নামাজ : আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম : শাইখ আহমদ ফরিদ | Prayer: The Greatest Means of Obedience: Shaykh Ahmad Farid

  • নামাজ : আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম
  • লেখক : শাইখ আহমদ ফরিদ (মিশর)
  • প্রকাশনী : দারুল আরকাম
  • বিষয় : সালাত/নামায
  • পৃষ্ঠা : 96, কভার : হার্ড কভার

At A Glance

লেখক শাইখ আহমদ ফরিদ রচিত “নামাজ আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম” বইটি মূলত নামাজের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি কিভাবে আনুগত্য প্রকাশ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নামাজ যে আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম তা বোঝাতে গিয়ে লেখক অসংখ্য তথ্য ও উদাহরণ তুলে ধরেছেন এই বইটিতে। বইটির অনুবাদ করেছেন মুফতি মনিরুজ্জামান এবং বইটিতে মূল পৃষ্ঠা সংখ্যা রয়েছে ৯৬।
নিশ্চয়ই নামাজ দ্বীনের মূল স্তম্ভ ও ঈমানের মজবুত রজ্জু। মহান প্রভুর নৈকট্য লাভের প্রধান মাধ্যম ও আনুগত্যতার উজ্জ্বল নিদর্শন। আর নিঃসন্দেহে ইবাদতের মর্যাদা, শক্তিমত্তা ও ফজিলত সম্পর্কে জানা অত্যাবশ্যক। যা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইচ্ছাশক্তিকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তোলে। সুনিপুণভাবে উদ্দেশ্য হাসিলে আপ্রাণ চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করে এবং পরিপূর্ণতা অর্জনে ইবাদতের পূর্বশর্ত আদায়ে পূর্ণতা দান করে। আর আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত সৌভাগ্য প্রাপ্তির নিদর্শন হলো এই যে, বান্দা ইবাদতে নিয়োজিত হওয়ার ব্যাপারে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ, ইবাদত করা তাঁর জন্য সহজ হয়ে যায়।
এমনইভাবে এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, নিশ্চয়ই নামাজ হলো ইবাদতসমূহের মূল ও আনুগত্যতার মুখ্য বিষয়। ইসলামে ব্যক্তির মর্যাদাবান হওয়া, ব্যক্তির নামাজ আদায়ের সৌভাগ্য লাভের ওপর নির্ভরশীল। আর কেউ যদি ব্যক্তির দ্বীনদারি সম্পর্কে জানতে চায়, সে যেন ব্যক্তির নামাজের প্রতি লক্ষ করে । এ মর্মে হজরত হাসান বসরি রহ. বলেন,
إذا هانت عليك صلاتك فما الذي يعز عليك.
‘যখন তোমার নামাজ অবহেলিত হবে, তখন তা তোমাকে লাঞ্ছিত করবে। ‘নামাজ : আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম’ নামক এই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থটি আমার নিজের জন্য এবং আমার মুসলিম ভাইদের জন্য নামাজের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপের ব্যাপারে এক মহা মূল্যবান উপদেশগ্রন্থ এবং নামাজের মধ্যে একাগ্রতা বৃদ্ধির এক অনন্য মাধ্যম ও গাইডলাইন। আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহে আমি এই গ্রন্থটি নিয়ে আশাবাদী যে, তিনি আমাকে ও আমার মুসলিম ভাইদেরকে নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করবেন। 
নিশ্চয়ই নামাজ তাঁর নির্ধারিত সময়ই আদায় করা উচিত। কারণ, তাতেই নামাজের প্রতি প্রকৃত একাগ্রতা প্রকাশ পায় আর আল্লাহ তাআলার পূর্ণ হক আদায় হয়। কেননা, যে ব্যক্তি নামাজকে সংরক্ষণ করবে অর্থাৎ, সময় অনুযায়ী তা আদায় করবে, তাঁর নামাজ তাকেও হেফাজত করবে। অর্থাৎ, জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে। এই মর্মে মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন,
إن الصلاة تنهى عن الفحشاء والمنكر ولذكر الله أكبر والله يعلم ما
