- বই : নয়টি উপন্যাস |রিভিউ / পাঠপ্রতিক্রিয়া
- লেখিকা : সুচিত্রা ভট্টাচাৰ্যের বই
- প্রচ্ছদ : দেবাশিষ সাহা
- প্রকাশনী : সাহিত্যম
- মূল্য : ৪০০/-
- পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৩৪৮
পাঠপ্রতিক্রিয়া
🍂সদ্য পড়া শেষ করলাম বিশিষ্ট লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের “নয়টি উপন্যাস” বইটি।বইটিতে মোট নয়টি উপন্যাস রয়েছে। উপন্যাস গুলোর পরিধি এতটাই কম যে এগুলোকে উপন্যাসিকা বলাই বোধহয় শ্রেয় হবে। প্রতিটা উপন্যাস গড়ে ৫০ পাতার মধ্যে শেষ হয়েছে।তাই সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস যারা প্রথম পড়া শুরু করবেন তারা অবশ্যই এই বইটি দিয়ে স্বচ্ছন্দে শুরু করতে পারেন। নাতিদীর্ঘ উপন্যাসগুলোর বিস্তৃতি আপনার কোন ভাবেই বিরক্তিকর মনে হবে না,বরংচ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারবেন লেখিকার লেখনীকে।
🍂লেখিকার লিখনশৈলী অত্যন্ত জীবন্ত এবং চমকপ্রদ। প্রতিটি চরিত্রকে তিনি এমনভাবে এঁকেছেন যে সব কটা চরিত্রকে আপনি ভীষণভাবে অনুভব করতে পারবেন এবং পড়া শেষেও চরিত্রগুলোর একটা ছোঁয়াচে রেশ রয়ে যাবে মস্তিষ্কে।
🍂 সুচিত্রা দেবীর লেখা এই আমি প্রথম পড়লাম। পড়া শেষে যেন এক দারুন অনুভুতি বশবর্তী হয়ে পড়েছি । উপন্যাস গুলোর পরিধি খুব একটা বৃহৎ না হলেও বেশ কিছুটা সময় নিয়েই এই বইটা শেষ করতে হয়েছে । এটুকু বলতে পারি লেখাগুলো আমার মনে একটা দীর্ঘকালীন ছাপ ফেলতে সমর্থ হবে।
🍂 লেখিকার লেখনীর যে বিশেষ দিকটি আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটি হল অনুভূতির আতিশয্য। উপন্যাস গুলোর মধ্যে প্রেম,কষ্ট,বেদনা,বিরহ,আনন্দ, ভালোলাগা, ইচ্ছা এমন হাজারো অনুভূতি ভিড় করে রয়েছে। এমনকি স্থান পেয়েছে কিছু নাম না জানা জটিল অনুভূতিরাও। একজন মেয়ে হওয়ার সুবাদে মেয়েদের এমন কিছু চোরা অনুভূতি উনি লেখাগুলোতে ফুটিয়ে তুলেছেন যা একজন পুরুষের দ্বারা অনুধাবন করা সত্যিই অসম্ভব।
🍂 সুচিত্রা দেবীর লেখা বেশ বাস্তবভিত্তিক এবং সমাজকেন্দ্রিক।লেখাতে অনুভূতির ঘনঘটা থাকা সত্বেও বাস্তবকে তিনি কোনোভাবেই উপেক্ষা করেননি।বাস্তব জীবন এবং সমাজের বেশ কিছু প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে উপন্যাসগুলো তে। লেখিকা এমন নিপুন কৌশলে আমাদের চিরপরিচিত সমাজকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন তা রীতিমতো প্রশংসনীয়।
🍂 লেখিকার লেখায় স্থানপ্রাপ্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সম্পর্কের সমীকরণ। প্রেমিক-প্রেমিকা,স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র/পুত্রী, মা -মেয়ের মত কিছু মিষ্টি সম্পর্ক যেমন এক নিদারুন ভালোলাগার ঘোরে আচ্ছন্ন করবে আমাদের, তেমনি প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রীর বেশ কিছু জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা থেমে, সামান্য ভাবতে বাধ্য করবে।
🍁 দারুন একটি বই পড়লাম। সকলকে অনুরোধ করবো একবার পড়ে দেখার জন্য। লেখিকার লেখনি সত্যিই মুগ্ধতা এনে দেবে হৃদয়ে। 🥰❤️
🍂এবার বইটিতে স্থান প্রাপ্ত উপন্যাস গুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক…
📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕📕
১. চেনা মুখ অচেনা মুখ :- রত্না তার পরিবারের কথা না শুনে প্রেম করে বিয়ে করেছে শেখর কে। মেয়ে মিমলি কে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। শেখরও নিজের পরিবারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছেড়ে এসেছে সবকিছু।হঠাৎ সেরিব্রাল রোগে আক্রান্ত হয়ে শেখর মারা যায়। লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় তাদের স্বপ্নালোকিত সংসারটাকে। শেখর এর মৃত্যুর পর রত্না জানতে পারে, শেখরের নাকি পূর্বে বিবাহ হয়েছে এবং সে ডিভোর্সি। সত্যিই কি তাই? নাকি এটি শেখরের পরিবারের কোন চক্রান্ত?
