ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ : মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ, ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রহঃ)

  • বই : ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ
  • লেখক : মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ, ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রহঃ)
  • অনুবাদক : মাসউদ আলিমী
  • পৃষ্ঠা : ১২০ পৃষ্ঠা
  • মুদ্রিত মূল্য : ১৭৫ টাকা
  • ধরণ : পেপারব্যাক
  • সীরাত পাবলিকেশন


উমর বিন আব্দুল আযীয রহিমাহুল্লাহ এর স্ত্রী ফাতিমা থেকে বর্ণিত,

একবার তিনি উমর বিন আব্দুল আযীয এর ঘরে প্রবেশ করেন। তখন তিনি জায়নামাযে গালে হাত চেপে বসে আছেন। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু বইছে। তিনি বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে?

উমর বিন আব্দুল আযীয বললেন :
“হে ফাতিমা! আমি উম্মাতে মুহাম্মাদীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমি সেসব লোকদের কথা ভাবছি-
যারা অভাবী ও ক্ষুধার্ত, যারা জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত, যারা সীমাহীন দরিদ্র, যারা নিপিড়ীত মযলুম, যারা অপরিচিত বন্দী, শহরের উপকন্ঠে অবস্থানরত বৃদ্ধ ও তার পরিবারের কথা। আমি জানি কিয়ামতের দিনে আমাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তাদের বাদী হবেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আমার আশংকা হচ্ছে, সে সময় সে কাঠগড়ায় আমার পক্ষে শক্তিশালী কোনো দলিল থাকবে কি না! থাকলে আমি রেহাই পেতাম!” এ বলে তিনি কান্না করতে থাকেন।

অন্তরের নানান ব্যাধি—যেগুলো মানুষকে মনুষ্যত্বের স্তর থেকে নামিয়ে দেয়, নফসের গোলাম বানিয়ে ছাড়ে। আমাদের পূর্বসূরিদের থেকে শুরু করে সমসাময়িক আলিমদের অনেকেই অন্তরের এসব ব্যাধির স্বরূপ উন্মোচন করে অসংখ্য বইপত্র লিখেছেন। কিন্তু বাংলায় ধনসম্পদ, নেতৃত্ব, ক্ষমতার লোভ এসব বিষয়ে আলাদাভাবে একটি বই খুব একটা দেখা যায় না। আলিমরা ক্ষমতা, পদমর্যাদার লোভকে বলেছেন ‘গুপ্ত বাসনা’— কারণ এই ব্যাধি খুব একটা প্রকাশ পায় না। এমনকি দ্বীনদার, আল্লাহওয়ালা লোক, তার ভেতরেও এই ব্যাধি ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে হয়তো সে নিজেই জানে না।
.
ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ বইটিতে দুটো বইকে একত্রিত করা হয়েছে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “ক্ষুধার্ত দুই নেকড়ে বাঘকে ছাগল পালে ছেড়ে দিলে যতটা না ক্ষতি সাধন করে, সম্মান ও সম্পদের লালসা দ্বীনের মধ্যে তার চেয়েও বেশি ক্ষতি সাধন করে।” ইবনু রজব হাম্বলি একটি বইতে এই হাদিসের চমৎকার ব্যাখ্যা লিখেছেন। আরেকটি পুস্তিকা শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদ রচিত ‘নেতৃত্ব, ক্ষমতা, পদমর্যাদার লোভ’। আলোচনার বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য একই হওয়ায় দুটো বই পাচ্ছেন এক মলাটে।

ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ
“ক্ষুধার্ত দুই নেকড়ে বাঘকে ছাগল পালে ছেড়ে দিলে যতটা না ক্ষতি সাধন করে, সম্মান ও সম্পদের লালসা দ্বীনের মধ্যে তার চেয়েও বেশি ক্ষতি সাধন করে।