“নিশ্চয়ই নামাজ যাবতীয় অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তাআলার স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা কিছু করো তার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা জানেন। ২
হজরত হাসান আল-কাসেমি রহ. বলেন, যদি তুমি বলো, কত নামাজ আদায়কারী তো নিয়মানুবর্তিতার সাথে নামাজ আদায় করছে! তাদের নামাজ তো তাদেরকে গুনাহ থেকে বিরত রাখছে না? আমি উত্তরে বলব, প্রকৃত নামাজ তো হলো ওই নামাজ, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভের যোগ্যতা অর্জন হয়। আর এমন নামাজ আদায়ের পূর্বশর্ত হলো, পরিপূর্ণভাবে আন্তরিকতার সাথে তাওবা করে নেওয়া। 
অর্থাৎ, এমন তাওবা করা, যা লৌকিকতা থেকে মুক্ত। তাতে কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর আজাবের ভয়ে ভীত হয়ে এবং গুনাহের কারণে অনুতপ্ত হয়ে গুনাহ পরিত্যাগ করার অঙ্গীকার করা হয়। কেবল এমন নামাজই অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখবে।
এই মর্মে আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,
১. বায়হাকি শরিফ : ৩/১৫৩।
২. সুরা আনকাবুত : ৪৫।
إنّما يتقبل الله من المتقين.
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মুত্তাকি তথা পরহেজগার ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেই কবুল করেন।
যে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে, একনিষ্ঠতার সাথে নামাজ পড়ে, অতঃপর নামাজ আদায়ের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। আর কোনোভাবেই তা বিনষ্ট হতে দেয় না। এমতাবস্থায় তাঁর নামাজই ওই প্রকৃত নামাজ হয়, যা যাবতীয় অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।
হজরত হাসান বসরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, من له تنهه صلاته عن الفحشاء والمنكر فليست صلاته، بصلاة وهي
وبال عليه.
‘যে ব্যক্তির নামাজ তাকে যাবতীয় অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে না, তাঁর ওই নামাজ নামাজ নয় । বরং ওই নামাজ তাঁর জন্য অভিশাপ।” আল্লামা যামাখশারি রহ. থেকেও এমনটি বর্ণিত আছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
ولذكر الله أكبر والله يعلم ما تصنعون.
‘আল্লাহ তাআলার স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা করো তাঁর ব্যাপারে আল্লাহ
আল্লামা যামাখশারি রহ. উক্ত আয়াতের তাফসিরে লেখেন যে, নামাজ অন্য
তাআলা জানেন।৫ সকল ইবাদতের তুলনায় আবদিয়্যাত তথা আনুগত্যতা প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আর এই জন্যই আল্লাহ তাআলা নামাজকে সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির বলে নামকরণ করে কুরআনে পাকে ইরশাদ করেন,
فاسعوا إلى ذكر الله.
‘তখন তোমরা আল্লাহ তাআলার স্মরণের দিকে দ্রুত ধাবিত হও।৬ তথা নামাজের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। “
৩. সুরা মায়েদা: 29।
৪. তাবরানি শরিফ : ১১/৫৪।
৫. সুরা আনকাবুত : ৪৫।
৬. সুরা জুমুআ : ৯।
৭. মাহাসিনুত তাভিল : ১৩/১৫২-১৫৩।
সর্বোপরি আল্লাহ তাআলাই আমাদের অভিভাবক ও প্রতিপালক । যিনি তাঁর রহমত ও অফুরান নেয়ামতের উপকরণ দ্বারা আমাদেরকে দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বোত্তম কর্তব্যপরায়ণ ও সর্বাপেক্ষা আকাঙ্ক্ষাস্থল।

নামাজের মর্যাদা

দুনিয়াতে মানুষের আগমন ও জীবনের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহ তাআলার বিধিবিধানের বাস্তবায়ন তথা তার ইবাদত-বন্দেগি করা ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। আল্লাহ তাআলা কুরআনে মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরে ইরশাদ করেন,
وما خلقت الجن والإنس إلا ليعبدون.
