপনি আমার চেয়ে অধিক জানেন। হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমা করে দিন আমার ভুলত্রুটি, আমার জানা-অজানা এবং রসিকতার ছলে যত গুনাহ করেছি, যা আমার মধ্যে আছে। হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমা করে দিন আমার পূর্ববর্তী, পরবর্তী, প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য গুনাহ। আপনিই অগ্রগামী করেন, আপনিই পশ্চাদ্বর্তী করেন এবং আপনিই সব বিষয়ের ওপর সর্বশক্তিমান। (১১)
আমাদের উচিত, পূর্বে উল্লেখিত দোয়াগুলো আরেকবার পাঠ করে নেওয়া,
যেন আমরা আল্লাহর নিকট রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখাপেক্ষিতা এবং কাকুতিমিনতির পরিধি অনুধাবন করতে পারি। একবার ভেবে দেখুন তো, এই যদি হয় আল্লাহর রাসুলের অবস্থা, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত?
· মিশকাতুল মাসাবিহ, ২৪৫২
১০. আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ৩৭১২; সহিহ ইবনি হিব্বান, ৯৭২; আল-মুজামুল কাবির লিত-তবারানি, ১০৩৭৪
১. সহিহ বুখারি, ৬০৩৫; সহিহ মুসলিম, ২৭১৯
এবার আমরা পুনরায় সেই প্রশ্নের দিকে ফিরতে পারি, কেন সেজদার দোয়া অন্য দোয়া থেকে কবুল হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রাখে, এর হেকমত বা রহস্য কী?
বাস্তবতা হলো, নামাজের কার্যাবলির মধ্যে সেজদাবনত হওয়া আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশি বিনয়প্রকাশক। সেজদার মাঝে মাটিতে সেই কপাল ঠেকানো হয়, যা দ্বারা মানুষ গর্ব করে। সেই নাকও সেজদা করে, যার দ্বারা মানুষ অহংকার প্রকাশ করে। এটি এমন এক অবস্থা, রুচিশীল ও সম্ভ্রান্ত কোনো ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারও জন্য এমনটি করতে সম্মত হয় না। এ কারণে এটা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার প্রতি দাসত্বের সর্বোচ্চ প্রমাণ। বান্দা যখন এটা বুঝতে পারে, তখন তার প্রার্থনা দ্রুতই কবুল করা হয়। এ কারণে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وإذا سألك عبادي عني فإني قريب أجيب دعوة الداع إذا دعان
(হে নবী,) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন যে,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে, আমি তার ডাক শুনি।
[সুরা বাকারা : ১৮৬] অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার অতি নিকটবর্তী। কিন্তু যে ব্যক্তি এই সম্পর্কের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে না, কীভাবে সে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারবে?
তবে আমি মনে করি, নামাজের মধ্যে সেজদাকে দোয়া কবুলের সবচেয়ে নিকটবর্তী মুহূর্ত সাব্যস্ত করার পেছনে আরও একটি সুন্দর ও সূক্ষ্ম রহস্য রয়েছে। সেটা হলো, সেজদা হলো একটি রাকাতের সর্বশেষ আমল। প্রতিটি রাকাতের তাকবির, ফাতিহা, কেরাত, রুকু এবং হামদ—–—এই সবগুলো আমল যেন এমন একটি ভূমিকা, যেন আপনি আল্লাহ তাআলার উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করেন, তার বড়ত্ব স্বীকার করেন) একে একে সব কাজ সম্পন্ন করে অবশেষে আপনি সেই সেজদায় উপনীত হন, যাতে আপনি আল্লাহর নিকট আপনার আশা-প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
ইতিপূর্বে আমরা যে উদাহরণ উপস্থাপন করেছিলাম, আমরা যদি এখন সেদিকে মনোযোগ ফেরাই—–—যেখানে আমরা এমন এক মহানুভব সত্তার নিকট ঋণ প্রার্থনা করছিলাম, আমরা যার অধিকার ক্ষুণ্ন করেছি—তাহলে নামাজের এই পুরো রাকাতটি সেই চেষ্টা-প্রচেষ্টার মতো হবে, যা আমরা উপস্থাপন করছি আমাদের ভুলের ক্ষমাপ্রাপ্তির আবেদনের জন্য, তাঁর প্রশংসা ও মর্যাদা প্রকাশের জন্য, নিজের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা প্রকাশের জন্য। আমরা যেন পরিশেষে এমন একটি স্থানে পৌঁছতে পারি, যেখানে আমরা অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই মহানুভব সত্তার নিকট আমাদের আকাঙ্ক্ষার কথা প্রার্থনা করব।