লেখক মূলত বইটিতে এই হাদিসটি নিয়েই সুদীর্ঘ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাকে তওফিক দিয়েছেন, এই মূল্যবান বইয়ের উপর কিছু কাজ করার। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি এর তাহকীকের কাজ শুরু করেছি। বইয়ের উক্তি ও হাদিসের রেফারেন্স যোগ করেছি। পাশাপাশি উল্লেখ করেছি জটিল শব্দগুলো প্রতিশব্দ ও সামান্য ব্যাখ্যা। এসবের উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। এ আশায়- এই টুটাফাটা মেহনত যেন হাশরের মাঠে আমার নেকীর পাল্লায় উঠানো হয়। নেকীর পাল্লা ঝুকিয়ে দেয়। সহজ ও সরল পথের পথপ্রদর্শক ও তাওফিক দাতা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই।
—আবু ‘আসিম আল বারকাতি।
[২] মুসনাদ আহমাদ : ৩/৪৫৬, ৪৬০, তিরিমি : ২৩৭৬, ইবনু হিব্বান : 2472, নুয়াইম ইবনু হাম্মাদ, কিতাবুয যুহদ : ১৮১, আদ দারিমি : ২/৩081

ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ

সকল প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য। অগণিত দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবার- পরিজন ও অনুসারীবর্গের উপর।
ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল, ইমাম নাসাঈ, ইমাম তিরমিযি ও ইবনু হিব্বান প্রমুখ হাদিস বিশারদগণ স্বীয় গ্রন্থসমূহে কা’ব ইবনু মালিক আল আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
عتم بأفسد لها من حرص المرء على في ما ذئبان جائعان أرسلا
المال والشرف لدينه
“ক্ষুধার্ত দুই নেকড়ে বাঘকে ছাগল পালে ছেড়ে দিলে যতটা না ক্ষতিসাধন করে, সম্মান ও সম্পদের লালসা দ্বীনের মধ্যে তার চেয়েও বেশি ক্ষতিসাধন করে।”তি)
আলোচ্য হাদিসের সনদ সম্পর্কে ইমাম তিরমিযি রহিমাহুল্লাহ বলেন—হাদিসটি হাসান সহিহ। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিসটি ভিন্ন সনদে যেমন—আব্দুল্লাহ ইবনু উমর, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, আবু হুরায়রা, উসামা বিন যায়েদ, জাবের, আবু সাঈদ আল খুদরি এবং ‘আসিম বিন ‘আদি আল আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমূখ থেকেও বর্ণনা করেছেন।
ইবনু রজব হাম্বলি রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম তিরমিযি এই সকল সাহাবায়ে কেরাম থেকে যে হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন আমরা সেগুলো ‘শরহুত-তিরমিযি’-তে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি এবং সনদগত বিষয়েও আলোচনা করেছি।
[৩] মুসনাদ আহমাদ: ৩/৪৫৬, ৪৬০, তিরিমিযি: ২৩৭৬, ইবনু হিব্বান : ২৪৭২, নুয়াইম ইবনু হাম্মাদ, কিতাবুয যুহদ: ১৮১, আদ দারিমি : ২/৩০৪ |
এর মধ্যে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসটির শব্দগুলো হলো:
ما ذئبان ضاريان باتا في غنم غاب رعاؤها بأفسد لها من التماس الشرف والمال لدين المؤمن
“সম্মান ও সম্পদের মোহ একজন মুমিনের দ্বীনে যতটা বিপর্যয় ডেকে আনে, দুইটা হিংস্র নেকড়ে রাখালদের অনুপস্থিতিতে ছাগল পালে রাত্রিযাপন করলেও ততটা বিপর্যয় ঘটায় না।”
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনায় …… লাও (সম্মান ও সম্পদের ভালোবাসা…..) এর পরিবর্তে ৮.১ (দুনিয়ার প্রতি আসক্তি…) কথাটি এসেছে।
আর হ্যাঁ, দুনিয়ার আসক্তিই দ্বীন বরবাদের কারণ।
দুনিয়ার সম্পদ ও প্রতিপত্তির প্রতি আসক্তির ফলে একজন মুমিনের দ্বীনের কতটা অবনতি হতে পারে, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচ্য হাদিসে বুঝিয়েছেন—গভীর মর্মভেদী একটি উপমা দিয়ে। যশ-খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা, ধনসম্পদের লালসা দ্বীনের যতটা ক্ষতি করে, দুইটা ক্ষুধার্ত ও হিংস্র নেকড়ে ছাগল পালে আক্রমণ করেও অতটা সর্বনাশ করতে পারে না! এমনকি রাতের আধারে, রাখালের অগোচরে হলেও! চিন্তা করুন এমন অবস্থায় দুটো নেকড়ে ছাগল পালে কেমন বীভৎসতা সৃষ্টি করবে!