‘আমি জিন ও মানবজাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। কেবল ইবাদত-বন্দেগির জন্যই সৃষ্টি করেছি।”
ইবাদতসমূহের মধ্যে নামাজই একমাত্র ইবাদত; যার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সব কাজ ছেড়ে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। এই নামাজই মানবজাতিকে সকল পাপ-পঙ্কিলতা থেকে ধুয়ে-মুছে পাক-সাফ করে দেয়। সুতরাং দ্বীনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তথা নামাজ নিয়ে আলোকপাত করা যুগের চাহিদা। দিকহারা মানবজাতিকে পুনরায় তাঁর রবের মহান ইবাদত নামাজ আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। এই বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করার কয়েকটি বিশেষ কারণ রয়েছে। সেগুলো নিম্নে আলোকপাত করা হলো ।

ঈমানের পরই নামাজের অবস্থান

আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ স্বীকার করে নেওয়া ও নিয়তের পরিশুদ্ধকরণের পর সর্বপ্রথম ফরজ কাজ হলো নামাজের ব্যাপারে যথাযথ মূল্যায়ন করা। তথা সময়মতো নামাজ আদায় করা। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন,
فإن تابوا وأقاموا الصلاة وآتوا الزكاة فخلوا سبيلهم.
‘কিন্তু যদি তারা তাওবা করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও ।
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
فإن تابوا وأقاموا الصلاة وآتوا الزكاة فإخوانكم في ا
৮. সুরা যারিয়াত : ৫৬। ৯. সুরা তাওবা : ৫।
নামাজ : আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম : ‘অবশ্য যদি তারা তাওবা করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, তবে তাঁরা তোমাদের দ্বীনি ভাই। ১০
আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে আত্মা পরিশুদ্ধ করার পরই নামাজ আদায়ের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের অপর এক আয়াতে ইরশাদ করেন,
وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء ويقيموا الصلاة ويؤتوا
الزكاة وذلك دين القيمة.
‘তারা তো কেবল আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিল যে, তারা খাঁটি মনে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করবে। নামাজ কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে। আর এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম । ১১
= অর্থ হলো, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ধর্ম অনুসারে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা। ১২ এই প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. হতে বর্ণিত, রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসুল। আর নামাজ প্রতিষ্ঠা করে
১০. সুরা তাওবা : ১১ ।
১১. সুরা বাইয়িনাহ : ৫।
১২. আল্লামা আখফাশ রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, এ (হানিফ) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে
অনুগত, মুসলিম। তবে আরবরা জাহেলিয়াতের যুগে (হানিফ) দ্বারা বোঝাত ওই ব্যক্তিকে, যিনি নিজ লজ্জাস্থান খতনা করেছে এবং বাইতুল্লাহ তথা কাবা শরিফের হজ আদায় করেছে। কেননা ওই সময় আরবরা দ্বীনে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের থেকে কেবল লজ্জাস্থান খতনা করা ও বাইতুল্লাহ তথা কাবা শরিফের হজ আদায় করা—এই দুই আমলই আকঁড়ে ধরে ছিল। তাই যে ব্যক্তিই লজ্জাস্থান খতনা করত ও কাবা শরিফের হজ আদায় করত, তাকেই এ (হানিফ) তথা ‘আনুগত্যশীল’ বলে ডাকত। পরবর্তীতে যখন ইসলামের প্রচার-প্রসার হলো, তখন থেকে (হানিফ) দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝায়। কেননা তারা খাঁটি মনে একাগ্রতার সাথে তাঁর প্রভুর ইবাদত করে। 
অভিধানে add (হানিফিয়্যাহ) অর্থ হলো আকৃষ্ট হওয়া, ধাবিত হওয়া ইত্যাদি। আর তার শরয়ি সংজ্ঞা হলো দ্বীন ইসলামের দিকে ধাবিত হওয়া ও তার বিধি-নিষেধের ওপর অটল থাকা। -লিসানুল আরব : ৯/৫৭।