২. অর্পিতা:- অর্পিতার স্বামী শুভেন্দু অত্যন্ত মদ্যপ এবং লম্পট চরিত্রের একজন মানুষ। অর্পিতাকে প্রত্যাখ্যান করে সে চলে গেছে বহুদিন। তখন থেকেই অর্পিতা ঘর এবং অফিস দুটোই সমানতালে সামাল দিয়ে চলেছে। মানুষ করেছে ছেলে মেয়েকে। হঠাৎ সে শুনতে পাই শুভেন্দুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। এখন কি করবে অর্পিতা? সব পূর্ব রাগ,অভিমান,ঘৃণা ভুলে ছুটে যাবে কি মৃতপ্রায় মানুষটির কাছে?
৩. সীমারেখা :- সরকারি চাকুরে মন্দার এবং সুরভি তাদের মেয়েকে নিয়ে বাস করে ভাড়া বাড়িতে। হঠাৎ ভাড়া বাড়িতে বসবাস অসহ্য হয়ে যাওয়ায় তারা পরিকল্পনা করে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার। মধ্যবিত্ত পরিবারে হাজারো সুখ, স্বপ্ন,পরিকল্পনা ভিড় করে আসে ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে। আদৌ কি তারা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে ??
৪. শেষ বেলায় :- বৃদ্ধ শুভময়ের স্ত্রী মারা গিয়ে তাকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়ে গিয়েছে। জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে এসে শুভময় বুঝতে পেরেছে সকলেই নিজের একটা নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে আবর্তন করে চলেছে। তার নিজের বলতে কেউ নেই। তখন তার অন্ধকার জীবনটাকে আলো করে তার জীবনে আসে তন্ময় নামের একটি হ্যান্ডিক্যাপ কিশোর । এই গল্পের শেষে কি অপেক্ষা করছে?… শেষটা বেশ বেদনাদায়ক😔
৫. সহেলি :- আমেরিকাতে একটি অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে কাবেরীর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার বাল্যসখি সহেলির। স্বামী তাকে ত্যাগ করাই সহেলির জীবন এখন বিপর্যস্ত। কাবেরী কি পারবে সহেলির জীবনকে আগের স্রোতে ফিরিয়ে দিতে?
৬. হারজিতের খেলা :- সুকান্ত হঠাৎ দীর্ঘ ৮ বছর পরে মেন্টাল এসাইলামথেকে ফিরে আসে তার পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী এবং বিশ্বাসঘাতক বন্ধু অর্থাৎ তিথি-কৌশিকের সংসারে। কি হেতু তার এই আগমনের? এই গল্পটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে।। মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো একটি গল্প😌😌
৭. অদ্ভুত আঁধার এক :- সুতপা একদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় তাকে গ্যাং রেপের শিকার হতে হয় তারই পাড়ার তিনজন লম্পট ছেলের কাছে। একজন রেপ ভিক্টিমকে কত কিছু সহ্য করতে হয় ? সমাজ তাকে কি নজরে দেখে? এবং এই বিষয়টি নিয়ে কিভাবে একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা করা খাড়া হয়..? সেই বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ফুটে উঠেছে উপন্যাসে।
৮. হঠাৎ অরণ্যে :- জঙ্গল ভ্রমণে এসে দিব্যকান্তির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার পুরনো প্রেমিকা মালবিকার। দিব্য এবং মালবিকা দুজনে এখন সুখী বিবাহিত। তবুও কি কিছু পুরোনো দুঃখ গোপন রয়ে গেছে? কি হবে শেষ পর্যন্ত?
৯. মেঘ পাহাড় :- স্বামী এবং মেয়ের সঙ্গে রোহিনী ঘুরতে এসেছে চন্ডিগড়ে। এখানে এসে একটি রেস্টুরেন্টে হঠাৎ একটি যুবককে দেখে সে চমকে ওঠে। যুবকটি হুবুহু তার প্রাক্তন প্রেমিকের মতো দেখতে। দীর্ঘ কুড়ি বছর পরেও তার প্রাক্তন প্রেমিক আকাশ কি করে এখনো সেই আগের মতই দেখতে? সময় কি তবে থেমে গেছে?কি হবে শেষ পর্যন্ত? আসল সত্যিটা কি?