দূরে আরো দূরে : মুহাম্মাদ ইব্রাহীম | Dure Aro Dure By Muhammad Ibrahim

  • বইঃ দূরে আরো দূরে
  • লেখকঃ মুহাম্মাদ ইব্রাহীম
  • প্রচ্ছদঃ মোঃ সাদিতউজজামান
  • প্রকাশনীঃ অবসর প্রকাশনা সংস্থা
  • পৃষ্ঠাঃ ১২৭
  • মুদ্রিত মূল্যঃ ২৪০
  • ব্যাক্তিগত রেটিংঃ ৬.৫/১০
  • রিভিউ ক্রেডিটঃ জয়িতা জয়ি

Strength and growth come only through continuous effort and struggle – Napoleon হিল্ল
খনি থেকে উত্তোলিত সোনা খাঁটি থাকে না, আগুন তাকে পুড়িয়ে খাঁটি করে। তেমনি সংগ্রাম ছাড়াও মানুষ পূর্ণতা পায় না। সে সংগ্রাম হতে পারে নিজের স্বপ্ন পূরণে, কিংবা ভালোবাসায়। বড় কিছু হতে চাওয়ার রাস্তায় দৃঢ়তা আর শক্তির যোগান সংগ্রাম থেকেই আহরণ করতে হয়।
❌ স্পয়লার এলার্ট ❌
কাহিনি সংক্ষেপঃ
——————-
আলতাব একজন স্বপ্নবাজ যুবক, যার স্বপ্ন একদিন বিখ্যাত লেখক হবার। বর্তমানে টিউশনি যার একমাত্র পেশা। আঁখির সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান আট বছর ধরে। এদিকে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, এক সময়ের ছাত্রী অনু ভালোবাসে আলতাবকে। একতরফা সেই ভালোবাসায় আলতাবকে কাছে পাবার চেয়ে তাকে সুখী দেখতে পাওয়াটাই অনুর সুখ।
আছে আলতাবের বর্তমান এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী ছাত্রী তরু। যার কঁচি মনে জায়গা করে নিয়েছে আলতাব।
আলতাব কি পারবে লেখক হতে? আলতাব আর আঁখির প্রেম কি পরিণতি পাবে? কী হবে অনু আর তরুর ভালোবাসার?
বই পর্যালোচনাঃ
‘দূরে আরও দূরে’ বইটি মূলত সমসাময়িক রোমান্টিক উপন্যাস। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রেমের আখ্যান উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায়। পাশাপাশি একজন নবীন লেখকের স্ট্রাগলও বইয়ের উপজীব্য।কিন্তু রোমান্টিকতার আড়ালে বেশকিছু সোশ্যাল ম্যাসেজ ও ইস্যু ছিল বইটার পরতে পরতে। গল্পের আড়ালে থাকা সেসব নিয়ে নিচে আলাপ করছি।
আঁখি আর আলতাবের সম্পর্ক আর দশটা সম্পর্কের মতই প্রেম-ভালোবাসা, মান-অভিমানে কেটে যাচ্ছিল। আঁখি অনেকটা দখলদারি মনোভাবের, আলতাবকে সে অন্য মেয়ের সাথে সহ্য করতে পারে না। আঁখির এই মনোভাবের সুযোগে তার বন্ধু নিরু যখনই সুযোগ হয়, আলতাবের বিরুদ্ধে তাকে উস্কে দেয়। একবার দু’বার থেকে বারবার ব্যাপারটা ঘটতে থাকলে একসময় তা সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। আলতাবের প্রতি রাগের সুযোগটায় নিরু আঁখিকে পরিচয় করিয়ে দেয় তার বন্ধু জাহিদের সাথে। আলতাবের ওপর রাগ করে জাহিদকে বেশি সময় দেওয়া, ওদিকে আঁখির ওপর অভিমানে আলতাবের দূরে থাকা একসময় ভাঙন ধরায় তাদের এত বছরের সম্পর্কে।
এই ঘটনা শিক্ষা দেয়, সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে নাক গলাতে দেয়া উচিত না। এসব ক্ষেত্রে সম্পর্ক ভাঙার পেছনে নিজেদের চেয়ে তৃতীয় ব্যক্তি বিশেষের ইন্ধনটাই দায়ী থাকে বেশিরভাগ সময়।