ও জাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোনো কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহ তাআলার ওপর অর্পিত। ১৩
যখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত মুআয রাযি.-কে ইয়ামেনে শাসক হিসেবে প্রেরণ করেন, প্রেরণকালে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, সেখানকার অধিবাসীদেরকে এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহ্বান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহ তাআলার রাসুল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তাদেরকে অবগত করো যে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর প্রত্যহ দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন।১৪
উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ে এই বিষয়টি সুষ্পষ্ট প্রতীয়মান যে, ঈমান আনয়নের পর নামাজ আদায় করাই হলো মানুষের ওপর আল্লাহপ্রদত্ত সর্বাপেক্ষা আদেশ।
নামাজ ছিল সকল নবীর যুগে
আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সকল নবী-রাসুলগণের ওপর নামাজ ফরজ হওয়ার দ্বারা নামাজের অত্যধিক মর্যাদা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর উষালগ্ন থেকে অসংখ্য-অগণিত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। যাদের মৌলিক কাজই ছিল মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলার দিকে আহ্বান করে তাঁর ইবাদত সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালনের পথ ও পন্থা বাতলে দেওয়া। 
আর নামাজ যেহেতু সকল ইবাদতের মূল, তাই প্রায় সকল নবীর ওপরই নামাজ ফরজ ছিল। কুরআনে বিভিন্ন নবীদের আলোচনাকালে আল্লাহ তাআলা তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, যেমন আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুরআনে পাকে ইরশাদ করেন,
فاستمع لما يوحى. إنني أنا الله لا إله إلّا أنا فاعبدني وأقم الصلاة لذكري. ‘অতএব যা ওহিরূপে প্রেরণ করা হয়েছে, তা মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকুন। আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। অতএব আমারই ইবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে* নামাজ কায়েম করো । ১৬
১৩. সহিহ বুখারি : ১/২৫; সহিহ মুসলিম : ১/২২।
১৪. সহিহ বুখারি : ২/৫০৫; সহিহ মুসলিম : ১/৫০।
১৫. ‘৬ স্’ আমার স্মরণার্থে দ্বারা মর্ম হলো, আমাকে স্মরণ করার জন্য নামাজ আদায় করো ।
নামাজ : আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম : ১৬
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وأوحينا إلى موسى وأخيه أن تبوا يقومكما بيضر بيوتا واجعلوا بيوتكم
قبلة وأقيموا الصلاة.
‘আর আমি মুসা ও তাঁর ভাইয়ের নিকট আদেশ পাঠালাম যে, তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য মিশরের মাটিকে আবাসস্থল হিসেবে নির্ধারণ করো। আর তোমাদের ঘরগুলোকে কেবলামুখী করে বানাবে এবং নামাজ কায়েম করো । ১৭
এমনইভাবে নামাজ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ওপরও ফরজ ছিল। আর এই বিষয়টি কুরআনে পাকের এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, যেখানে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বীয় প্রিয় পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার দরবারে দুআয় বলেন,
ربنا إني أسكنت من ذريتي بواد غير ذي زرع عند بيتك المحرم ربنا
ليقيموا الصلاة.
‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় অধিবাসী করেছি। হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামাজ কায়েম রাখে।১ এমনইভাবে হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের ওপরও নামাজ ফরজ
ছিল । কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন,
واذكر في الكتاب إسماعيل إنه كان صادق الوعد وكان رسولا نبيا. وكان يأمر
أهله بالصلاة.