এ কারণেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদার মধ্যে আমাদের বেশি বেশি দোয়া করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«فأما الركوع فعظموا فيه الرب عز وجل وأما السجود فاجتهدوا في
الدعاء فقمن أن يستجاب لكم» আর তোমরা রুকু অবস্থায় মহান প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব বর্ণনা করবে আর সেজদারত অবস্থায় অধিক দোয়া পড়ার চেষ্টা করবে। কেননা (সেজদায়) তোমাদের দোয়া কবুল হওয়ার উপযোগী। (১২)
আমরা রুকুর মধ্যে দোয়া করি না। কারণ আমরা যখন রুকু করি তখনও সেই কাজগুলো সম্পন্ন করা হয় না, যেগুলো আমাদের দোয়া কবুলের জন্য সহায়ক হবে। তবে আমরা যখন রুকু করি এবং রাকাতের অন্যসব কাজও সম্পন্ন করি, আল্লাহর বড়ত্ব, প্রশংসা এবং তার নিকট মিনতি প্রকাশ করে সেজদায় এসে দোয়া করি, তখন সেটা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
জেনে রাখা ভালো যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব উপদেশ দিয়েছেন তার জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে, যখন তিনি খুবই অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। এমনকি এই অসুস্থতার মধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করেন। (১৩) এ
১২. সহিহ মুসলিম, ৪৭৯; সুনানু আবি দাউদ, ৮৭৬; আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ি, ২১৮; আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ১৯০০ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. তার বর্ণনার শুরুতে বলেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্দা উঠিয়ে দেখলেন, যখন লোকেরা আবু বকর রা. এর পেছনে নামাজে কাতারবদ্ধ ছিল। এটা রাসুলের জীবনের শেষ সময়ের ঘটনা, যখন আবু বকর রা. মানুষদের ইমামতি করছিলেন।
দোয়াগুলোর সীমাহীন গুরুত্বের প্রতি নির্দেশ করে এবং এটা বোঝায় যে, নবীজি তাঁর রোগের কষ্ট ও ক্লান্তিসত্ত্বেও আমাদের কল্যাণের প্রতি কত বেশি আগ্রহী ছিলেন! (ফলে তার ভীষণ অসুস্থতার মাঝেও তিনি আমাদের কল্যাণের জন্য এই কথাগুলো বলে গিয়েছেন।)
নামাজে সর্বশেষ তাশাহুদের পর দোয়ার প্রচলনও সম্ভবত এই কারণেই হয়েছে। নবীজির সুন্নত হলো, আমরা নামাজে শুধু প্রধান দুই স্থানে দোয়া করব, সেজদায় এবং সালামের পূর্বে তাশাহুদের পরে। অর্থাৎ সেজদা যেমন রাকাতের সর্বশেষ আমল এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদের দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়, তেমনইভাবে তাশাহুদও পুরো নামাজের সর্বশেষ আমল। কারণ তাশাহুদের পূর্ব পর্যন্ত নামাজের প্রতিটি কাজে আমরা আল্লাহ তাআলার অনেক প্রশংসা করেছি। সুতরাং এখন আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনার সময় এসেছে। এ কারণে রাসুলের হাদিসে নামাজের শেষে অনেক দোয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। এই দোয়াগুলো নামাজি ব্যক্তি পাঠ করবে সালামের পূর্বে, তাশাহুদের পরে (১৪)। দোয়া ও তাশাহুদ বিষয়ে আলোচনার সময় এই গ্রন্থে দোয়াগুলো উল্লেখ করব। ইনশাআল্লাহ।
এমনইভাবে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা কেন বিতর নামাজে ‘দোয়ায়ে কুনুত (১৫) পড়ার বিধান দিয়েছেন। অর্থাৎ রাতে আপনার অনেক নামাজ আদায় এবং তাতে আল্লাহর মহত্ত্ব প্রকাশ ও প্রশংসা করার পর, সময় এসেছে প্রার্থনা ও আবেদন করার। সেই প্রার্থনার চিত্রটি একবার কল্পনা করে দেখুন, যা আপনাকে আল্লাহ তাআলার দিকে ধাবিত করে। যেমনটি বর্ণনা করেছেন আলি রা.। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এমন কিছু বাক্য শিখিয়েছেন, যেগুলো আমি বিতর নামাজের কুনুতে বা দোয়ায় পাঠ করি। দোয়াটি হলো,