 আলতাব আর আঁখির মাধ্যমে আরো একটা বিষয় প্রতীয়মান হয়, মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য এখনকার পৃথিবীতে সম্পর্কগুলো কতটা ঠুনকো। প্রযুক্তি পৃথিবীকে ছোট করেছে, স্থান কাল ভেদে সবার মাঝে দূরত্ব কমিয়েছে। এর যেমন ভালো দিক আছে তেমনি মুদ্রার অপর পাশে খারাপটাও আছে। বর্তমান সময়টায় নির্দিষ্ট একজনের প্রতি কমিটেড হবার সুযোগ হয় না, কারণ হাতের নাগালে আরো অনেকেই থাকে অনুরাগের বার্তা নিয়ে।
 সময় থাকতে যোগ্য সঙ্গীর মর্যাদা করতে হয়। কিছু কিছু মানুষের এক জীবন চলে যায় মনের মতো মানুষের দেখা পেতে। কিন্তু জেদ আর অবহেলায় সেই মানুষটাকে হারিয়ে ফেলতে হয়।
অনুকে আলতাব নিজের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দেখে, যে তার লেখক হবার স্বপ্নকে উৎসাহ যোগায়, লেখার প্রেরণাকে জাগ্রত রাখে। কিন্তু আলতাব কি অনুকে শুধুই শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দেখে? নৌকায় করে বুড়িগঙ্গায় দোল খেতে চলা সময়টায় অনুর জেদের বশে আলতাব যে কবিতা লেখে, কবিতাটায় সূক্ষ্ণ হাহাকার মিশে ছিল।
এই হাহাকারটুকু হয়তোবা আমাদের সবার মনের গোপন কুঠুরিতে থাকে। হাহাকারগুলো মনের মত সঙ্গী না পাওয়ার, কাছে পেয়েও নিজের করে না পাওয়ার।
তরুর সাথে আলতাবের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নেয় হঠাৎ একদিন পড়ার খাতায় আলতাব কবিতা লেখায়। তরুর অপরিপক্ব মন তো আর জানে না, কবিতারা সময় মানে না। ওরা হঠাৎ আসে নিজের খেয়ালে, তাকে ধরে না রাখলে চলেও যায় অভিমানে। তরু ধরে নেয় আলতাব তাকে উদ্দেশ্য করেই কবিতা লিখেছে। কৈশোরের অবুঝ মনে অপরিসীম ভালো লাগার এক বৃষ্টি নামে, ভালোবাসার সংজ্ঞা না জানা তরুর কাছে এরই নাম ভালোবাসা।
তরুর স্বপ্নের ফানুস আকাশে উড়তে না দিয়ে আলতাব তাকে বাস্তবতার পথ চেনায়। তরুর প্রতি আলতাবের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শেখায় কারো দুর্বলতার সুযোগ না নেওয়ার।
লেখক হবার ইচ্ছায় পান্ডুলিপি জমা দেয়ার পর আলতাবের সাথে প্রকাশক জাহাঙ্গীরের আচরণ আমাদের প্রকাশনা জগতের বর্তমান পরিস্থিতির ধারণা দেয়। নতুন একজন লেখককে – সে যতই ভালো লিখুন না কেনো কীভাবে নিরুৎসাহিত করা হয় তার উদাহরণ এই অংশটুকু। এভাবে সম্ভাবনাময় লেখকরা আসলে ঝরে পড়ে না, তাদের ঝেরে ফেলা হয়।
বইয়ের সবচেয়ে ভালো দিক এর গল্পটা। পড়তে গিয়ে কখনোই মনে হয়নি এমনটা হতে পারে না। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া গল্পগুলো উঠে এসেছে লেখকের হাত ধরে।
এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনায় সব পজিটিভ কথাই ছিল। তার মানে কি এই, যে সবই ভালো লেগেছে?