আরেকটি অর্থ হলো, তোমার স্মরণ থাকা অবস্থায় আমার দেওয়া আদেশ নামাজ, তা আদায় করো । যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদিস দ্বারা খুব সহজেই বোধগম্য হয়। من نام عن صلاة أو نسيها، فكفارتها أن يصليها إذا ذكرها، لا كفارة لها إلا ذلك. ‘কেউ সালাতের সময় ঘুমিয়ে ছিল অথবা সালাতের কথা ভুলে গেল। তাহলে যখনই তাঁর সালাতের
কথা স্মরণ হবে, তখনই নামাজ পড়ে নেবে। এটাই তাঁর কাফফারা।’ -সহিহ বুখারি : ১/১১২।
১৬. সুরা তোয়াহা : ১৪-১৫।
১৭. সুরা ইউনুস : ৮৭। ১৮. সুরা ইবরাহিম : ৩৭।
‘এই কিতাবে ইসমাইলের কথা বর্ণনা করুন, যিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসুল, নবী। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিতেন। ১৯
আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মানিত দুই নবী হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম এবং হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ওপরও নামাজ আদায় করাকে আবশ্যক করেছিলেন। সে মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
ووهبنا له إسحاق ويعقوب نافلة وكلا جعلنا صالحين. وجعلناهم أيمة يهدون
بأمرنا وأوحينا إليهم فعل الخيرات وإقام الصلاة.
‘আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও পুরস্কারস্বরূপ দিলাম ইয়াকুব এবং প্রত্যেককেই সৎকর্মপরায়ণ করলাম। আমি তাঁদেরকে নেতা করলাম। তাঁরা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত। আমি তাঁদের প্রতি সৎকর্ম করার এবং নামাজ আদায় করার প্রত্যাদেশ প্রেরণ করলাম। ২০ এমনিভাবে হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের ওপরও নামাজ ফরজ হওয়া সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
فلولا أنه كان من المسبحين. للبت في بطنه إلى يوم يبعثون. ‘আর তিনি যদি আল্লাহর তাসবিহ না পড়তেন, তবে তাঁকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটে থাকতে হতো।’
উক্ত আয়াতের তাফসিরে রইসুল মুফাসসিরিন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, ji (মুসাব্বিহিন) তথা তাসবিহ পাঠকারী দ্বারা
উদ্দেশ্য নামাজ আদায়কারী। ২১
এমনইভাবে হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালামের ওপরও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করার বিধান ছিল, আর এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে জানা যায় কুরআনের ওই আয়াত দ্বারা, যে আয়াতে হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়কে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরিমাণ ও পরিমাপ করে লেনদেনের ক্ষেত্রে কম প্রদানে নিষেধ করেছেন।
১৯. সুরা মারইয়াম ৫৫-৫৬।
২০. সুরা আম্বিয়া : ৭২-৭৩। ২১. সুরা সাফফাত : ১৪৩-১৪৪।
 কম প্রদানের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো পরিমাণ ও পরিমাপে কম দেওয়া, কার্পণ্যতা করা। আর এমন মাপে কম প্রদানকারীদেরকে উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন,
ويل للمطففين.
‘যারা মাপে কম দেয়, তাঁদের জন্য দুর্ভোগ। ২২ আবার কেউ কেউ কম প্রদানের ব্যাখ্যায় বলেছেন, নিজের অংশীদারের সাথে পরিমাপে ও পরিমাণে কম প্রদান করে বিশ্বাসঘাতকতা করা। ২৩ সুরা হুদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
ياشعيب أصلاتك تأمرك أن تترك ما يعبد آباؤنا.
‘হে শোয়াইব! তোমার নামাজ কি তোমাকে এটাই শিক্ষা দেয় যে, আমরা ওই সব উপাস্যদের পরিত্যাগ করব, আমাদের বাপ-দাদারা যাদের ইবাদত করত? ২৪
উপরোক্ত কুরআনুল কারিমের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহের দ্বারা এই বিষয় প্রমাণিত যে, অন্য সকল ইবাদতের তুলনায় নামাজের অত্যধিক মর্যাদা ও গুরুত্ব থাকার দরুনই আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের ওপর নামাজকে ফরজ করেছিলেন।
হজরত নুহ আলাইহিস সালামসহ তাঁর পরবর্তী সকল নবী-রাসুল আলাইহিমুস সালামের ওপরও নামাজ ফরজ ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রিয় রাসুল হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরও এই নামাজ ফরজ করা হয়েছে, যা সুরা মারইয়ামের সুদীর্ঘ আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন।
أولئك الذين أنعم الله عليهم من النّبيين من ذرية آدم وممن حملنا مع نوج ومن ذرية إبراهيم وإسرائيل وممن هدينا واجتبينا إذا تتلى عليهم آيات
الرحمن خروا سجدا وبكيا.