জানা কথা যে, এমতাবস্থায় দুচারটা ছাগল ছাড়া আর কোনো ছাগলই সেই হিংস্রতা থেকে রক্ষা পাবে না। অথচ আল্লাহর রাসূল বলছেন, সম্মান ও সম্পদের লোভ বান্দার দ্বীনকে এর চেয়েও বীভৎসভাবে তছনছ করে দেয়। হয় ক্ষতিটা বরাবর, না হয় তার চেয়েও বেশি। এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন, মনের মধ্যে দুনিয়ার সম্মান ও সম্পদের প্রতি দুর্বলতা রেখে কারও দ্বীন খুব কমই নিরাপদ থাকে, যেভাবে ছাগল পাল উক্ত দুই নেকড়ের আক্রমণ থেকে অনিরাপদ থাকে।
সুতরাং পার্থিব জগতে সম্পদ ও যশ-খ্যাতির কামনা কতটা ভয়ঙ্কর, সে বিষয়ে সতর্ক করার জন্য রাসূলের উপমাটিই যথেষ্ট।
১। ধনসম্পদের ভালোবাসা।
২। সম্মানের আকাঙ্ক্ষা।
হাদিসে এ দুটিকে হিংস্র দুটি নেকড়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

ধনসম্পদের প্রতি ভালোবাসার দুটি প্রকার:

প্রথম প্রকার
সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার তীব্র নেশা। সাথে সাথে বৈধ উপার্জন থেকেও অদম্য উন্মাদনা নিয়ে সম্পদ সঞ্চয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। রাত-দিন নেই, ঘুম নাওয়া খাওয়া নেই, কষ্ট-ক্লেশের কোনো তোয়াক্কা নেই—কেবল সম্পদের নেশায় দিকবেদিক ছুটতে থাকা ।
কিছু বর্ণনায় আলোচ্য হাদিসের যে প্রেক্ষাপট এসেছে, তার সাথে সম্পদের লোভের এ প্রকারটি মিলে যায়। যেমন আল্লামা তাবারানি রহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাবে হাদিসটি এভাবে এনেছেন,
‘আসেম বিন ‘আদি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
فقال: ما ذئبان اشتريت مئة سهم من سهام خيبر، فبلغ ذلك النبي في غنم أضاعها ربها بأفسد لها من طلب المسلم المال عاديان ظلا والشرف لدينه
“খায়বার যুদ্ধে অর্জিত গনিমত থেকে একশটি অংশ আমি কিনেছিলাম। এ খবর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কান পর্যন্ত পৌঁছে। তখন তিনি বললেন:
‘সম্মান ও সম্পদের মোহে একজন মুসলিমের দ্বীনে যতটা বিপর্যয় নেমে আসে, দুটি হিংস্র নেকড়ে ছাগল পালে থেকে গেলেও রাখালের এতটা বিপর্যয় ঘটে না।”[৪]
যদি মানুষ এই সম্পদের পিছনে না পড়ত, তাতে আসক্ত না হতো, তাহলে জীবনের ঐ দামি সময়টুকু নষ্ট হতো না—যা কোনো মূল্য দিয়ে কেনা যায় না— হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। অথচ সে চাইলে ঐ সময় আর শ্রম দিয়ে চূড়ান্ত সাফল্য ও চিরস্থায়ী সৌভাগ্য অর্জন করতে পারত। কিন্তু সে তা হাতছাড়া করছে, সেই সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করছে এমন কিছু ‘রিযিকে’র লোভে, যা বণ্টন হয়ে গেছে। যে রিযিক পৌঁছানোর দায়ভার আল্লাহ নিজে নিয়ে নিয়েছেন। তাই সে যত চেষ্টাই করুক, যতই কামনা করুক, ভাগ্যে যতটুকু আছে তার চেয়ে সিকিভাগ
[৪] হাইসামি তাঁর মাজমাউজ জাওয়াঈদ (১০/২৫০) এ বর্ণনা করেছেন, এবং তাবারানির আল আওসাতের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, এর ইসনাদ হাসান।
বেশিও কখনো পাবে না। শুধু কি তাই? যেটুকু সম্পদ সে এত শ্রম দিয়ে কামাই করল, সেটুকুও সে ভোগ করতে পারে না। সব অন্যের জন্য রেখে নিঃস্ব হয়ে কবরের পথ ধরবে। তার সম্পদ ভোগ করবে অন্যরা, কিন্তু হিসাব দিতে হবে তাকেই! যাদের জন্য এত এত সম্পদ জমা করল, তারাও তার প্রশংসা করবে না। সবকিছু ফেলে সে যার সাক্ষাতে রওয়ানা হলো, তাঁর কাছেও কোনো ওজর চলবে না!