নাহ। আক্ষেপ আছে বইকি।
প্রথম আক্ষেপ বইয়ের কলেবর। মনে হচ্ছিল লেখক তাড়ায় আছেন বইটা শেষ করার জন্য। বইতে বেশকিছু ম্যাসেজ ছিল গল্পের ছলে, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কোনটাই পূর্ণরূপে উঠে আসেনি। মেসেজগুলো শুধু ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন উনি, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন নি। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ও ঠিক একই কারণে ফুটে ওঠেনি। লেখক ধীরেসুস্থে কলাকুশলীদের মনস্তত্ত্বে আরেকটু ঢু মারলে সোনায় সোহাগা হতে পারত।
দ্বিতীয় আক্ষেপের জায়গা আলতাবের লেখক হবার যে স্ট্রাগল ছিল, তা আরো গভীরভাবে বলা দরকার ছিল। ভাগ্যদেবী কখন কার ওপর প্রসন্ন হন তা বলা মুশকিল। কিন্তু তিনি যেন খুব দ্রুতই আলতাবকে খুঁজে নিয়েছেন লেখক হবার সংগ্রাম থেকে মুক্তি দিতে। আলতাবের মানসিক যাতনা আর সংগ্রামের সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগটুকু পাওয়া যায় নি।
অনুর চরিত্রটা প্রিয় হলেও বর্তমানে এমন মানুষ বিরল। আঁখির সাথে আলতাবের সম্পর্ক ভেঙে যাক তা অনু চায় নি। কিন্তু আঁখি আর আলতাবের সম্পর্ক ভেঙে যাবার পরেও অনু্র দূর থেকে আলতাবকে ভালোবেসে যাওয়ার ব্যাপারটা বাস্তবতার সাথে খাপ খায় নি। ম্যাচিউরড একজন মানুষ হিসেবে আলতাবকে মনে কথা বলে দেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। 

চরিত্র কথনঃ

আলতাবঃ
‘দূরে আরো দূরে’ বইতে বেশকিছু চরিত্র থাকলেও তারা সবাই আলতাবকে ঘিরেই আবর্তিত। আলতাব দৃঢ়চিত্তের একজন যুবক, লেখক হবার বাসনায় যে নিজের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে নারাজ। শর্টকাটে বা অসদুপায়ে বড় হওয়ার চেয়ে নিজের যোগ্যতায় বড় হতে চায় সে।
ভালোবাসার মানুষটার জন্য নিজের স্বপ্নপূরণের উৎসাহ দানকারী অনুর থেকে দূরে সরে যাওয়া, অনুর মত কারো অভাববোধ করার পরেও আঁখির কাছে করা প্রতিজ্ঞা রাখায় বদ্ধপরিকর থাকা, অথবা ভালোবাসার মানুষটার জন্য নিজের স্বপ্ন পূরণের উৎসাহদানকারী অনুর থেকে দূরে সরে যাওয়া, অনুর মত কারো অভাববোধ করার পরেও আঁখির কাছে করা প্রতিজ্ঞা রাখায় বদ্ধপরিকর থাকা, অথবা তরু নিজেকে সঁপে দিতে চাওয়ার পরেও একা পেয়ে তার দূর্বলতার সুযোগ না নেওয়া, এসবের মাধ্যমে আলতাবের দৃঢ় ও সৎ গুণাবলীর পরিচয় পাওয়া যায়। লেখক বেশ ভালোভাবেই আলতাবকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
আঁখিঃ
লেখক আঁখিকে ইনসিকিউরড এবং ডমিনেটেড চরিত্র হিসেবে তৈরি করেছেন। বয়ফ্রেন্ডকে সন্দেহ করা, নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া, রাগ ও অভিমানের মাধ্যমে বশে রাখা এসব তার চরিত্রের অংশ। সব মিলিয়ে অপছন্দ করার মতো একটা চরিত্র। এবং সত্যি বলতে মেয়েটার উপর বেশ রাগও হয়েছিল।
অনুঃ
এই বইয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র অনু। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষটাকে সুখী দেখাই তার পরম পাওয়া। সে জানে আলতাবের স্বপ্ন লেখক হবার, তাই আলতাবকে উৎসাহ দেয়ার দায়িত্বটা নিজ থেকেই পালন করে যায়। সময়ে অসময়ে জেদ করে আলতাবের কাছে কবিতা শুনতে চাওয়া যতটা না নিজের জন্য, তারচে বেশি বোধ করি আলতাবের লেখকসত্তা জাগ্রত রাখার জন্য।