১. সহিহ বুখারি, ৮০০; সহিহ মুসলিম, ৪০২; তবে এই সময় দোয়া করা আবশ্যক নয়। ১৫. দোয়ায়ে কুনুত : এটি হলো বিশেষ সময়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ার একটি দোয়া। (বিতর নামাজে এটা পড়া হয়) এশার ফরজ নামাজের পর এই বিতর নামাজ আদায় করা হয়। বিতর অর্থ বেজোড়। এই নামাজকে ‘বিতর’ বলার কারণ হলো, এর রাকাতসংখ্যা বিতর বা বেজোড়। এটাই রাতের সর্বশেষ নামাজ। আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ, ২৭/২৮৯ ২৯৯; ৩৪/৫৭, ৬৮; যুহাইলি, আল-ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতাহ, ১/৮০৯-৮২; আল ফিকহু আলাল মাজাহিবিল আরবাআ লিল জাযায়েরি, ১/৩০৫-৩০৮
«اللهم اهدني فيمن هديت وعافني فيمن عافيت وتولني فيمن توليت وبارك لي فيما أعطيت وقني شر ما قضيت فإنك تقضي ولا يقضى عليك وإنه لا يذل من واليت ولا يعز من عاديت تباركت ربنا
হে আল্লাহ, যাদেরকে তুমি সুপথ দেখিয়েছ, আমাকেও তাদের সঙ্গে সুপথ দেখাও, যাদেরকে তুমি নিরাপদ রেখেছ, তাদের সঙ্গে আমাকেও তুমি নিরাপদ রেখো। তুমি যাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ, তাদের সঙ্গে আমারও অভিভাবকত্ব গ্রহণ করো। তুমি আমাকে যা দান করেছ, তার মধ্যে বরকত দান করো। তুমি যা ফয়সালা করেছ, আমাকে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করো। কেননা তুমিই নির্দেশ দিতে পারো, তোমার ওপর কারও নির্দেশ চলে না। যাকে তুমি বন্ধু করেছ, সে কখনো অপমানিত হয় না। আর যাকে তুমি শত্রু করেছ, সে কখনো সম্মানিত হয় না। হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি কল্যাণময়, তুমি সুউচ্চ। (১৬)
অর্থাৎ রাতের সব নামাজের শেষে, কিংবা দিনের সব নামাজের পরে, আমরা দীর্ঘতম দিনের ইবাদতের পরিসমাপ্তি টানছি দীর্ঘ দোয়ার মাধ্যমে। যেখানে আমরা প্রার্থনা করছি হেদায়েত, নিরাপত্তা, অভিভাবকত্ব এবং বরকত। আর এটা করা সংগতও হচ্ছে। কারণ আমরা পূর্বে সব নামাজে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও মহত্ত্ব প্রকাশ করেছি।
এমনইভাবে আমরা সাইয়েদুল ইসতিগফার নামে প্রসিদ্ধ দোয়ার ক্ষেত্রেও চিন্তা করে দেখতে পারি। শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (হে শাদ্দাদ,) সাইয়েদুল ইসতিগফার হিসাবে তুমি বলবে,
«اللهم أنت ربي لا إله إلا أنت خلقتني وأنا عبدك وأنا على عهدك ووعدك ما استطعت أعوذ بك من شر ما صنعت أبوء لك بنعمتك علي وأبوء لك بذنبي فاغفر لي فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت»
১৯. সুনানুত তিরমিজি, ৪৬৪; সুনানু আবি দাউদ, ১৪২৫; আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ি, ১৪৪২; সুনানু ইবনি মাজাহ, ১১৭৮; আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ১৭১৮
হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমার বান্দা। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকারের ওপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নেয়ামত দিয়েছ, তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। নিশ্চয় তুমি ছাড়া গুনাহ মাফ করার কেউ নেই।
এরপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি দিনের বেলায় (সকালে) দৃঢ়বিশ্বাসের সঙ্গে এই ইসতিগফার পড়বে, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যদি সে মারা যায়, তবে সে জান্নাতি হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে (সন্ধ্যায়) দৃঢ়বিশ্বাসের সঙ্গে এই দোয়া পড়বে, ভোর হওয়ার আগেই যদি সে মারা যায়, তবে সে জান্নাতি হবে। (১৭)
তবে কথা হলো, বিশেষভাবে এই দোয়াটিই কেন সাইয়েদুল ইসতিগফার হিসাবে গণ্য হলো?