‘নবীগণের মধ্য থেকে তারাই ওই সকল নবীগণ। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা নেয়ামত দান করেছেন। তারা ছিল আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমি নুহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম, তাঁদের বংশধর আর ছিল
২২. সুরা আত-তাফফিক : ১। ২৩. লিসানুল আরাব : ৯/২২২।
২৪. সুরা হুদ : ৮৭।

লেখক পরিচিতি

বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত দাঈ ইলাল্লাহ শাইখ আহমদ ফরিদ ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে মিশরের রাজধানী কায়রোর উত্তরের শহর মিনইয়া কামাহে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন : অল্প বয়সেই তাঁর মাতার ইন্তেকালের পর তাঁর সম্মানিত পিতা-ই ছিলেন তাঁর একমাত্র অভিভাবক। তাই তিনি তাঁর পিতার কাছেই খুব অল্প বয়সেই শিক্ষাজীবন শুরু করেন। বাল্যকাল থেকেই পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী ও মনোযোগী ছিলেন। তাই মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর জ্ঞান লাভের জন্য মানসুরাহ কলেজে মেডিসিন অনুষদে এক বছর পড়াশুনা করেন। অতঃপর মিশরের বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিনের ওপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে ভর্তি হন । অনন্য কীর্তির সাথে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্ম জীবন : মিশর সরকার কর্তৃক আরোপিত আইনের কারণে পড়াশুনা শেষ করে বাধ্যতামূলকভাবে তিনি মিশরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে তিনি বৈষম্যের শিকার হন। দাড়ি ছেঁটে না ফেলা ও সুন্নতি লেবাস পরিবর্তন না করার কারণে তাকে ওয়েটিং লিস্টে রাখা হয়। অনেক হেনস্থা করা হয়। পরবর্তীতে তাঁর এই নববি আদর্শ লালনের কারণে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং জেল-জুলুমের স্বীকার হন। যা পরবর্তীকালে তাঁকে দ্বীনের পথে দাওয়াতের কাজে আরও অগ্রসর হওয়ার উৎসাহ ও উদ্দীপনা জুগিয়েছে। শাইখ আহমদ ফরিদ সালাফি মাসলাকের আকিদা ও মানহাজের অনুসারী ছিলেন।
রচনাবলি : সমগ্র আরব ও মুসলিম বিশ্বে সালাফি মাসলাকের মুখপাত্র হিসেবে ড. আহমদ ফরিদ রচনা করেছেন কালজয়ী বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ । তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : আল বাহরুর রায়েক ফি যুহুদ ওয়াল রাকায়িক, কিতাবু তাজকিয়াতুন নুফুস, শাজারাতুল ঈমান, তাজিমু কাদরিস সালাত, নাজরুর দুরুর, আল-ফাতওয়া : আদাব ওয়া আহকাম। এ ছাড়াও প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা এই স্বনামধন্য লেখক ।
আশির দশক থেকে দ্বীন ইসলামের দাওয়াতে মিশনে মিশর ও মিশরের বাহিরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ৭০ বছর বয়সি এই দাঈ ইলাল্লাহ । আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক হায়াত এবং তাঁর মহতি কাজকে দীর্ঘায়ু করুন আমিন।
নামাজ : আনুগত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম : শাইখ আহমদ ফরিদ | Prayer: The Greatest Means of Obedience: Shaykh Ahmad Farid – ORIGIN COPY 
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?