বৈধ পন্থায় অধিক অর্থ উপার্জনের আসক্তি নিন্দনীয় হওয়ার জন্য এগুলো কি যথেষ্ট না?
সুতরাং এসব লোভী ব্যক্তিরা তাদের মূল্যবান সময়কে বরবাদ করে। যা কিছু জমা করে, অন্যরা তার ফায়দা লুটে। অথচ এই মূল্যহীন সম্পদের জন্য কত ঝুঁকিপূর্ণ সফর করতে হয়েছে, কত দূর্যোগ-দূর্বিপাক পাড়ি দিতে হয়েছে।
কবির ভাষায়:
“দারিদ্র্যের আশংকায় যে সম্পদের পেছনে সময় ব্যয় করে, তাহলে তো সে দারিদ্র্যকেই (আখিরাতের) টেনে নিল। তাকে ফকির মনে করো না, যে দুনিয়ায় ধনসম্পদ পেল না
বরং মস্ত বড় ফকির তো সে, যে দ্বীন পেল না।”
সম্পদের দারিদ্র্যকে দারিদ্র্য মনে করো না। বরং দ্বীনি দারিদ্র্যতাই হলো সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য।
কোনো এক জ্ঞানী ব্যক্তিকে বলা হলো,
: অমুকে এত এত সম্পদ জমা করেছে।
: সে কি সুনিশ্চিত কিছু সময়ও জমা করেছে, যে সময়টাতে ওসব সম্পদ ব্যয় বা ভোগ করতে পারে?
: না।
: তাহলে তার এই সঞ্চিত সম্পদের ফায়দা কী? আসলে সে কিছুই সঞ্চয় করেনি।
ইসরাইলি বর্ণনায় একটি কথা পাওয়া যায়:
الرزق مقسوم، و الحريص محروم، إبن آدم! إذا أفنيت عمرك في
طلب الدنيا، فمتي تطلب الآخرة؟
“রিযিক বণ্টন হয়ে গেছে। লোভী হয়েছে বঞ্চিত। হে আদম সন্তান! তুমি দুনিয়ার মোহে যখন জীবন ব্যয় করে দিচ্ছ, তো আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করবে কখন?”