বর্তমান বাস্তবতায় সবাই যেখানে যেভাবে হোক নিজের চাওয়া আদায়ে মত্ত, অনুর মত মানুষ সেখানে বিরল। আলতাব আঁখিকে ভালোবাসে বিধায় অনু কখনোই নিজের ভালোবাসা মুখ ফুটে উচ্চারণ করে নি। বরং নিজের আকাঙ্ক্ষা বুকে চেপে আলতাব যেন আঁখিকে নিয়ে সুখী থাকে সেই চেষ্টাই করে গেছে। অনুর প্রতি শ্রদ্ধা।
তরুঃ
তরু আমাদের আশেপাশে থাকা হাজারো মেয়ের প্রতিচ্ছবি। উঠতি বয়সটা খুব বিভ্রান্তির। পৃথিবীকে চেনার এই সময়টায় মন কোন যুক্তি মানে না, বুঝে না সমাজের রীতিনীতি, জানে না আবেগকে লাগাম দেওয়ার পন্থা। ভালোবাসা আর ভালো লাগার পার্থক্য না জানা অবুঝ মনে তীব্রভাবে পছন্দের মানুষটার মন জয় করাই স্বার্থকতা মনে হয়।
আলতাব তরুকে আর পড়াবে না এটা বলার পর তরুর ভেঙে পড়া, প্রকাশক থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর আলতাবের বই প্রকাশে তরুর প্রচেষ্টা এইসব মুহুর্তগুলোয় তার অবুঝ উন্মাতাল মনের সাক্ষ্য দেয়। তরু ভুল হলেও মায়া লেগে গিয়েছিল কিশোরী এত মেয়েটার প্রতি।
নিরুঃ
এই চরিত্রটা ছোট হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আঁখি আর আলতাবের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়া লাগানোই ছিল নিরুর কাজ। কিছু মানুষ থাকে অন্যের সুখে যাদের জ্বালা হয়, এদের কাজই হচ্ছে মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করা। নিরুর প্ররোচনায় আঁখি জাহিদের সাথে কথা বলা শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতেই আঁখি আর আলতাবের বিচ্ছেদ হয়, যা গল্পের একটা টার্নিং পয়েন্ট। সে হিসেবে বলা যায় ছোট্ট হলেও গল্পে নিরু তার ছাপ ফেলতে পেরেছে।
উপরে বর্ণিত চরিত্রগুলোর পাশাপাশি উপস্থিতি ছিল জাহাঙ্গীর, ইতু আর কিছু কবিতা। পরিসরে ছোট হলেও ওরা নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করেছে, হ্যাঁ কবিতাও। শুধু পৃষ্ঠা ভরাটের জন্য কবিতাগুলো দেয়া হলে আপত্তি করতাম কিন্তু প্রতিটা কবিতা কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

লেখক পরিচিতিঃ

মুহাম্মাদ ইব্রাহীম সাহেবের লেখা এর আগে আমার পড়া হয় নি, এটাই আমার পড়া ওনার প্রথম বই। লেখকের সম্পর্কে কিছুটা জানার উদ্দেশ্যে ফ্লাপ উলটে অবাক হয়েছি। তিনি যেনো তার উপন্যাসের আলতাব চরিত্রের মতোই। নিজেকে জাহির করার বদলে লেখা দিয়ে পরিচিত হতে চান পাঠকের কাছে। ওনার আত্মবিশ্বাস ভালো লেগেছে। 
প্রচ্ছদঃ
——–
মিনিমালিস্টিক অ্যাপ্রোচে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস প্রচ্ছদ হয়েছে। বইয়ের শুরু আর শেষের আলতাব ও অনুর বৃষ্টিতে হেটে যাওয়ার দৃশ্যটা প্রচ্ছদ আইডিয়া হিসেবে চমৎকার ছিল।
উপসংহারঃ
————-
‘দূরে আরো দূরে’ এর সাথে স্বল্প কিন্তু ভালো একটা সময় কেটেছে। ছোট পরিসরে লেখক বেশ অনেককিছুই বলতে চেয়েছেন, এবং পেরেছেনও। লেখকের কথায় কিছু গল্পের সমাপ্তি হয় না, তবুও পাঠকের জন্য তিনি একটা সমাপ্তি টেনেছেন। সত্যি বলতে সমাপ্তির পর মুখে ছোট্ট একটা পরিতৃপ্তির হাসি এসেছিল। আলতাবের বিখ্যাত লেখক হওয়া, তরু বিয়ে করে স্বামীসহ বিদেশে সেটেল, আলতাবের সাথে অনুর মিলন সফল সমাপ্তি টেনেছে। ওদের মতোই সবাই সুখী হোক, ভালো থাকুক এই প্রত্যাশায় শেষ করছি।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?