এর কারণ, এতে এমন উত্তম কিছু শব্দ ও অভিব্যক্তি রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি সেই নেয়ামত প্রদানকারীর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন, যিনি আপনাকে নেয়ামত প্রদান করেছেন আর আপনি তার বিধান লঙ্ঘন করেছেন!
দোয়ার শুরুতে এসেছে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রশংসা। এরপর প্রতিশ্রুতি পূরণের ওপর অটল থাকার ওয়াদা, নিজের গুনাহ ও আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের স্বীকারোক্তি। এরপর ক্ষমাপ্রার্থনা এবং সবশেষে, প্রভুর নিকট নিঃশর্ত আশ্রয় গ্রহণের ঘোষণা, যদিও বান্দা তাঁর বিধান লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু তিনি ছাড়া যে গুনাহ মাফ করার আর কেউ নেই! তিনি ছাড়া আশ্রয় প্রার্থনার আর কোনো স্থান নেই!
কেবল এমন অবস্থায়ই আমরা আশা করতে পারি, আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করবেন। ফলে এই দোয়াটি সাইয়েদুল ইসতিগফার বলে পরিচিতি পেয়েছে। আল্লাহ তাআলাও বান্দার এই ইসতিগফারের প্রতিদান রেখেছেন জান্নাত, এটা বোঝানোর জন্য যে, বান্দার ক্ষমাপ্রার্থনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এতক্ষণের আলোচনা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয় যে, আমাদের অধিকাংশ নামাজি যেভাবে নামাজ পড়ে, তা থেকে এই নামাজের চিত্র অনেক ভিন্ন। অনেক মুসলিম কেবল এজন্য নামাজ পড়ে যে, আল্লাহ তাআলা তার ওপর নামাজ ফরজ করেছেন। ফলে সে অনুভব করে, এটা তার জন্য একটি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সে নামাজ আদায় করে। কোনোরকম নামাজ শেষ করেই সে তার অন্যান্য কাজের জন্য তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়ে। এই মনোভাব কিছুতেই তাকে তার নামাজে একাগ্র হতে দেয় না। তবে হ্যাঁ, যখন সে কোনো সমস্যায় পড়ে বা কোনো বিষয় সমাধানের ভীষণ প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সে খুব একাগ্রতার সঙ্গে নামাজ আদায় করে। সেজদায় পড়ে আল্লাহ তাআলার নিকট কাকুতিমিনতি করে নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করে। এ ছাড়া সাধারণত সে নামাজে বিনীত ও একাগ্র হয় না। সে অনুধাবন করে না যে, পুরো নামাজের মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনের শক্তির সঙ্গেই সংযুক্ত হয়ে আছে দোয়া কবুলের শক্তিমত্তা। আর এটা সংযুক্ত হয়ে আছে অন্তরের মধ্যে আল্লাহ তাআলার মর্যাদার পরিমাণ ও পরিধির সঙ্গে এবং এগুলোই তার নামাজে খুশু বা একাগ্রতার ওপর প্রভাব ফেলে।
কেউ হয়তো ভেবে রেখেছেন, আমি নিশ্চয় নামাজের একাগ্রতাবিষয়ক আমার এই বইটি তাকবিরে তাহরিমার আলোচনা দিয়ে শুরু করব। অতঃপর আলোচনা করব নামাজের অন্যান্য রোকন ও আমলগুলো নিয়ে। হ্যাঁ, বাস্তবেও এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটাই সূচনা নয়; বরং খুশু বা একাগ্রতার প্রথম ও প্রধান উপায় হলো আল্লাহ তাআলার মর্যাদাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা। তারপরই কেবল প্রকৃত নামাজে প্রবেশ করা সম্ভব হবে।
—ড. রাগিব সারজানি কায়রো, মিশর ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
১. সহিহ বুখারি, ৫৯৪৭; সুনানুত তিরমিজি, ৩৩৯৩; আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ি, ৭৯৬৩; আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ১৭১৫২ 
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?