অন্য এক কবিতায় এসেছে:
“হে সম্পদের গোলাম! আখিরাত বিমুখ ! সময়ের কারসাজি তোমার অর্থের খিদে বাড়িয়ে তুলছে। হে দুনিয়া পাগল! তুমি ভয় পাচ্ছ, টাকার স্রোতে কী ভাটা পড়ল? একটু ভেবে দেখ, জমানো টাকা ভোগের জন্য কি সময় রেখেছ? মনে রেখো, জমে থাকা এই পয়সাকড়ি তোমার নয়, তোমার পরিবারের। আজকে যা খরচ করেছ তা-ই তোমার ছিল। যে অল্পে তুষ্টির দুনিয়ায় বাস করতে শেখে, দুঃশ্চিন্তা তাকে টলাতে পারে না।”
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন :
“ইয়াকিন হলো আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে খুশি না করা। আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক নিয়ে কারোর প্রতি হিংসা না করা। আল্লাহ তাআলা যা তোমাকে দেননি, সে জন্যে অন্যকে তিরস্কার না করা। কারণ, কোনো লোভী ব্যক্তির লোভ আল্লাহর রিযিক টেনে আনতে পারে না। এবং অপছন্দকারীর অপছন্দ তা হটিয়ে দিতে পারে না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার ন্যায় ও ইনসাফের নীতি হলো— তিনি সুখ ও সৌভাগ্যকে রেখেছেন ইয়াকিন ও তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মাঝে। দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা রেখেছেন সন্দেহ ও তাঁর নারাজির মধ্যে।”
পূর্ববর্তী কোনো এক ইমামের বাণী:
“তাকদীর যখন অবধারিত, তখন অধিক লোভ করাটা অনর্থক। যখন মানুষের মাঝে স্বভাবজাত প্রতারণা বিদ্যমান, তখন প্রত্যেকের উপর ভরসা করা নিজের দুর্বলতা। মৃত্যু যখন সবার জন্য অপেক্ষমান, তখন দুনিয়া নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা।”
আল্লামা আব্দুল ওয়াহিদ বিন যায়েদ রহিমাহুল্লাহ আল্লাহর নামে শপথ করে বলতেন:
“দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা আমার নিকট মানুষের জানের শত্রুর চেয়ে ক্ষতিকারক।”
তিনি আরও বলতেন:
“হে প্রিয় ভাইয়েরা!
তোমরা দুনিয়ার মোহে আসক্ত ব্যক্তির প্রাচুর্য দেখে ঈর্ষা করো না। তার উপার্জন আর সম্পদের বাহারে বিমর্ষ হয়ো না। বরং তোমরা তাকে ঘৃণার চোখে দেখো। সম্পদের প্রতি ভালোবাসা ও দুনিয়ার ব্যস্ততার কারণে তার উপর করুণার দৃষ্টি দাও। কারণ, সে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত। আজ সে যা নিয়ে ব্যস্ত, কাল কিয়ামতের দিন তাকে তা কাঁদাবে।”
তিনি আরও বলতেন,
লোভ দুই প্রকার:
১। কষ্টদায়ক লোভ
২। উপকারী লোভ।
উপকারী লোভ হলো—যা মানুষকে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও দাসত্বের প্রতি আগ্রহী ও অনুরাগী করে ।
আর কষ্টদায়ক লোভ হলো—যে লোভ মানুষকে দুনিয়ার প্রতি লেলিয়ে দেয়, প্রাচুর্যের গোলাম বানায়।
দুনিয়ার লোভ মানুষের ভেতরটা ধীরে ধীরে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়, জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে, দুঃখ-ক্লেশে ডুবিয়ে রাখে। তাতে কোনো সুখ নেই, হাসি আনন্দ নেই, এবং জমা করা সম্পদের স্বাদও সে নিতে পারে না। দুনিয়ার প্রতি আসক্তির কারণে মানুষ আখিরাত নিয়ে ভাবার সুযোগ পায় না। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া তাকে গাফেল করে রাখে চিরস্থায়ী আখিরাত থেকে।
কবি মাহমুদ আল ওয়াররাক এ প্রসঙ্গে আবৃত্তি করেন:
“ভাইয়ের সম্পদের প্রাচুর্য দেখে ঈর্ষায় কাতর হয়ে যেও না বরং তার দিকে ঘৃনা আর বিরক্তি নিয়ে তাকাও।
ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ
নিশ্চয় সম্পদ-লোভী সম্পদের মোহে ব্যতিব্যস্ত থাকে
যে সম্পদ সে কামিয়েছে তার আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।”
কোনো এক জ্ঞানী তার দুনিয়াসক্ত ভাইয়ের উদ্দেশ্যে লিখে পাঠান:
“তুমি তো দুনিয়ার গোলাম হয়ে গেছ। অথচ দুনিয়া তোমার উপরে দুঃখ দুর্দশা, রোগ-শোক, নানান বিপদাপদ চাপিয়ে দিয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছে। সম্পদের পিছনে এতটা উঠেপড়ে লেগেছ যে, মনে হচ্ছে না তুমি এমন সব
লোকদের দেখেছ,
যারা লোভ করে পরে নিরাশ হয়েছে….
দুনিয়া বিমুখ হয়েও রিযিক পেয়েছে….
অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও সব রেখে মারা গেছে…..
দুনিয়ার খুব সামান্য পেয়েও যে অনেকে সুখী হয়েছে…”
এক বেদুইন ব্যক্তি তার ভাইয়ের দুনিয়ার মোহের নিন্দা করে বলেন:
“প্রিয় ভাই!
তুমি খুঁজে খুঁজে মরছ, অথচ তোমাকে খোঁজা হচ্ছে। তোমাকে এমন জিনিস (নির্ধারিত রিযিক) খুঁজছে, যা তুমি পাবেই! আর তুমি এমন জিনিসের খোঁজে আছ, যা তোমার জন্য কখনোই যথেষ্ট না। তুমি কি দুনিয়াসক্ত ব্যক্তিকে নিঃস্ব হতে, আর দুনিয়া বিমুখ ব্যক্তিকে রিযিক পেতে কখনো দেখোনি?”
এক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি বলেন:
“মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো হিংসুটে লোক, যে অন্যের সম্পদ দেখে হিংসা করে।
সবচেয়ে বেশি সুখে আছে অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি। তাঁর যা আছে তা নিয়েই খুশি
থাকে। আর সবচেয়ে বেশি অপমানিত আর লাঞ্চিত ঐ আলিম—যে নিরাশ।”
এ প্রসঙ্গে কবি বলেন:
“লোভ এমন এক রোগ, যা তোমার দেখা প্রায় সব লোভীকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, দুয়েকজন হয়তো আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
কত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে দেখেছি, লোভ তাদের অপদস্ত করে ছেড়েছে!”
ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার লোভ
বিখ্যাত কবি আবুল ‘আতাহিয়া সালাম আল খছিরকে সম্বোধন করে বলেছেন:
“হে সালাম ইবনু ‘আমর! আল্লাহ তাআলা মহান ও পুতপবিত্র। লোভ কত মানুষকে অপদস্থ ও পরাস্ত করে ছেড়েছে।” বাদশাহ মামুনুর রশীদের একটি উক্তি হলো:
“ লোভ কত মানুষের দ্বীন নষ্ট করে দিয়েছে,
মনুষত্ব কেড়ে নিয়েছে!”
কবি বলেন:
“ লোভীর লোভ এক পাগলামি
আর ধৈর্য হলো দুর্ভেদ্য দুর্গ। যদি আল্লাহ কোনো কিছু তাকদীরে লিখে রাখেন,
তবে সেটা ঘটবেই।”
কবি আবুল ‘আতাহিয়াহ বলেন:
“আমি যখন বিভিন্ন নগরীতে (ব্যবসা নিয়ে) ছুটতে থাকি, সফরে ব্যস্ত থাকি
দীর্ঘ মেহনতের কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করি…
এবং কখনো অবস্থার উন্নতি হয়, কখনো অবনতি !
জন্মভূমি থেকে আমি বহু দূরে, আপনজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা জানে না
আমার অবস্থা!
কখনো পূর্বে থাকি, কখনো পশ্চিমে…..
সম্পদের প্রতি লোভের কারণে মৃত্যুর কথাও আমার মনে পড়ে না।
(হে মন!) যদি তুমি অল্পে তুষ্ট হতে তাহলে কষ্ট-ক্লেশ ছাড়াই রিযিক পৌঁছে
যেত।
ধনসম্পদ নয়, অল্পে তুষ্টি-ই হলো সত্যিকারের প্রাচুর্য।”
কবি মাহমুদ আল ওয়াররাক এ প্রসঙ্গে আবৃত্তি করেন:
“হে শ্রান্ত ক্লান্ত পথিক!
লালায়িত হয়ে কণ্ঠকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে তুমি দুনিয়া
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?